সময় ১৯৬৪ সালের ১৮-ই অক্টোবর।
স্থান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা, ধানমন্ডি ৩২।
সময় : রাত প্রায় আনুমানিক দেড়টা।
পরিবারের সবার মধ্যেই বিরাজ করছে নতুন অতিথির আগমনের অপেক্ষার প্রহর। বিশেষ করে বড় চার ভাই বোনের মধ্যে যেন উৎকন্ঠার শেষ নেই, ঘুমে টুলুটুলু চোখে জেগে আছে নতুন অতিথির আগমনী বার্তার শোনার জন্য। অতঃপর সব অপেক্ষার প্রহর শেষে খবর এলো তাদের ঘরে এক ছেলে সন্তানের আগমন ঘটেছে। সদ্য জন্ম নেয়া নবজাতক, মাথায় ঘন কালো চুল গাল দুটো নরম তুলতুলে, দেখতে বেশ।
ছেলেটির দুর্ভাগ্য ছিলো, জন্মের পর বাবাকে কাছে পায়নি তেমন করে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের পর রাজবন্দী হিসেবে জেলে ছিলেন ছেলেটির পিতা। পনেরো দিন পরপর ছেলেটি তার পরিবারে অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে যেতো। জেলখানায় বাবাকে ছেড়ে যেন আসতেই চাইতো না। ছেলেটিকে বুঝানো হয়েছিলো ওই কারাগার তার বাবার বাড়ি। ছোটো মন, জেলখানার মানে কি'ই বা আর বুঝবে।ছেলেটির যখন তার বাবার কথা মনে পড়তো তখন তার মা নিজেকেই বাবা বলতে শেখাতেন। ছেলেটিও তখন তার মা'কেই বাবা বলে ডাকতো।
সদ্য শৈশবোত্তীর্ণ ছেলেটি ছিলো ভীষণ দুরন্ত।আর তার দূরন্তপনার সঙ্গী ছিলো বাইসাইকেল। স্কুলেও যেতো সাইকেলে চড়ে। মধ্যবর্তী ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে বেরিয়ে পূর্ব প্রান্তের সাদা একটি দালান পর্যন্ত ছিলো সেই ছোট্টো সাইকেল আরোহীর দৌড়ানোর সীমানা। ছেলেটির স্বপ্ন ছিলো বড় হয়ে সৈনিক হবে।
ছেলেটির জন্মের পর তারা বাবা, পৃথিবী বিখ্যাত দার্শনিক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত 'বার্ট্রান্ড রাসেল' এর নামের সঙ্গে মিলিয়ে পরিবারের সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য অর্থাৎ সেই সেই ছেলেটির নাম রাখেন রাসেল, শেখ রাসেল।
[বার্ট্রান্ড রাসেল সম্পর্কে জানতে গুগল দেখুন]
চলছিলো দিন, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছিলো শেখ রাসেল অর্থাৎ সেই ছেলেটি। ১১ বছর হতে তখন প্রায় ২ মাস বাকি ঠিক সেসময়ে অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যূষে একদল তরুণ সেনা কর্মকর্তা ট্যাঙ্ক দিয়ে ধানমণ্ডিস্থ ৩২ নম্বর বাসভবনটি ঘিরে ফেলে, ছেলেটির পুরো পরিবার খুব নৃশংসভাবে খুন হয়। শেখ মুজিব অর্থাৎ ছেলেটির বারার নির্দেশে রাসেলকে নিয়ে পালানোর সময় ব্যক্তিগত কর্মচারীসহ রাসেলকে অভ্যুত্থানকারীরা আটক করে। আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, "আমি মায়ের কাছে যাব"। পরবর্তীতে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিলেন "আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা - বড় বোন) কাছে পাঠিয়ে দাও"। ব্যক্তিগত কর্মচারী এএফএম মহিতুল ইসলামের ভাষ্যমতে,
"রাসেল দৌড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরে। আমাকে বললো, ভাইয়া আমাকে মারবে না তো? ওর সে কণ্ঠ শুনে আমার চোখ ফেটে পানি এসেছিল। এক ঘাতক এসে আমাকে রাইফেলের বাট দিয়ে ভীষণ মারলো। আমাকে মারতে দেখে রাসেল আমাকে ছেড়ে দিল। ও (শেখ রাসেল) কান্নাকাটি করছিল যে 'আমি মায়ের কাছে যাব, আমি মায়ের কাছে যাব'। এক ঘাতক এসে ওকে বললো, 'চল তোর মায়ের কাছে দিয়ে আসি'। বিশ্বাস করতে পারিনি যে ঘাতকরা এতো নির্মমভাবে ছোট্ট সে শিশুটাকেও হত্যা করবে। রাসেলকে ভিতরে নিয়ে গেল এবং তারপর ব্রাশ ফায়ার।” অতঃপর শেষ একটি পরিবার, শেষ একটি সদ্য ফুটে ওঠা ফুলের মতো অবর্নণীয় সুন্দর জীবন আর সে জীবনের কিছু অসমাপ্ত স্বপ্ন।