শুধুই সহযাত্রী ।। রহিমা আক্তার মৌ



সাধারণত বাসে করে কোথাও গেলে যে সব কাজ করি সেগুলো হলো- ভ্যানেটি ব্যাগে রাখা লিস্ট ধরে কিছু দোয়া পড়ি। মোবাইলের খুদেবার্তা গুলো দেখে দেখে ডিলেট করি অথবা ফেইসবুকে সময় কাটাই। আজ একাই যাচ্ছি বাসে, গন্তব্য সামছুন্নাহার সানুর বাসায়। একসময় একই হলে থাকতাম আমরা, এখন সানু সহ কয়েকজন মিলে একটা সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলেছি আমরা। একেবারেই ব্যক্তিগত উদ্যোগ যাকে বলা চলে। ঈদে কিছু সেমাই চিনি আর আট দশটি শিশুকে নতুন জামা দেয়া, একুশে ফেব্রুয়ারিতে কয়েকটি পথশিশুকে পড়ার সামগ্রী (চক, ব্লাকবোর্ড, আদর্শ লিপি) দেয়া। শীতের দিনে রাস্তার পাশ থেকে কম দামে গরম কাপড় কিনে মফস্বলে পাঠানো এসব কাজই করা হয় আমাদের ছোট্ট সংগঠনের মাধ্যমে।

খুব দ্রুত বাসে উঠে সামনে থেকে চার সিট পরে ডাবল সিটের একটা সিট খালি পেয়ে বসে পড়ি। বসার আগ পর্যন্ত বুঝেছি বিপরীত লিঙ্গের কেউ একজন এই সিটের সহযাত্রী, তবে বয়স তেমন নয়। বসার পরপরেই সানুর কল,
-- কি রে তুই কোথায় এখন।
-- মাত্র বাসে উঠেছি।
-- বলিস কি তুই তো ঘন্টা খানেক আগেই বলেছিস বের হয়েছিস।
-- ঠিকই বের হয়েছি, বের হয়ে বাস না পেয়ে সিএনজিতে এসে এখন বাসে উঠলাম।
-- ওকে ফি আমানিল্লাহ, ঠিক ভাবে আয়।
আজ মোবাইলটা হাতে রাখাটা হবে পুরাই বোকামি, কারণ এমবি নেওয়া নেই যে ফেবুতে বসবো। পাশের সিটের ব্যক্তির দিকে সরাসরি তাকাতে কেমন জানি লাগে। কারণ সে পুরাই অপরিচিত, তার উপর বিপরীত কেউ। অথচ এই বিপরীত কাউকে কাউকে নিয়ে কত ভাবনা কত স্বপ্নে ভাসা। কেনো জানি হঠাৎ মনে পড়ে যায় অনিককে। অনিক আমার এক সময়ের খুবই প্রিয় কেউ ছিলো, ছিলো বলার কারণ এখন তেমন প্রিয় নেই। আগে দিনে কয়েকবার কথা হতো, কথা না হলে অসহ্য যন্ত্রনা হতো দুজনের। এখন যন্ত্রনার পরিমান কমে গেছে সেই পুড়ে পুড়ে খাটি সোনা হবার মতো।

আমার জীবনে অনিককে মনে পড়তে দিন মাস বা বিশেষ দিনের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই কোন বিশেষ ঋতুর। অনিক জীবনের সাথে এই ভাবে জড়িয়ে আছে যে ভোর থেকে সন্ধ্যা অথবা সন্ধ্যা থেকে ভোর কোন না কোন অংশে থাকেই যায়। আমাদের দুজনের অনেক ইচ্ছে ছিল বাসে চড়ে একসাথে কোথাও যাবো। কিন্তু তা কখনই হয়নি। কল্পনার জগতে কতবার যে ঘুরে বেড়িয়েছি তা শুধু আমরাই জানি।

অনিক আর আমার ভাবনা গুলোর এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমার ভাবনায় এখন শুধু বর্তমান আর বাস্তবতা, অনিকের ভাবনায় তার হবু স্ত্রী। এই তো কালকে বিকেলে ওকে মনে পড়তেই কল দিয়েছি, সেই আগের মতো কল কেটে দিয়ে নিজেই কল করে। মাত্র পৌনে এক মিনিট কথা বলার পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মোবাইলের সংযোগ, এমনটা কখনই হয়নি ওর মোবাইলের। ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেছি আমরা কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মোবাইলের সংযোগ, তবে কখনও কখনও পঞ্চান্ন মিনিট কথা বলার পর আপনা আপনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মোবাইলের সংযোগ। অনিক পেছনেই আবার কল দিয়ে বলতো,
-- নীলাঞ্জনা নেটওয়ার্ক মনে করিয়ে দিলো যে আমরা পঞ্চান্ন মিনিট ধরে কথা বলছি।
ওর কথা শুনে বলতাম,
-- প্রেমিক প্রেমিকা একটু বেহিসাবিই হয়, কিন্তু নেটওয়ার্ক হিসাবে ভুল করে না।
শুরু হতো আবার আমাদের কথা বলা। আমাদের স্বপ্নের কথাগুলোকে আদানপ্রদান করা। কাল একটু ব্যতিক্রম হল, সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবার পরপরেই অন্য নাম্বার থেকে কল আসে। আমি জানি এটা অনিকের কল,
-- কি ব্যাপার, তোমার চার্জ শেষ নাকি মোবাইলের চার্জ শেষ।
-- সব চার্জই আছে, ব্যালেন্স শেষ। এই নাম্বারে এখন  ব্যালেন্স নেওয়াই হয় না।
এরপর কিছুক্ষণ কথা বলা হয়।

এই বাসে আগে কখনও আমি উঠিনি। এই বাসের গন্তব্য কোথা থেকে কোথায় তা পুরো জানা নেই, কিন্তু আমার গন্তব্যে যাবে তা ঠিক জানি। সানুর বাসায় আগেও অনেকবার এসেছি, এখানকার বাস গুলোর শেষ গন্তব্য আলাদা আলাদা। যে বাসগুলোর শেষ গন্তব্য সানুর বাসার পাশে সেগুলোতে করে এখান পর্যন্ত আসি না আমি। যে বাসের শেষ গন্তব্য আরো অনেক পরে সেগুতে উঠলে এখানে নামতে পারি। নয়তো আগের স্টপে নেমে রিক্সায় আসি সানুর বাসায়। অবশ্য এটা আগে করতাম না, পরপর বাসে নারী নির্যাতনের খবর পাওয়ার পর থেকে এই ভাবে সতর্ক হয়ে চলা। বাসে উঠে নিশ্চিন্তে বসে থাকা বা ঘুমিয়ে যাওয়ার দিন শেষ। উঠলেই খেয়াল রাখতে হচ্ছে বাসের যাত্রী কতটা কমছে, নিজের নামার জায়গা আসার আগে অধিক হারে যাত্রী কমে যাচ্ছে কিনা। অথবা কাছাকাছি স্টপ গুলো থেকে যাত্রী উঠাচ্ছে কিনা। নিজের গন্তব্যে আসার আগেই যাত্রী কমে গেলে নেমে যেতে হবে আগেই। নয়তো মানুষখেকো ড্রাইভার হেলফারদের হাতে নিজের ইজ্জত আর জীবন বিসর্জন দিতে হতেও পারে।

এখনও তেমন ভাবনা আমার, যদি যাত্রী কমে যায় তাহলে আগেই নেমে যাব আমি। মামা, মামা বলে দুইবার হেলফারকে ডাক দিই। হেলফার শুনেনি, ভাড়া ও নিতে আসেনি এখনও। পাশের সিটের সহযাত্রীকে  জিজ্ঞেস করতেই পারি।
-- আচ্ছা এই বাস কোথায় গিয়ে থামবে।
ওপাশ ফিরে জিজ্ঞেস করি, সহযাত্রী যে জবাব দিল তা শুনে খুশিই হলাম। মানে আমার গন্তব্যের অনেক পরেই এ বাসের শেষ গন্তব্য।
অপরিচিত এই সহযাত্রীর জায়গায় যদি অনিক থাকতো তাহলে হয়তো ওদিক তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাঢ় ব্যাথা হয়ে যেতো। হয়তো অর্ধেক পথ যাওয়ার পর সিট পরিবর্তন করতে হতো ঘাঢ় ব্যাথা থেকে বাঁচার জন্যে।
উহ! চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। পরিচিত সহযাত্রী কেউ না থাকলে কেমন যে উশফুশ লাগছে, আগে এমনটা মনে হয়নি কখনও।
-- আচ্ছা এই বাস ছেড়েছে কোথা থেকে।
জবাব আসে ঠিক ভাবেই।
কথা বেশি আগায় না, আমার ভাবনা এগিয়ে যায় অনিককে নিয়ে। একবার রিকসায় উঠা নিয়ে আমাদের সেই কি উত্তেজনা। কোথা থেকে উঠবো, কোথায় নামবো। রিকসার হুট উঠাবো কিনা, নাকি ফেলে দিব। অনিক লম্বায় যত সব রিকসার হুট তোলা যাবে না ও বসা থাকলে। রিকসায় ঘুরতে ওর ভালো লাগে ধানমন্ডি এলাকায়, আর আমার ভালো লাগে মানিক মিয়া এভিনিউতে। সংসদ ভবনের সামনের দক্ষিন পাশের এই রাস্তায় একবার যাবো আবার আসবো, আবার যাবো আবার আসবো। অনিক এই জায়গার কথা শুনে বলেছিল,
-- আর জায়গা খুঁজে পেলে না, এই রাস্তাটা তো বহুমুখী বাসের দখলে থাকে সব সময়।
এসব ভাবতে ভাবতে ইচ্ছে গুলো দুর্বল হয়ে যায়। জায়গা নির্বাচন করার সাথে সাথে সময়টাও ছিল আমাদের নির্ধারণ করা। সন্ধ্যার পর আকাশে আবার ভরা জোছনা হতে হবে। আসলে কল্পনা বিলাসী যাকে বলা যায়। সাধ আছে তো সাধ্য নেই সেই ঘটনার মতো আমাদের কল্পনাগুলো।
এমন অপরিচিত কাউকে পাশের সিটে বসিয়ে নিজের প্রিয়জনকে নিয়ে ভাবতে নিজেকে পুরাই বেয়াকুব মনে হয়। এই দুই তিনবার তাকানোর ফলে বুঝতে পারি ওর বয়স অনেক কম। হিসাব না করলেও আমার থেকে পনেরো বছরের ছোট হবেই। সহযাত্রী হিসাবে কথা বলতে বলতে যেতেই পারি। পরিচিত হতেই পারি আমরা। তাই শুরুটা আমিই করলাম,
-- কোথায় থেকে এসেছো, কোথায় যাবে?
-- সিলেট থেকে এসেছি, বাসায় যাচ্ছি।
-- সিলেট! গত তিনদিন আগে আমরাও বেড়িয়ে এলাম।
কথার পিঠে কথা হতে হতে জমে উঠেছে। দুজনের বর্তমান অবস্থা কাজ নিয়েও কথা হয়। ও এবার এইচএসসি দিবে। ছুটি পেয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গেছে। এখন বাসায় যাচ্ছে।
এইচএসসি দিবে শুনে আবার অনিকের কথা মনে পড়ে। ওর ছোট ভাই রবিন এবার এইচএসসি দিবে। রবিনের পরীক্ষার পর অনিকের বিয়ের কাবিন হবে।

ব্যাগের মাঝে মোবাইলটা বেজে উঠে, হাতে নিয়ে ইয়েস বার্টন চাপতে গিয়ে দেখি মিস কল হয়ে গেল। নাম্বার বের করে দেখি অনিকের কল। বাসে কল ধরলে ঠিক ভাবে কথা বলা যাবেনা ভেবে মোবাইল রেখে দিই। কল না এসে অনিক আসলে বেশ হতো। বোকা বোকা লাগে ভাবনা গুলো, সাত বছর আগের পরিচয়। তিন বছর পর দেখা, একটা দিনও বাসের সহযাত্রী হতে পারিনি আমরা। অনিককে প্রায় বলতাম,

-- বৃষ্টির রাতে বাসে বা ব্যক্তিগত গাড়িতে যাবো আমরা। জানালা খোলা থাকবে, ঝিরঝির বৃষ্টির পানি ছিটে আসবে ভেতরে।
অনিকের ভাবনার সাথে আমার ভাবনার অনেক ব্যবধান, ও মোবাইল কথা বলতেই হারিয়ে যায়। মোবাইল হাতে ছাদে উঠে যায়, বারান্দায় ঘুরাঘুরি করে।
-- আপনার মোবাইল নাম্বার টা দেয়া যাবে।
সহযাত্রীর এমন কথায় আমি কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসি।
-- নিশ্চই। নাম্বার বলছি তুলে নাও। ০১৬................
নাম্বার তুলে ও কল দেয়।
-- আসলে কল যাব না এখন, মোবাইলে লোড নেয়া হয়নি অনেকক্ষণ। তাই কাউকে কল দিতে পারিনি।
-- এটা ঠিক না, কিছু হলেও রাখবে। কখন প্রয়োজন পড়ে।
-- না, সমস্যা হবে না। ভাইয়া বারবার কল দিচ্ছে, বলল, ও এসে দাঁড়াবে আমার জন্যে।
অমনি কল আসে অনিকের,
-- কোথায় তুমি, মনে হয় বাসে।
-- হ্যাঁ, সানুর বাসায় যাচ্ছি। রাতে থেকে সকালে আসবো। তুমি কোথায়?
-- বের হলাম, একটু কাজ সেরে বাস স্টপেজ যাবো। রবিনকে নিয়ে আসতে।
-- ওকে আমি বাসায় পৌছে কল দিব, নামার সময় হয়ে গেছে।
-- ঠিক আছে।
মোবাইল রেখে সহযাত্রীকে বললাম,
-- নাম্বারটা বল, আমিই কল দিই। সামনেই নেমে যাবো।
সহযাত্রী নাম্বার বলে, আমি মোবাইলে তুলে কল দিই। ওকে সামান্য অপ্রস্তুত দেখায়। হয়তো ভেবেছে আমি কল দেয়ার আগেই নেমে যাবো বা নেমে যেতে হবে। তা আর হয়নি, কল দিয়েই মোবাইল ব্যাগে রেখে উঠে দাঁড়াই।
-- আচ্ছা তোমার নামটাই জানা হল না, মোবাইল নাম্বার সেভ করবো কি নামে।
-- আমার নাম রবিন।
-- তোমরা কি দুই ভাই।
-- জ্বি। কিন্তু,,
কোন কিন্তু নেই, কথা হবে আশাকরি পরে। কথাটা বলে দ্রুত নেমে যাই। রিকসায় উঠে অনিককে কল দিই,
-- অনিক মিনিট পনেরো পর ভাইকে রিসিভ করতে বাস স্টপে দাঁড়িও।
-- আরে, তুমি কোথায়? এটা কি বললে,,
কল কেটে দিই আমিই, রবিনের সব গল্প আমার জানা। তবুও আজ ও শুধুই আমার অপরিচিত সহযাত্রী হিসাবেই থাকুক।

লেখক- সাহিত্যিক কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক। 

সূচিতে ফিরতে ক্লিক করুন


আপনার লেখা ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস, সাহিত্যিকের জীবনী, সাক্ষাৎকার, সাহিত্যের খবর বর্ণপ্রপাতে প্রকাশ করতে চাইলে ইমেইল করুন bornopropat@gmail.com

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।