প্রিয় বাবা,
কতদিন তোমাকে লিখিনা আমার জানা নেই। তবে আমি প্রথম তোমাকে চিঠি লিখেছিলাম শান্তিনিকেতন থেকে ১৯৯৭ সালে। তুমি আমাকে অচেনা,অজানা জায়গায় রেখে আসলে। অজপাড়াগাঁয়ে বড় হওয়া মেয়েটি শহরে সভ্যতার সাথে পরিচিত ছিলোনা। বাংলাদেশে ফিরে তুমি লিখলে,মা মুন তোকে জয়ী হয়ে ফিরে আসতে হবে।আরো লিখলে তোকে রেখে আসতে আমার বুকের ভেতরটা ব্যথায় টনটন করছিল। তাই তুমি পেছনে ফিরে তাকাওনি। আমার এখনো মনে আছে বাবা, আমি সেদিন খুব হাউমাউ করে কাঁদছিলাম। নানা ঘাতপ্রতিঘাতে উঠে দাঁড়িয়েছি। আমার মনে আছে তখনো আমি ছাই দিয়ে দাঁত মাজতাম। বাংলাদেশ থেকে ছাই বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলাম। এখন মনে হলে খুব হাসি একা একা। সেই অজপাড়াগাঁয়ের মেয়েটি তার স্বপ্নের সমান বড় হয়েছে। বাবা, তুমি আমাদের শিখিয়েছো কিভাবে কথা বলতে হয়,কেমন করে আওয়াজ না করে খেতে হয়।আমাদের পাশের গ্রামের প্রাইমারী স্কুল থেকে সেন্টার পাশ করে ভর্তি হলাম বাংলা হিলি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে।সেবার ক্লাস ফাইভের সেন্টার পরীক্ষায় আমি স্কুল থেকে ফাস্ট হলাম। তোমার কি আনন্দ বাবা!বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে আমাদের স্কুল। কাঁচা রাস্তা, যদিও এখন পাকা রাস্তা। রোদ,ঝড়, বৃষ্টিতে ছাতা নিয়ে হেঁটেই যেতাম,হেঁটেই আসতাম। যদি জোরে বাতাস হতো তাহলে ছাতা উড়িয়ে নিয়ে যেতো। কখনো দুমড়েমুচড়ে যেতো। সেসময় তুমি আমাদের ভাল ব্যান্ডের ছাতা কিনে দিতে। যদিও বুঝতাম না ব্যান্ড কি জিনিস।অনেক অভাবে ও তুমি আমাদের জন্য প্রাইভেট মাস্টার বাড়িতে রেখেছিলে।তবে আমি বরাবরই খুব ভালো ছাত্রী ছিলাম। ভাল রেজাল্ট করলে তুমি সবসময় ভালো উপহার দিতে।সিক্স থেকে সেভেনে উঠেই দামী ঘড়ি কিনে দিলে।পরেরবার বললে আরো ভালো রেজাল্ট করলে আরো ভালো উপহার দেবো।আমি ক্লাস এইটে আরো ভালো রেজাল্ট করলাম।তুমি আমাকে ১৪ ইঞ্চি সাদাকালো টিভি কিনে দিলে।আমাদের গ্রামে প্রথম টিভি আসল আমাদের বাড়িতে। তুমি ভোর বেলা আমাদের তুলে দিতে।বলতে ভোরের পড়া মনে থাকে।আমরা হারিকেন জ্বালিয়ে বাক-বাকুম করে পড়তাম।আমাদের একটা ঘড়ি ছিল। সাইকেলের বেলের মতো ক্রিরিং ক্রিরিং আওয়াজ। সেই এ্যার্লামে আমরা প্রতিদিন উঠতাম। আমরা পড়তাম, তুমি ব্যায়াম করতে।আমরা কখনো ঘুমিয়ে পড়তাম।শব্দ না পেলে তুমি বলতে চোখে জলের ঝাপটা দাও,ঘুম আর আসবেনা।কখনো মনে মনে তোমাকে খুব বকতাম। এখন বুঝি সেদিনের অর্থ। ছোট্টোবেলা থেকেই আমি খুব দুষ্টু ছিলাম। গাছে উঠে আম চুরি করা থেকে শুরু করে সব রকমের দলনেতা ছিলাম।মাঠে গরু চড়াতাম।তোমার মনে আছে বাবা,তুমি একবার একটা বিদেশি ক্যাম্বেল গরু কিনেছিলে।সেই সময় পূর্ব গোহাড়ার সুবাস আমাদের বাড়িতে থাকত। মূলত সুবাসই গরুগুলোর দেখাশোনা করত।আমরাও দেখতাম।মাঠে গিয়ে ঘাস কেটে নিয়ে আসতাম। ধান কাটার সময় শিষ কুড়াতাম। সেই ধান বিক্রি করে আমাদের চাদর, সোয়েটার কিনে দিতে।ধান দিয়ে আমরা জিলেপি, মিষ্টি কিনে খেতাম।মাঠে ধান কাটা শেষ হলে আমরা দল বেঁধে নাড়া কাটতাম। নাড়া শুকিয়ে গেলে চটে বেঁধে মাথায় করে বাড়িতে আনতাম।সেই নাড়া দিয়ে বাড়ির উঠানে দুচুলায় ভাত তরকারি রান্না হতো।আমরা চুলার পাড়ে বসেই খেতাম।ভোরবেলায় আবার সেই নাড়া দিয়ে ধান সিদ্ধ হতো।আমরা বস্তায় ভরিয়ে সেই ধান খলায় নিয়ে গিয়ে শুকাইতাম।আমাদের ছোটবেলা কি ব্যস্ততায় না কেটেছে!তুমি সুগার মিলে চাকরি করতে।সিজন টাইমে সাইকেলে করে কুসার (আখ) বেঁধে আনতে। আহা! কি সুখের ছিলো দিনগুলো। সেইসময় দাঁতেরও খুব ধার ছিল।আমাদের মাটির দোতলা বাড়ি ছিল, যদিও বাড়িটি এখনো আছে। আমরা ভাইবোনেরা গাদাগাদি করে এক ঘরে থাকতাম। শীতের সময় আমরা লেপ নিয়ে খুব টানাটানি করতাম। একই লেপে থাকতাম আমরা। আমি (কিলোমনি) আমার মেজো বোন ভালো নাম অনিন্দিতা কে খুব মারতাম। কিন্তু ও কখনো আমাকে মারত না।একদিন আমাকে এমনই মেরেছিলো যে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলাম। তারপর থেকে ওকে আর আমি কখনো পারিনি।আমি দেখতে খুব কালো ছিলাম। পরিবারের কেউ আমাকে আদর করত না।আমি বড় হয়ে শুনেছি আমার মেজো কাকার চার মেয়েই অপরুপ সুন্দরী। আমার ঠাকুমা দাদু ওদের কে খুব আদর করত,ভালোবাসতো।তুমি এবং মা আমাকে খুব ভালবাসতে।আমার মেজো কাকা তার মেয়েদের খুব সুন্দরীর জন্য বিয়ে দিতে বেগ পায়নি। সেসময় আমাদের খুব অভাব ছিলো। তুমি কম বেতনের চাকরি করতে। কতদিন দেখেছি তুমি বাজার করতে গিয়ে খালি ব্যাগ ফেরত নিয়ে এসেছো।আমাদের ভাইবোনদের পড়াশোনার ব্যাপারে তুমি প্রধান ভূমিকায়। মা নীরব থেকেছেন। তবে শেষে এসে মা হাল ধরেছেন।আমি দেখেছি মাকে নিঃস্ব হতে।গলার মালা,কানের দুল,চুড়ি বিক্রি করতে।পাড়াপ্রতিবেশিরা বলত তোর হাত,কান,গলা কিছুই তো নাই।সব গয়না ছেলেমেয়েদের জন্য বিক্রি করলি?আমার মা বলত আমার গয়না তো আমার ছেলেমেয়েরাই।আজ সত্যি সত্যিই আমরা মায়ের কাছে গয়না বাবা।মা খুব গর্ব করে বলে আমার চার ছেলেমেয়েই সরকারি চাকুরীজীবি। তাছাড়া মা-ও মাস গেলে বিশ হাজার টাকা পায়।মুক্তিযোদ্ধা ভাতা।আজ আমাদের সংসার ভর্তি আনন্দ আর আনন্দ বাবা।সবই আছে শুধু তুমি নাই বাবা। আচ্ছা বাবা,তুমি কি আমাদের দেখতে পাও?আমার মেয়ে প্রীতিলতা খুব গর্ব করে তোমাকে নিয়ে। বলে আমার দাদু দেশ স্বাধীন করেছে।সন্ধেবেলা রাস্তা দিয়ে হাঁটলেই বলে, দেখ দেখ ও-ই যে আকাশের উজ্জ্বল তারাটা আমার দাদু।তোমাকে প্রীতিলতা খুব ভালবাসে বাবা।বাবা ও বাবা তুমি আমার খুব প্রিয় বাবা।আমার জীবন গড়িয়ে দিয়েছো তুমি। তোমার অর্থ ছিলোনা কিন্তু মনের জোর ছিল অনেক।আমাকে কোন সাহসে শান্তিনিকেতনে পড়তে পাঠিয়েছিলে! প্রথম প্রথম টাকা দিতে পারলেও পরে পারেনি।আমি নিয়মিত প্রাইভেট পড়িয়েছি।সবাই জানত বিদেশে পড়তে আসে বড়লোকের ছেলেমেয়েরা। আমার অভাবের কথা আমি কাউকে কোনদিন বলিনি।পৌরসভার ভোটের সময় দুই পক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন মারা যায়।তোমাকে শত্রুতা করে আসামি করে। তোমাকে জেলে নিয়ে যায় অবশ্য পরে হাইকোর্টের বিচারে তুমি নির্দোষ প্রমাণিত হও।সেই সময় চার ভাইবোন পড়াশোনা করি।কি নিদারুণ কষ্ট! আমি আজও ভুলতে পারিনা। দিনাজপুর জেলখানার পাশ দিয়ে গেলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে সেইসব দিনরাত্রি। তোমাকে টিকিট কেটে মঙ্গলবার করে দেখতাম। আমাদের কি কষ্ট হতো বাবা। একটু সময় হলেই পুলিশ বলত সময় শেষ লাঠি দিয়ে তাড়াতো।তোমাকে ছুঁতে ও পারতাম না। তোমাকে কিছু খাবার দিয়ে চলে যেতাম।বাসে যেতে যেতে খুব কাঁদতাম... আমি খুব অনুভব করতাম আমার বাবা জেলখানার ভিতরে আমাদের চিন্তায় চিন্তায় দুমড়েমুচড়ে যায়। আমাদের পুকুর, জমি,বাঁশঝাড় ছিল তোমার বন্ধু গনেশ কাকু আমাদের টাকা দিতো কেস চালানোর জন্য। পরে জেল থেকে বেরুনোর পর আমাদের সব জমিগুলো বাবার কাছ লিখে নেয়।কাকুর কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।কাকু টাকা না দিলে আমাদের পড়াশোনা, তোমার কেস চালানো খুব কষ্টসাধ্য হতো।তুমি জেল থেকে বের হয়ে এলে।কিছুদিন পরই স্টোক করলে।আমি তখনও শান্তিনিকেতনে। মা তোমাকে নিয়ে আসল কলকাতা। সল্টলেকের আনন্দলোক হাসপাতালে তোমার ওপেনহার্ট সার্জারী করালাম। মা আর আমি। অপারেশনের দিন অবশ্য আমার কজন বন্ধুবান্ধব ছিলো।সেসময় কলকাতায় বাংলা বনধ্ ছিল। কোন গাড়ির চাকা ঘোরেনি।আমি ৫/৬ কিলোমিটার রাস্তা দৌড়ে দৌড়ে তোমার জন্য ওষুধ সংগ্রহ করেছি। সেসময় আমার সঙ্গে ছিল সঙ্গীতা মন্ডল ও হেমন্ত পটুয়া।যেদিন তোমার অপারেশন হয় সেদিন রিমা দি,সোমা দি,রিমা দির বাবা মা সঙ্গে ছিল। উনাদের ঋন আমি কোনদিন শোধ করতে পারবনা।বেশ কিছুদিন রান্না করা খাবার আমাদের এনে খাইয়ে দিয়েছে। ছয় ঘন্টা ধরে বাবা তোমার অপারেশন হয়েছে। যখন শেষ হয় তখন আনন্দলোক হাসপাতালে সবখানে উচ্চারিত হলো বাংলাদেশ থেকে আগত অজিত রায়ের অপারেশন সম্পুর্ণ হয়েছে। পরিবারের যে কোন একজন সুযোগ পাবেন দেখার। মাকে বললাম, মা যাও।মা খুব কাঁদছিল। আমাকে বলল তুই যা।আমিও খুব ভয় পাচ্ছিলাম আর কাঁপছিলাম। শেষে আমার বন্ধু সঙ্গীতা গেল সাত তলায় তোমাকে দেখতে।কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলো।আমরা সবাই অপেক্ষা করছিলাম সঙ্গীতার জন্য।ও এসেই আমাদের দেখে জোরে জোরে কান্না শুরু করে দিলো।ভয়ে কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারছিলাম না।ও কাঁদছিল যখন ধরেই নিয়েছিলাম কোন খারাপ খবর।একটু পরেই বলল কাকু ভাল আছে।অপারেশন সাকসেসফুল। ওকে খুব মারছিলাম তখন। কেন ও কাঁদছিল? পরে বলল আনন্দে কাঁদছিলো।সল্টলেকে আমরা একটা ঘরে ভাড়া নিয়েছিলাম এক মাসের জন্য।তোমার কাছে থাকার আমাদের সুযোগ ছিলনা।একমাস পরে আমরা তোমাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসলাম। তুমি আর মা মিলে তোমরা হেঁটে হেঁটে ঘুরতে শান্তিনিকেতন। আমার চোখ জুড়িয়ে যেত মা তোমার হাত ধরে ধরে ঘুরে বেড়াতো বলে।আমি তখন সনৎ জেঠুর বাড়িতে ভাড়া থাকতাম।ফুলে ফুলে ভরা ছিলো বাড়িটা।শান্তিনিকেতনে একমাস থেকে তোমাকে সুস্থ করে মাকে নিয়ে তোমাকে রাখতে গেলাম বর্ডারে।কনকনে ঠান্ডায় কি কষ্ট করে তোমাকে মালদা পর্যন্ত ট্রেনে তারপর বাসে করে নিয়ে গেলাম। তখন মালদা পর্যন্ত ট্রেন চলতো। এখন তো বালুরঘাট পর্যন্ত ট্রেন চলে।তোমাদের রেখে আমি চলে আসলাম শান্তিনিকেতন। আমার এম.এ. শেষ হলে চলে গেলাম কলকাতা। কলকাতায় চাকরি নিলাম প্রাইভেট ফার্মে। টিপু সুলতান মসজিদের পাশে লিন্ডসে স্ট্রিটের পাশেই আমার অফিস। থাকতাম দমদমে।মেট্রোরেলে যাতায়াত করতাম।দুবছর চাকরি করে বাংলাদেশ চলে আসলাম।ও হ্যা কলকাতার প্রথম চাকরির বেতনে মাকে গ্যাসের চুলা,সিলিন্ডার কিনে দিলাম।মা কত কষ্ট করে মাটির চুলায় রান্না করে।আমার খুব মনে আছে বাবা,সেদিন আমার থেকে তুমি বেশি খুশি হয়েছিলে।তারপরের মাসে রঙ্গিন ১৪" টিভি কিনে দিলাম। তুমি,আমি কিলোমনি মিলে স্বপন কাকার ভ্যান ভাড়া করে বিরামপুর থেকে টিভি কিনে আনলাম। তোমাকে বললাম বাবা তোমার জন্য টিভিটা।তোমার চোখে সেদিন শুধু আনন্দ দেখেছি বাবা।মাঝখানে শান্তিনিকেতনে আমার জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। সেই ঘটনা আপাতত বাদই দিলাম।বাড়িতে এসে ঘোষণা দিলাম আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও।আমি বারবার বলার পরও তোমরা আমাকে রেখে তোমাদের মেজো মেয়েকে বিয়ে দিলে। আমি সেদিন খুব হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম।আমার কষ্টটা তোমরা কেউ বোঝেনি।চাকরি পেয়ে চলে গেলাম সাভারে।এনজিওতে চাকরি কঠোর পরিশ্রম করতে হয়।আমার কোন সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিলোনা। তুমি অগ্রিম বেতনের টাকা নিয়ে এসেছিলে তাই আমি চাকরি ছাড়তে ও পারিনি।কঠোর পরিশ্রম সকাল সাতটা থেকে রাত্রি দশটা পর্যন্ত। বেতনের টাকা পরিশোধ হলে তুমি নিজেই এসে আমাকে নিয়ে গেলে।তুমি আবার অসুস্থ হয়ে ঢাকার পিজি হাসপাতালে ভর্তি হলে।আমি বাড়িতে।প্রথম আলো পত্রিকায় তোমাকে নিয়ে একটা প্রতিবেদন বের হলো।পার্বতীপুরের গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র থেকে ফোন এলো।আমাকে ওরা যেতে বললেন। আমি গেলাম।পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন স্যার আমাকে চাকরি দিলেন।চলে এলাম পার্বতীপুর। ট্রেণিং সেন্টারে ট্রেইনার ছিলাম। ভালোই লাগত।পাশাপাশি অন্য চাকরির জন্য চেষ্টা করলাম। ওখান থেকে ব্র্যাক ব্যাংকে চাকরি হলো।এবার চলে গেলাম ঢাকা। ব্যাংকে চাকরি আরো কঠোর পরিশ্রম। কিন্তু আমার খুব ভাল লাগত।এখানে আমার কলিগরা আমার ই মতোন।সেই সময় যা বেতন পেতাম সেটাই অনেক মনে হতো।আমার যা লাগবে রেখে তোমাদের টাকা পাঠিয়ে দিতাম। কি মধুর ছিলো দিনগুলো। না পাওয়ার কিছু কষ্ট সুপ্ত অবস্থায় থাকত।সেই কষ্টকে পাত্তা দেওয়ার সময় কোথায়! গ্রাম বিকাশে চাকরি করার সময় পরিচয় হয়েছিল ট্রেনে আনিসুর রহমান আনিসের সাথে।আমি আর আমার ছোট ভাই অর্ণব মিলে পতিসরে যাচ্ছিলাম ট্রেনে। সেখানেই আলাপ হয়।তিক্ত সম্পর্ক থেকেই বন্ধুত্ব হয় তারপর একদিন বিয়ে করে ফেলি। দীর্ঘদিন গোপন থাকে। তোমরা জানার পর খুব কষ্ট পাও।আমাকে তোমাদের কাছে নেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করো।কিন্তু আমি তোমাদের কোন কথা শুনিনি। এখন সেদিনের জন্য খুব কষ্ট পাই।আমি আমার গ্রামে এখনো যেতে পারিনা,এ আমার জন্য সবচেয়ে বেদনার, কষ্টের।এত জায়গা ঘুরি কিন্তু ও-ই গ্রাম আমার ছেলেবেলা কিছুতেই ভুলতে পারিনা। কোন অনুষ্ঠানে যেতে পারিনা, এখনো ডুকরে ডুকরে কাঁদি বাবা। এর মতো কোন কষ্ট পৃথিবীতে আছে কিনা আমার জানা নেই।প্রসব বেদনার থেকে ও যন্ত্রণাদায়ক। দুর্গাপূজা, বাসন্তীপূজা,সরস্বতী পূজা,নবান্ন আসলেই খুব খুবই কাঁদি বাবা।এসব আমার জীবনের সাথে মিশে আছে বাবা।আমার খেলার সাথীরা যখন বাবার বাড়ি বেড়াতে আসে তখনও কাঁদি। এ কথাগুলো কাউকে কোনদিন বলিনি আজ তোমাকে বলছি বাবা।তুমি কতবার আমাকে ফোন দিতে। ও-ই ঘটনার পর আর ফোন দিতে না।আমি অন্য নম্বর থেকে ফোন দিয়ে তোমার গলা শুনতাম। তুমি হ্যালো হ্যালো বলতে আমি চুপ করে শুনে ফোন কেটে দিতাম বাবা।দীর্ঘদিন আমাকে মেনেই নাওনি।এমনকি আমার টাকাও নিবে না।আমি প্রিয়াংকার পড়াশোনার খরচ দিতাম। শুধু সেটা নিতো। তারপর মায়ের মনটা গলে গেলো।আস্তে আস্তে সবার সাথে যোগাযোগ হতো শুধু তুমি বাদে। মাকে ফ্রিজ কিনে দিলাম। তুমি জানতে কিনা জানিনা। বড় এলজির আবার টিভি কিনে দিলাম।মা জানতো।ও হ্যা তখন তো আমি হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসেছি। তোমার জন্যই চাকরিটা পেয়েছি বাবা।যে কথা কাউকে কোনদিন বলিনি, আজ বলছি।তুমি বলেছিলে আমাকে কথা দে।আমি কথা দিয়েছিলাম।বলেছিলাম কাউকে কোনদিন বলবনা বাবা।আজ ও বলিনি তবে তোমার কাছে চিঠি লিখছি তো তাই লিখছি। আমাকে ক্ষমা কোরো বাবা।সেদিন ঠিক সকাল ১০টায় ফোন আসল অচেনা নম্বর থেকে। আমাকে বলল আপনি একটু বাঁশের হাটে বাজারে আসেন আপনার এক আত্মীয় এসেছে। আমি বললাম কে এসেছে আমাকে ফোনটা দিন।উনি বললেন এটা আপনার জন্য সারপ্রাইজ। বলা যাবে না।আমি বললাম আপনারা বসেন আমি আসতেছি। মনের মধ্যে অনেক উথাল পাথাল চিন্তা করতে করতে আসলাম।এসেই যা দেখলাম - স্বয়ং আমার বাবা।বিশ্বাস করো বাবা সেদিনটা আমি আজো বিশ্বাস করতে পারিনা।যে বাবা আমাকে সহ্যই করতে পারেনা,সেই বাবা আমার সামনে।তুমি আমি আমরা সেদিন বাঁশেরহাটে অঝোরে কাঁদছিলাম। আমাদের কে দেখছে আর না দেখছে সেদিকে কোন খেয়াল ই নাই।আমাদের কত কথা,কত গল্প হলো...তুমি বললে আজকের দিনের কথা যেন কখনো না বলি কাউকে। বললে তোর মা জানলে আমাকে বকবে।মনে মনে খুব হাসলাম।মা তো প্রতিদিন এখন আমার সাথে কথা বলে।তারপর তুমি প্রায়ই পিজিতে ভর্তি থাকতে।আমি মেয়েসহ দুবার তোমাকে দেখতে গেছি।প্রিয়াংকা সঙ্গে ছিল। ও প্রীতিলতাকে শিখিয়ে দিয়েছিল দাদুকে জোর হাত করে নমস্কার দিবে।আমি জানালা দিয়ে দেখছিলাম বাবা,আমার ছোট্ট আধো আধো কথা বলা মেয়েটি ঘরে ডুকেই তোমাকে নমস্কার দিলো।তোমার পাশে বসে নিলের্র্।ওকে চকোলেট দিলে,২০ টাকা দিলে।মাকে ফোন করে বললে আমার নাতনিকে নতুন জামা কিনে দিও।মা তোমার কথা রেখেছিল বাবা।আমার মেয়েকে খুব সুন্দর একটা জামা কিনে দিয়েছিল।তোমার প্রতি একটা অদ্ভুত টান প্রীতিলতার।বড় হলে তোমাকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্প লিখবে প্রীতিলতা।
বাবা আমার যখন খুব মন খারাপ হয় তখন এখনো খুব কাঁদি।তোমার কথা খুব মনে পড়ে।যদি একবার আর একবার তোমার দেখা পেতাম কত কথা বাঁকি আছে তোমাকে বলার।বাপ বেটি মিলে খুব গল্প করতাম। জানো বাবা যেদিন অনেক কিছু রান্না করে কাঁচের ঝকঝকে টেবিলে সাজিয়ে রাখি শ্বশুরবাড়ির লোকজনের জন্য।ঠিক তখনি মনে পড়ে।মনে মনে ভাবি একদিন যদি তোমাকে এ টেবিলে বসে খাওয়াতে পারতাম। তুমি কত প্রশংসা করতে।আমার জীবনটা ধন্য হয়ে যেত বাবা।কারন আমার জীবনের সমস্ত অবদান তোমার।কিন্তু পারিনি বাবা তোমাকে এমন করে খাওয়াতে। তুমি জানতেই পারলেনা বাবা,তোমার মেয়ে কতকিছু রান্না করতে পারে।এ দুঃখ আমার আজীবন থাকবে বাবার্।
বাবা আমি অসুস্থ। আমার সবকিছু জেনে কোন সুস্থ মানুষ আমাকে বিয়ে করতো না।আমার সবকিছু জেনে এই মানুষটি আমাকে বিয়ে করেছে। তোমার জামাইকে তুমি ক্ষমা করে দিও বাবা। ও খুব ভালো মানুষ বাবা। তোমাকে খুব শ্রদ্ধা করে বাবা। তুমি তো সব দেখতে পাও বাবা। আমরা সবাই ভালো আছি । গত ১০/৫/২০২৩ তারিখে তোমার আদরের ছোট মেয়ের বিয়ে হলো। আর অর্ণবের বিয়ে গত বছর হয়েছে। তোমার বউমা খুব সুন্দর। ভালো নাচতে পারে, ইংরেজী সাহিত্যে পড়াশোনা করে। আমাদের পুরাতুন বাড়িটা প্রিয়াংকা মিউজিয়ামের মতো করেছে।তোমার ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলো সাজিয়ে রেখেছে। আমি লুকিয়ে গিয়ে দেখে এসেছি। আর নতুন বাড়িটা একেবারে আধুনিক। সেদিন বাড়িতে গিয়ে সবার আগে তোমার কথা মনে পড়েছে।আমি,প্রীতিলতা আর তোমার জামাই গিয়েছিলাম। দীর্ঘ ১৩ বছর ৪ মাস পর। এখন আর কোন কাঁচা রাস্তা নেই। সব পাকা রাস্তা। কি সুন্দর বাড়ির সামনেটা ফাঁকা। মা ফুলের গাছ, শাকসবজির গাছ লাগিয়েছে। আজ এ পযন্তই বাবা.....
তোমার অতি আদরের
মুন
অদিতি রায়
অদিতি রানী প্রকৃত নাম হলেও লেখক হিসেবে পরিচিত অদিতি রায়। জন্ম ১৯৮১ সালে ১৩ নভেম্বর দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার গোকুল গ্রামে মাতুলালয়ে। বাবা-বীর মুক্তিযোদ্ধা অজিত রায়; কবি, সমাজসেবক, বৃক্ষপ্রেমী। সরকারী চাকুরীজীবী ছিলেন। মা-কল্পনা রায় (স্বর্ণগর্ভা)। স্বামী-আনিসুর রহমান আনিস, ব্যবসায়ী ও আবৃত্তি শিল্পী।
অদিতি রায় বাংলা হিলি সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এস,এস,সি। মহিলা কলেজ থেকে এইচ,এস,সি এবং শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় (ভারত) থেকে দর্শনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি বর্তমানে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসাবে কর্মরত আছেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ, প্রেমে অপ্রেমে, (কাব্যগ্রন্থ)। সম্প্রীতি গবেষণা করেছেন গণহত্যা নিয়ে। প্রবন্ধ, কবিতা, দেশি-বিদেশি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
লেখালেখির সম্মাননা স্বরূপ পেয়েছেন, চেঞ্জমেকার এ্যাওয়ার্ড ২০২০, শব্দশর কবি সম্মাননা, এপার ও ওপার বাংলা মানবাধিকার নদীবন্ধু গুণীজন সম্মাননা।