সম্পর্কের বিচারে পৃথিবীর মধুরতম শব্দটি হচ্ছে মা, জন্মদাত্রী, জননী। জননকুলের মাঝে শ্রেষ্ঠ কে? কারা? এই প্রশ্নের হৃদয় জুড়ানো উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় জগৎ সেরা এগারো জন অসাধারণ মায়ের অনবদ্য জীবনের আখ্যান 'জননীদের জীবনকথা'য়। লেখক মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ তার 'জননীদের জীবনকথা' বইটিতে মূলত হজরত মুহাম্মদ (স.) -এর ১১জন স্ত্রী অথার্ৎ উম্মত জননীগণের জীবন-যাপন, বিবাহ, দাম্পত্য জীবন এই বিষয়গুলো খুব সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন। লাল টকটকে কভারে কালো পাতায় জ্বলজ্বল করা এগারোটি সোনালী ফুল হয়তো সেই এগারো উম্মত জননীকেই নির্দেশ করে।
ভালোবাসা ছাড়া অনুসরণ প্রবৃত্তি প্রত্যক্ষ করা যায় না। যেতে পারে না। একটি কবিতায় বলা হয়েছে,
"যে জন যাহার প্রেমে নিমজ্জিত হয়
সেজন তাহার বাধ্য হইবে নিশ্চয়।"
প্রিয়তমজনকে তো ভালোবাসতেই হবে, তার সঙ্গে তিনি যাঁদেরকে ভালোবাসেন এবং তাঁকে যাঁরা ভালোবাসেন তাদেরকেও ভালোবাসতে হবে। ভালোবাসার পূর্ণ ও প্রকৃত রূপ এরকমই। তাই আমাদেরকে পৃথিবী ও পরবর্তী পৃথিবীর কল্যাণ লাভ করতে হলে আমাদের প্রিয়তম নবীকে যেমন ভালোবাসতে হবে, তেমনি ভালোবাসতে হবে তার প্রেমিক ও প্রেমাস্পদ গণকে। এ বিষয়টি সুপ্রমাণিত যে, মহানবী স. তাঁর সন্তান-সন্ততিগণ, জীবনসঙ্গীগণ এবং সহচরগণকে অত্যধিক ভালোবাসতেন। অতএব তাদেরকেও ভালোবাসতে হবে। তারা আসত্তা রসুলপ্রেমে চিরনিমজ্জিত। পবিত্র জীবনের অধিকারী ছিলেন তারা। মহানবী স. এর জীবনসঙ্গীগণকে তাই বলা হয় পবিত্র সহধর্মিণীগণ।
বইটির প্রথমেই বর্ণিত হয়েছে মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. এর সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান জীবনসঙ্গী, মহাসম্মানিতা উম্মতজননী হজরত খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ রা. এর কথা। আল-আমীন উপাধি ধারী মহানবী স. তৎকালীন আরবে বিত্তশালী নারী
হজরত খাদিজা রা. এর বানিজ্য বহরে যোগদান করেন। ঘটনা পরম্পরায় মহাপুরুষের স্বভাব-বৈশিষ্ট্যের পবিত্র বিবরণ স্থায়ীভাবে জমা হয় তার পবিত্রতাপিয়াসী অন্তরের গভীরতম কেন্দ্রে। বোন হালার পরামর্শে সহচরী নাফিসা কতৃক প্রেরিত প্রস্তাবে মহানবী স. নীরব সম্মতি জ্ঞপন করেন। খুশি হন তার অবিভাবকবৃন্দ। নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয় পঁচিশ বছরের পবিত্রতম এক যুবকের সঙ্গে চল্লিশ বছরের এক পূত পবিত্রা নারীর শুভবিবাহ।
হজরত খাদিজা রা. মহানবী স.এর ভালোবাসা এবং সঙ্গ পেয়েছেন সবচেয়ে বেশী। তিনিই নবিপ্রিয়াগণের মধ্যে প্রথম ও প্রধান। দীর্ঘ পঁচিশ বছরের সুখ-দুঃখ তিনি সমান ভাগে ভাগ করে নিয়েছেন। অন্তরের গভীর ভালোবাসা ও সমবেদনা দিয়ে খেদমত করেছেন স্বামীর। যত্ন নিয়েছেন স্বামীর প্রিয়জনদের। ওহী অবতীর্ণ হলে, তিনিই প্রথম বিশ্বাসীনী ছিলেন। মহানবী স. এর সঙ্গে প্রথম নামাজ পাঠ করার সৌভাগ্যও তার। প্রথম নবুয়ত প্রাপ্তির সময় তিনিই ছিলেন মহানবী স. এর জীবনসঙ্গী। মহানবী স. এর জীবনে যুক্ত হবার পর তিনি যেমন তার ধনসম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দেন, তেমনি ইসলাম প্রচারের সূচনালগ্নে মহানবী স. এর ওপর হওয়া অত্যাচার ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ তার হৃদয়কে রক্তাক্ত করে। তিনি আঘাতে আঘাতে পাথর হয়ে যান কিন্তু ভেঙে পরেন না। প্রিয়তম নবী ও স্বামীকে সান্ত্বনা দেন। ইবনুল আসীর বলেন, "এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত এই যে, হজরত খাদিজা আল্লাহর সৃষৃটিজগতের মধ্যে সর্বপ্রথম মুসলিম।" (পৃ.৪৩)
হজরত ইবনে আব্বাস থেকে আবু দাউদ, নাসাঈ এবং হাকেম বর্ণনা করেছেন, "বেহেশতিনীগণের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মর্যাদাশালিনী খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ এবং ফাতেমা বিনতে মোহাম্মদ স.। (পৃ.৪৪)
তিনি স. তাঁর পূর্বে ও জীবদ্দশায় দ্বিতীয় বিবাহ করেননি। জীবনসঙ্গিনী হিসেবে ছিলেন সর্বোত্তমা। তাকে হারিয়ে মহানবী স. শোকাতুর হয়ে পরেন। মাতা মহোদয়া আয়েশা রা. বলেছেন, " আমি খাদিজাকে দেখিনি। তবু তার প্রতি অন্তর্জ্বালা অনুভব করতাম। তার অন্য স্ত্রীদের প্রতি এরকম করতাম না। কারণ, রসুলুল্লাহ স. তাঁর কথা খুব বেশী বলতেন। একদিন আমি রাগান্বিত হলাম। বললাম, ওই অধিক বয়স্কা নারী তো বিগত হয়েছে কবেই। আপনার ঘরে তো এখন রয়েছে অধিকতর উত্তমাগণ। আমার একথা শুনে তিনি স. রেগে গেলেন। আমি অনুতপ্ত হলাম। তিনি স. আমার মনোভাব বুঝতে পেরে বললেন, আয়েশা! তুমি এভাবে আর কথা বলো না। মানুষ যখন আমাকে প্রত্যাখান করেছে, সে তখন আমাকে দিয়েছে আশ্রয়।" (পৃ.৪৪-৪৫)
সুখ ও শোক-এ দুটো ডানা নিয়েই জীবন পাখি ওড়ে। এভাবেই সময় হারিয়ে যায় মহাসময়ের অন্তহীন আকাশে। এ নিয়ম অনিবার্য, অনড়। 'প্রতিটি জীবনকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়' -এই মহাবাণীটিও অলঙ্ঘনীয়। সকল ক্ষেত্রে। সর্বত্র। খাদিজা রা. এর প্রয়াণে নবীজীবন শুধু বেদনাবিধুর। শোকাতুর। তাঁর সংসার এখন ঝড়ে বিধ্বস্ত পাখির নীড়ের মতো বিপর্যস্ত। দ্বিতীয়বার পরিগ্রহণ করবেন এরকম ভাবনা মহানবী স. এর হৃদয়ে কখনোই স্থান পায়নি। একথাও কখনো উদয় হয়নি যে, জীবন কখনো খাদিজাবিহীন হবে। তাই তো হলো। প্রয়োজন আজ গৃহদ্বারে এসে দাঁড়িয়েছে। এমন সময় মহানবী স. এর মাতৃস্হানীয়া খাওলা বিনতে হাকীম আসেন বিহাহের দুটি প্রস্তাব নিয়ে। একজন সওদা বিনতে জামআ। আর একজন মহানবী স. এর বাল্যবন্ধু ও সার্বক্ষণিক সহচরের কন্যা আয়েশা। মহানবী স. মৌন সম্মতি জানালে প্রথমে হজরত সওদার সাথে অনাড়ম্বর ভাবে বিবাহ সম্পন্ন হয়। উল্লেখ্য যে মিরাজের সময় সওদা রা. ছিলেন নবিজির একমাত্র জীবনসঙ্গী।
হজরত সওদাকে বিবাহ করার অল্প কিছুদিন পরে হযরত আয়েশাকে বিবাহ করেছিলেন মহানবী স.। তখন হযরত আয়েশার বয়স ছিলো মাত্র ছয় বছর। তাই তিনি স. তাঁকে পিতৃগৃহেই রেখে দিয়েছিলেন। মদীনায় যখন আনলেন, তখন তার বয়স হয়েছে নয় বছর। মহানবী স. মাত্র নয় বছরের এই উম্মতজননীকে নিয়ে সংসার শুরু করলেন। হজরত মুহাম্মদ স. এবং মাতা আয়েশা রা. এর মধ্যকার খুনসুটি, ছোটছোট হাস্যরসাত্বক ঘটনাবলি, সর্বপরি তাদের দাম্পত্য জীবনের বর্ণনা যেকোনো পাঠকের হৃদয়ে রোমান্টিকতার সঞ্চার করে। মাতা মহোদয়ার খেলার সাথী আসমা বিনতে ইয়াযিদের বর্ণনানুসারে তাদের বিবাহ বাসরের দিনের একটি বর্ণনা এমন, "আমিই তাকে বধূবেশে রসুলুল্লাহর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন রসুলল্লাহর সামনে এক পেয়ালা দুধ ছাড়া অন্য কিছু উপস্থিত করতে পারিনি। তিনি স. পেয়ালা হাতে নিয়ে এক চুমুক পান করলেন। তারপর পেয়ালাটি এগিয়ে দিলেন আয়েশার দিকে। সে লজ্জায় আধোবদন হয়ে ছিলো। আমি বললাম, রসুলুল্লাহর দান ফিরিয়ে দিয়ো না। সে পেয়ালাটি হাতে নিলো। সামান্য পান করলো।"(পৃ.৭৫)
হযরত আয়েশা রা. এবং রসুলল্লাহর বিবাহের মাধ্যমে ভ্রাতিসম্পর্কীয় কারো মেয়েকে বিয়ে না করা, শাওয়াল মাসে বিবাহ অশুভ, নববধূকে দিনের বেলা ঘরে আনা যাবে না এরকম প্রচলিত কুসংস্কার গুলোর অবসান ঘটেছিলো। খেজুর পাতার তৈরি ছাদ এবং কাঁচা ইটদিয়ে তৈরি ছোট্ট একটি ঘরে মাত্র কয়েকটি আসবাবপত্র নিয়ে আয়েসা রা. এর সংসার জীবন শুরু হয়। রাতে ঘরে আলো জ্বলে না। অথচ এই গৃহই সকল আলোর উৎস। তিনি বলেছেন, " নবী পরিবারের লোকেরা একাধারে তিনদিন পেটপুরে খেয়েছেন, এরকম ঘটনা কখনো ঘটেনি। মাসের পর মাস রান্নার আগুন জ্বলতো না। খেজুর ও পানির উপরেই দিন গুজরান করতে হতো।" (পৃ. ৭৬)
হজরত আয়েশা খুবই বুদ্ধিমতী হলেও বয়স কম হওয়ার কারণে সাংসারিক কাজে কিছু ভুলত্রুটি হয়ে যেতো। যেমন, একদিন মহানবী স. নামাজে ছিলেন, এদিকে তার দুচোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে আসে। এই সুযোগে প্রতিবেশীর একটি ছাগল এসে তার নিজ হাতে ছানা আটার রুটিগুলো খেয়ে চলে যায়।
আল্লাহ্পাক এরশাদ করেন "আর তাঁর এক নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনীগণকে, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে মানবিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।"(পৃ. ৭৭)
মহানবী স. যে এই পবিত্র আয়াতের প্রকৃত মর্ম সবচেয়ে বেশী বুঝতেন। তিনি স. তাঁর সংসারজীবনকে ভরে তুলেছিলেন অনাবিল আনন্দে, প্রেমে-প্রীতিতে ও ভালোবাসায়। তার কিশোরী বধূকে তিনি স. কতো ভাবে যে আনন্দ দান করতেন, তা গণনা করা দুরূহ। তিনি স. বলেছেন, "তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে তার স্ত্রীর নিকটে সর্বোত্তম। আমি আমার স্ত্রীদের নিকট তোমাদের সকলের চেয়ে উত্তম।" (পৃ. ৭৭)
স্বামী-স্ত্রী উভয়ে উভয়কে তুষ্ট রাখবে- এটা দাম্পত্য জীবনের একটি প্রধান দায়িত্ব। মহানবী স. এবং তার সকল সহধর্মিণী এ ব্যাপারে ছিলেন সদা-সচেতন। হজরত আয়েশা তার অন্যান্য সপত্নীদের চেয়ে বয়সে ছোট ও কুমারী ছিলেন বলে মহানবী স. তাঁর সাথেই হাস্য-কৌতুক করতেন বেশী। তাঁর খেলাধুলাকেও প্রশ্রয় দিতেন। তার কিশোরসুলভ কথাবার্তা শুনে আনন্দিত হতেন। কখনো কখনো গল্পও শুনতেন তার। মহানবী স. হজরত আয়েশার মনোরঞ্জনের জন্য তাঁর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতাও করেছেন। হযরত আয়েশা সিদ্দীকাও মহানবী স.কে খুব ভালোবাসতেন। নবীপ্রেম ও স্বামীপ্রেম একাকার হয়ে সারাক্ষণ তাঁর হৃদয়কে আলোকিত করে রাখতো। স্বামী-বিচ্ছেদ তিনি সহ্য করতে পারতেন না। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে শয্যায় স্বামীকে না পেলে অস্থির হয়ে পড়তেন। অন্ধকার ঘরে খুঁজতে চেষ্টা করতেন। "একবার তাকে হাতের কাছে না পেয়ে ভাবলেন, তিনি স. হয়তো তার অন্য স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন। একটু পরে তাঁর ভুল ভাঙলো। দেখলেন, আল্লাহর রসুল ঘরের এককোণে বসে তসবিহ্ পাঠে মগ্ন।"(পৃ.৭৯)
বলাবাহুল্য, হজরত আয়েশার ঈর্ষা ছিলো পবিত্রতারই প্রেমময় এক রূপ। ছিলো নবীপ্রেমের সুগভীর ও সুতীক্ষ্ণ এক প্রকাশ। মহানবী স. এর সঙ্গে তাঁর মান-অভিমানের মাত্রা কখনোই শ্রদ্ধাময় ভালোবাসার বৃত্তবহির্ভূত হতে পারতো না।
মহাসম্মানিতা এই উম্মতজননী রসুলল্লাহ’র সাথে যুদ্ধযাত্রাও করেছিলেন। একবার মুনাফিকরা উম্মতজননী আয়েশা সম্পর্কে এক জঘন্য অপবাদ রটিয়ে দেয়। মাতা মহোদয়া এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না। তিনি রসুলল্লাহ’র মুখ ভার এবং তার সঙ্গে তেমন কথা না বলায় অভিমান করে অনুমতি সাপেক্ষে পিতৃগৃহে যান। এসময় তিনি অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন। একদিন রাতের বেলা মেসতাহ্ ইবনে উসামার মায়ের কাছ থেকে এ বিষয়টা জানতে পারেন। এ ঘটনা জেনে মাতা মহোদয়া ভেঙে পরলেন। প্রায় একমাস ধরে মিথ্যা অপবাদের বাতাস মদীনা মুনাওয়ারাকে কলুষিত করে রাখলো। রসুলুল্লাহ্ অবর্ণনীয় মানসিক যাতনায় কষ্ট পেতে লাগলেন। রসুলল্লাহ এক মাস পর আয়েশা রা. এর কাছে গেলেন এবং বলেন, " শুনছো তো সবকিছু। তুমি যদি নিষ্পাপ হও, তাহলে আশা করি আল্লাহ তোমার নিষ্পাপত্ব প্রকাশ করে দিবেন।" (পৃ.৮৫)
তৎক্ষনাৎ আয়াত অবতীর্ণের মাধ্যমে আল্লাহ্ হযরত আয়েশা রা. কে পবিত্রা ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে এই ঘটনা নিয়েও খুব স্বল্প সময়ের জন্য তাদের মাঝে মান-অভিমানের পালা চলে। আবার মিটেও যায়।
আরব সমাজে জীবন ও কবিতা ছিলো অবিচ্ছেদ্য। তাঁদের মুখে কবিতা আবৃত্তি হতো সুখে-দুঃখে-শোকে, এমনকি যুদ্ধের সময়েও। হযরত আয়েশা বলতেন, "তোমরা তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের কবিতা শেখাও। এতে করে তাদের ভাষা সুন্দর হবে।" (পৃ.১০৩)
হযরত আয়েশা রা. নিঃসন্তান ছিলেন, কিন্তু কখনোও তাদের দাম্পত্য জীবনে এর প্রভাব পরে নি। তিনি নবীজির অন্য সন্তানদের মাতৃস্নেহে আগলে রাখতেন।
শুরু হয় বিজয়ের পর বিজয়। বিভিন্ন জনপদের মানুষ ক্রমে ক্রমে ইসলামের অনুগত হতে থাকে।উম্মতজননীগণের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বিভিন্ন কারণে, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে কেবল ইসলামের অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গকে উজ্জ্বল, উজ্জ্বলতর করবার জন্যই আল্লাহপাকের নির্দেশানুসারে মহানবী স. কে বিবাহ করতে হয়। হযরত আয়েশা ও হজরত সওদার ঘরের পাশে একই মাপের কাঁচা ইটের ঘর নির্মিত হতে থাকে। সে ঘরগুলোতে একে একে এসে ওঠেন হজরত হাফসা, হজরত যয়নব বিনতে খুযায়না, হজরত উম্মে সালমা, হযরত যয়নাব বিনতে জাহাশ, হজরত জুওয়াইরিয়া, হজরত উম্মে হাবীবা, হজরত সাফিয়া এবং হজরত মায়মুনা রদ্বিআল্লাহ তায়ালা আনহুমা।
হজরত হাফসার জ্ঞান চর্চার প্রতি আগ্রহ দেখে মহানবী স. তাঁর লেখাপড়ার সুযোগ করে দেন। শিক্ষাদানের জন্য নিযুক্ত করেন শিফা বিনতে আবদুল্লাহ্ নামের এক সাহাবীয়াকে। আরেক মাতা মহোদয়া হজরত যয়নব বিনতে খুযায়না একমাত্র মহানবী স. এর ইমামশোভিত নামাজে জানাযা পেয়েছেন। হজরত উম্মে সালমা শুধু রূপসী নন, লজ্জাবতীও। এই নিয়ে প্রথম প্রথম কিছু সমস্যা হলেও পরবর্তীতে অন্যান্য মুমিনজননীগণের মতো তিনিও চিরতরে হারিয়ে গেলেন আল্লাহর হাবীবের অনন্ত প্রেমসমুদ্রে। উম্মতজননী হজরত যয়নাব বিনতে জাহাশ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এবং মহানবী হজরত মুহাম্মদ স. এর মধ্যে আল্লাহ্পাক স্বয়ং শুভবিবাহ সম্পন্ন করে দিয়েছেন। সাক্ষী করেছেন জিব্রাইল আমিনকে। খুব ঘটা করে বিবাহোত্তর প্রীতি ভোজের আয়োজন করা হয়। মহানবী স. তার অন্য বিয়েগুলোতে এরকম করেননি। হজরত যয়বাব রা. কখনো কখনো অন্য রসুলজায়াগণকে লক্ষ্য করে বলতেন, "তোমাদেরকে বিয়ে দিয়েছেন তোমাদের অবিভাবকেরা, আর আমার বিয়ে দিয়েছেন সাত আকাশের উপর থেকে স্বয়ং আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালা।" (পৃ.১৭০)
উম্মতজননী হজরত জুওয়াইরিয়া বিনতে হারেছ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার কাছেই জানা গেছে "নফল রোজা রাখতে গেলে যে পরপর দু'টি রোজা রাখতে হয়" - বিষয়টি। এর পরেই বর্ণিত হয়েছে উম্মে হাবীবা বিনতে আবু সুফিয়ান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার কথা। মহানবী স. এর অন্যান্য সহধর্মিণীগণের মতো হজরত সাফিয়াও ছিলেন এলেম ও মারফতের কেন্দ্র। তিনি ইহুদি থেকে মুসলিম হয়ে সহাসম্মানিতা উম্মতজননী হবার গৌরব অর্জন করেছেন। নবিজীর সর্বশেষ স্ত্রী হজরত মায়মুনা বিনতে হারেছ রা. এর পরিচ্ছেদটি পড়ে অনেক কুসংস্কার এবং দ্বিধাগ্রস্ততার অবসান ঘটে। ঋতুবতী স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর স্বামী কীরূপ আচরণ করবে, সে সম্পর্কে শরীয়তের বিধান আমরা তার কাছ থেকেই পেয়েছি। "তার ঋতুগ্রস্ত অবস্থাতেও মহানবী স. তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতেন।" (পৃ. ২১৪)
প্রায় সব নবীজায়াগণই নবীজির সাথে বিবাহের পূর্বে স্বপ্নে এ বিষয়ে ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। সব বিবাহতেই সামঞ্জস্যপূর্ণ মোহরানা ধার্য এবং পরিশোধ করা হয়েছে। সামর্থ অনুযায়ী কখনো খেজুর দিয়ে কখনো মাংস-রুটি দিয়ে ওলীমা অর্থাৎ বিবাহোত্তর প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয়েছিলো। সকল উম্মতজননীগণের থেকেই কমবেশি হাদিস বর্ণনা পেয়েছি আমরা। তাদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা থেকে পাওয়া যায় পর্দা প্রথার বিধান। সাদামাটা জীবন-যাপন ও ইসলামের প্রচারে-প্রসারে তাদের জীবনসংগ্রাম এবং অসামান্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ভোলার নয়। তারা সকলেই সাধ্বী, শুভ্র ও পবিত্র। তাই সকলেই প্রীতিময় পরিবেশে মহানবী স.কে ঘিরে রাখেন শান্তি -সান্ত্বনা ও সুগভীর প্রেম-ভালোবাসা দিয়ে। নিঃসন্দেহে তাদের জীবনযাপন যে কারোর জন্য অনুকরণীয় আদর্শ।
বই সমাচার:
বই: জননীদের জীবনকথা
লেখক: মামুনুর রশীদ
প্রকাশক: হাকিমাবাদ খানকায়ে মোজাদ্দেদিয়া
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি, ২০২১ইং
প্রচ্ছদ: সাবৃনা
বিনিময় মূল্য: ১৭০৳
পৃষ্ঠা: ২১৭
ISBN: 984-70240-0064-3
~ ~ ~ ~ ~ ~ ° ~ ~ ~ ~ ~ ~
- গ্রন্থালোচনায়:
মোছা. নুসরাত জাহান
শিক্ষার্থী, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ
সম্মান ৩য় বর্ষ (ইংরেজি বিভাগ)
রাজারহাট, কুড়িগ্রাম
মেইল: nusrat9875jahan@gmail.com