সহজিয়া জীবনবোধের সহজসরল ও অত্যন্ত সাদামাটা মানুষ ছিলেন বাউল শাহ খোয়াজ মিয়া চিশতী। লোভ লালসায় থেকে নিজেকে রেখেছিলেন আড়াল করে। সিলেট মৌলভী বাজার, সুনামগঞ্জ এমনকি বাংলার আনাচে-কানাচে গেয়েছেন জীবনের গান। গানকে পুঁজি করে খোঁজেছেন আপন সত্ত্বাকে,নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন স্রষ্টার নৈকট্যলাভের আশায়। ইহকালে থেকে সদাসর্বদা পরকালের চিন্তাভাবনা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। তিনি তাঁর একান্ত সহজিয়া ভাষায় লিখেছেন,
'আমার ভয় লাগিলো মনে রে
ভয় লাগিলো মনে
কোন দিন ধরিয়া নিবে জমে..
*তিনি সর্বদা চিন্তা করতেন এই ধরনীর মায়া ভুলে একদিন চলে যেতে হবে। তাঁর অন্তরে সার্বক্ষণিক এই চিন্তা বিরাজমান ছিলো।
তিনি লিখেছেন,
'মানিবে না দোহাই দিলে
আল্লাহ নবীর নামে রে
কোন দিন ধরিয়া নিবে জমে '
*এখানে তিনি পবিত্র কোরআন থেকে একটি আয়াতের সরলার্থ ব্যবহার করেছেন ' আল্লাহ বলেছেন- কুল্লু নাফসিন যা_ইক্বাতুল মউত' প্রতিটি প্রাণির মৃত্যুর স্বাধ গ্রহণ করবে। এমন একদিন সামনে আসবে আপনার /আমার সকলের জন্য যেদিন ডাক্তার কবিরাজ ওঝা এমনকি স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দোহাই দিলেও মৃত্যু নামের জমের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না।কেনোনা এই মৃত্যুটা স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পূর্বনির্ধারিত ফয়সালা। তাই কবি লিখেছেন-
'মানিবে না দোহাই দিলে
আল্লাহ নবীর নামে রে
কোন দিন ধরিয়া নিবে জমে।
সংসার নামের মায়াজালে বন্দী হয়ে কবি লিখেছেন -
'জমের বাড়ি জমের পুরী
আগে কে'বা জানে -?
আগে জানলে আসিতাম না
এই'না ধরাধামে রে... '
এই সংসারটাকে কবি বলেছেন 'জমের বাড়ি' আর এই সংসার নামের মায়াজালকে কবি বলেছেন 'জমেরপুরী'। কবি সহজভাবে বুঝিয়েছেন এই সংসার নামের মায়াজালে বন্দী হবো জানলে, এই ধরাধামে আসিবার ইচ্ছা কখনো প্রকাশ করিতাম না। তবুও এসেছি যেহেতু সেহেতু চিরদিন থাকার একটা প্রবল ইচ্ছাও প্রকাশ করেছিলেন কবি।
কবি লিখেছেন-
চিরদিন থাকিব ভবে
আশা ছিলো মনে
আমার আশা ছিলো মনে
এখন দেখি শক্তি সাহস
দিনে দিনে কমে রে..
কোন দিন ধরিয়া নিবে জমে '
কবি তাঁর ইচ্ছা ও আকাঙ্খা নিয়ে বলেছিলেন 'চিরদিন থাকিব ভবে - আশা ছিল মনে
এখন দেখি শক্তি সাহস দিনে দিনে কমে রে ।
এই মায়াজালে বন্দী হয়ে কবির কিছুটা ভালোও লেগেছিলো তিনি ভেবেছিলেন হয়তো চিরদিন থাকা যাবে! কিন্তু নিয়তির ফয়সালা তাই রুপ যৌবন শক্তি সাহস দিনে কমতে শুরু করেছে।কবি বিশ্বাস করতেন এই ধরনীও একদিন থাকবেনা, থাকবেনা আকাশ বাতাস সাগর নদী, পাহাড়পর্বত। সকল কিছুই একদিন একটি বিকটধ্বনীতে ধ্বংশ হয়ে যাবে।
কবি লিখেছেন -
মরন সুধা পান করিবে -তামামও আলমে
খোয়াজ কয় আল্লাহু আল্লাহ জপো দমে দমে রে
কোন দিন ধরিয়া নিবে জমে।
কবি তাঁর রচনায় তুলে ধরেছেন সেই বেদনাময় দিনের কথা, বলাবাহুল্য 'তামাম ও আলম' দুটি আরবী শব্দ -তামাম/পুরো।আলম/ধরনী বা পৃথিবী।
এমন একটি দিন আসবে একটি হুংকারে পৃথিবীর সকল কিছু চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। যে যে অবস্থায় আছে সে সেই অবস্থায় কিয়ামতের ময়দানে উপস্থিত হবে। সেদিন সবাই ভুলে যাবে পরিবার, সন্তান, মা, বাবা,স্ত্রী -কন্যা। কেউ কাউকে চিনবে না। সেদিন একটি নামই নিজেকে রক্ষার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে যা হলো 'ক্বালবের জিকির 'আল্লাহু আল্লাহ 'কবি সকলের কাছে একটাই নিবেদন করে গেছেন এবং শিখিয়ে গেছেন 'ক্বালবের জিকির 'আল্লাহু আল্লাহ। কবি লিখেছেন-
'খোয়াজ কয়আল্লাহু আল্লাহ
জপো দমে দমে রে..
কোন দিন ধরিয়া নিবে জমে।
চিন্তা করা যায়-? একজন কবির ভাবনাচিন্তা কতটুকু প্রখর। আকিদাহ ও একত্ববাদে কতটুকু একনিষ্ঠ বিশ্বাসী। একসাথে দীন ও দুনিয়া নিয়ে এতো নিগুঢ় চর্চা। তাঁর সহজিয়া ভাষায় জাতির কাছে তুলে ধরেছেন 'ইসলামের অমিয় বাণী'। দেখিয়ে দিয়েছেন স্রষ্টার নৈকট্য লাভের মহৌষধ 'ক্বালবের জিকির ' এর চেয়ে সহজভাবে বুঝানো আর কি হতে পারে-?
কবির রচনাসমগ্রের মধ্যে সবচেয়ে বহুল জনপ্রিয় কিছু গান--
১। আমার ভয় লাগিলো মনে
২! আমার বন্ধু মহা যাদু জানে
৩! আমার বাড়ি আয় রে বন্ধু - আমার বাড়ি আয়
এছাড়াও কবির অসংখ্য জনপ্রিয় রচনা রয়েছে।
কবি'র প্রথম প্রকাশিত বই 'গীতবিচিত্রা'-১৯৯১সালে।
দোয়া করি, আল্লাহ যেন শ্রদ্ধাভাজন গুণিজনকে জান্নাতুল ফেরদাউসের বাসিন্দা করেন। আমীন।।
