নিখিল বিশ্বের তামাম জনপ্রাণ
শূণ্যে বিভোর থেকে-ই পার হয় জীবন।
মনের আকুতি কেউ বুঝতে চায় না
কেউ বুঝতে চায়নি চোখের কোণে
শুকিয়ে থাকা অবলা এক নিষ্ফলার কান্না।
নদী ঘেঁষেই ঘর বসতি যে আমার
নদীর কোলে-পিঠেই চলে যে জীবন।
জলের ঢেউয়ে ভাঙন আসে
আবার জাগিয়ে তোলে বিশাল চর।
আমি নদীর মতই নিজেকে নিয়ে খেলি
আমার আমিকে ভাঙি আর গড়ি
যেমন চলে খেয়ালি নদীর ভাঙন-গড়ন।
শীত, গ্রীষ্ম আমার ভালোই চলে
নদীর বুকে জাল ফেলে দিন-রাতে
চুনো-পুঁটি প্রায় দিনই মেলে
আর মাঝে মাঝে আচমকা স্রোতে
রুই কাতলা আর বোয়ালও ধরা পড়ে।
আষাঢ় শ্রাবণ আর ভাদ্র-আশ্বিনে
নদী দেবী রূপ ছেড়ে সাজে ঘনঘোরে।
ধ্বংসস্তুপের লীলা বেয়ে
হাজির হয় কালীর ছায়া নিয়ে।
মুহুর্তের জলরাশি এসে ভাসিয়ে ডুবিয়ে
ঘরবাড়ি আর স্থাবর-অস্থাবর
সব নিয়ে যায় আমাকে শূণ্য করে।
তবে আমাকে শূণ্য করা!
নয়তো এতো সরল-সোজা।
আমি অধম বারে বার ভাঙি
আর উঠে দাঁড়াই তৎক্ষণাৎ
নিজের হাতেই নিজের কপাল গড়ি।
দু'হাত শক্ত করে নৌকার বৈঠা ধরি
ঢেউয়ের তালে খেলতে থাকা
নদীর জলের সাথে খেলি।
আমি যে নদীর ধারে বসত করি
এইখানে প্রায় প্রতিবছর-ই বেশ
বানের পাল্লা থাকে ভারী।
বান কি আর সাধে আসে?
না গো মশাই। আসেনা।
নদীর পাড় ঘেঁষে আছে বিশাল এক বাঁধ
তা তো উঁচু হবেই দুই মানুষ সমান।
বাঁধ ভাঙলেই বাণ আসে
প্রথমে হাঁটু আর তারপর কোমরে
তারপর কখন যে পানি বুকের উপরে
সেটা আর আমরা ঠিক পাই নে।
মাথার উপরের ছাদনা খানা
বানের জলে নেয় ভাসিয়ে
দূর অজানার ভাটির টানে।
এইবার আর রক্ষে ছিলো না।
যেমন উপরের ভগবান
তেমন তার নিচের লোকমান।
লোকমান সাহেব সে-ই-তো সেবিছে মোদের
সে-ই-যে চেয়ারমান এই চৌদ্দ গ্রামের।
থাক গে সেসব কথা।
জেলে মুখে তাকে নিয়ে বলা
সে যে মিছে মিছে খেলা।
বাঁধ ভাঙলো, বান আসলো
আমার যা ছিলো পানির তলে গেলো।
বানের পানিতে যখন আটকে ছিলাম
প্রতিদিনই তিরাণ প্যাকেট প্যাকেট পেলাম।
ঐ যে চোর-ছ্যাচ্চড় লোকমান
ও বেটাও এসে দিয়েছিলো তিরাণ।
বানের জল বেশিদিন থাকেনা।
মাটির ফুটো পেলেই চলে যায়।
ক'দিন বাদে নদীতেই আবার নামে
ডাঙা করে রেখে যায় আবাস ঠিকানা।
ভাঙনের পরে আবার সেজেগুজে
শুরু করি জীবন তরী বাওয়া
সম্মুখের দেবী আর অদৃশ্যের দেবীর পায়ে পড়ে
সিক্ত আর রিক্ত হস্তে অবনত মস্তকে প্রগাঢ় প্রণাম করে।
জীবন যখন চলে নতুন হালে
তখন আসে বাড়ির পরে মহাজ্বালা।
কাজের চাপে প্রাণ যায়
বাড়িতে হাজির গবেষকের দল।
দেশী লোক আসে, লোক আসে বিদেশের
বেসরকারী লোক আসে, আসে লোক সরকারের।
সব বাড়ি ঘুরে ঘুরে বসিয়ে চোখের সামনে
আয় কত! ব্যয় কত! কত! ক্ষতি গেছে
কত! সম্পদ গেছে, এই বন্যাতে।
জিগায় যা আমি বলি তা
পকপকিয়ে তোতা পাখির মত।
আয়টা একটু কমিয়ে ব্যয়টা বলি বেশ বাড়িয়ে
গবেষকগণের প্রশ্ন শুনি বড় আক্ষেপের স্বরে।
মনে মনে বলি আমি
ঝেড়ে সব ভয় ভীতি।
শুয়োরের বাচ্চারা ক্ষতির হিসেব মারাও!
অংকের হিসেব কষ, কত ক্ষতি! কত ক্ষতি!
আমার বারো বছরের ছেলে গেছে ভেসে
দুধওয়ালা গাইটা মরে গেছে
আমার চলার নৌকাটাও গেছে ভেসে
এইবারের বেখেয়ালি বানে।
গবেষক সাহেব, অংকের হিসেব ভালোই বোঝেন
আবেগ বোঝেন? আবেগ?
চোখের জলের দাম বোঝেন? চোখের জলের?
পুত্র যখন মরে ভেসেছিলো জলে
সেই সময়ের কষ্টের কথা শুনবেন না?
কত চোখের জল গেছে বাণের মত।
আমার স্বপ্ন গেছে, আমার সম্পদ গেছে
এর কি কোনো ক্ষতিপূরণ মেলে!
তো মশাই? আমার মনের ব্যথা
চোখের জল আর নির্ঘুম চোখের পাতায়
যা ছিলো ভালো বানের আগে -
সেসবের হিসেব নিবেন না?
তো বলি বাবু? আমাদের কথা বেচে
কত কামাবেন আমাদের লোকমানের মত?
চেয়ারম্যান লোকমান রোজ রোজ হররোজ
আমাদের দস্তখত বেচে দিনরাত।
মনের কথা নিয়ে হয়না তো গবেষণা
মনেরই যন্ত্রণা কেউ তো বোঝেনা!
আছে কী কোনো যন্ত্র?
চোখের জল মাপার।
আছে কী কোনো মন্ত্র?
মনের ব্যথা বোঝার
হৃদয় ভাঙার যে আর্তনাদ
বোঝেনা কোনো জরিপদার।
চোখের জলের ব্যথা
বোঝে নাকো কোনো ‘রিসার্চার’।
আসিফ ইকবাল আরিফ
সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাককানইবি, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।