বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গানবৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বানযদি ডেকে বলি, এসো হাত ধরোচলো ভিজি আজ বৃষ্টিতেএসো গান করি মেঘ মল্লারেকরুনাধারা দৃষ্টিতেআসবে না তুমি; জানি আমি জানি... "
সত্যিই,
আজ এ বাদলা দিনে যতই ডাকি, জানি আর আসবে না ফিরে, বাঙলা সাহিত্যের কৃতি
পুরুষ হুমায়ূন আহমেদ। ১৯ জুলাই ২০১২ সালের এমনই এক বাদলা দিনে চলে গেলেন
সাহিত্যের এ বরপুত্র। আজ প্রিয় সাহিত্যিকের অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকীতে
কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করছি। আধুনিক বাংলা কথা
সাহিত্যকে পাঠকের কাছাকাছি পৌঁছে দিতে, বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আহমেদের
অবদান অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথের পড়ে বাংলা সাহিত্যের সকল শাখায় এতো
পারদর্শী হুমায়ুন আহমেদ ব্যতিত দ্বিতীয় কেউ ছিলো কিংবা আছে কিনা আমার জানা
নেই। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য নিয়ে লিখতে গেলে শতশত বই লিখতে হবে। যা
আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে সম্ভব নয় বলে, সেই ব্যর্থ চেষ্টা না করে, আমাদের তরুণ
সমাজকে, আজকে যারা সাহিত্য বিমুখ, তাদের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি
আকৃষ্ট করতেই প্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় গানের কথা নিয়ে এই
আয়োজন।
সেই জায়গায় থেকে আমি লেখকের গীতিকবিতা তথা
গানের লিরিক নিয়ে কয়েকটি কথা বলবো বলে আশারাখি। আমাদের বাংলা সাহিত্যের
প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ জন্ম গ্রহণ করেন, ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে।
তিঁনি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের একজন গর্বিত সৈনিক, বাংলাদেশি ঔপন্যাসিক,
ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।
যাঁর, প্রতিটি সাহিত্যকর্মে দেশপ্রেম, প্রকৃতি, মাটি ও মানুষের আবেগ
অনুভূতির কথা উঠে এসেছে৷ একথা এক বাক্যে সর্ব স্বীকৃত, তিঁনি বিংশ
শতাব্দীর জনপ্রিয় বাঙালি কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর প্রকাশিত
গ্রন্থের সংখ্যা যেমন প্রায় তিনশতের কাছাকাছি, তেমনি তাঁর রচিত জনপ্রিয়
গানের সংখ্যা নেহায়েত কম নই। সেখান থেকে দশটি গানে আজ স্মরণ করবো প্রিয়
সাহিত্যিককে।
১.
" একটা ছিল সোনার কন্যা
মেঘ বরণ কেশ
ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ
দুই চোখে তার আহারে কি মায়া
নদীর জলে পড়ল কন্যার ছায়া
এখন তাহার কথা বলি
তাহার কথা বলতে বলতে নাও দৌঁড়াইয়া চলি... "
২
" যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়।
এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে
জল ভরা দৃষ্টিতে
এসো কোমল শ্যামল ছায় ।
যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরি
কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি ।
উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো
ছলকে ছলকে নাচিবে বিজলী আরো
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…।"
৩
" চাঁদনী পসরে কে
আমারে স্মরণ করে
কে আইসা দাড়াইসে গো
আমার দুয়ারে
তাহারে চিনিনা আমি
সে আমারে চিনে
বাহিরে চাঁন্দের আলো ঘর অন্ধকার
খুলিয়া দিয়াছি ঘরের সকল দুয়ার
তবু কেন সে আমার ঘরে আসেনা
সে আমারে চিনে
কিন্তু আমি চিনিনা...।"
৪
" ও আমার উড়াল পঙ্খীরে যা যা তুই উড়াল দিয়া যা
আমি থাকব মাটির ঘরে, আমার চোক্ষে বৃষ্টি পরে
তোর হইবে মেঘের উপরে বাসা
ও আমার মনে বেজায় কষ্ট
সেই কষ্ট ইইল পষ্ট
দুই চোক্ষে ভর করিল আঁধার নিরাশা
তোর হইল মেঘের উপরে বাসা
ও আমার..
মেঘবতী মেঘকুমারী মেঘের উপরে থাক
সুখ দু:খ দুই বইনেরে কোলের উপরে রাখ
মাঝে মইধ্যে কান্দন করা মাঝে মইধ্যে হাসা
মেঘবতী আজ নিয়াছে মেঘের উপরে বাসা
ও আমার উড়াল পঙ্খীরে যা যা তুই উড়াল দিয়া যা
আমি থাকব মাটির ঘরে
আমার চোক্ষে বৃষ্টি পরে।"
৫
"কেন দেখা হবে?
যে থাকে আঁখি পল্লবে তার সাথে কেন দেখা হবে?
নয়নের জলে যার বাস…
সে তো রবে নয়নে নয়নে…
যখন আকাশ কালো হয়,
মেঘবতিদের উড়িবার তখনি সময়।
মেঘেরা উড়া উড়ি করে
বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়ে…
তাহারাও কানে কানে বলে
তার সাথে দেখা হবে কবে...?"
৬
"হাবলঙ্গের বাজারে গিয়া দশ টাকা জমা দিয়া
আনিয়ো কিনিয়া কন্যা মনে যদি চায়;
ও দরদি মনে যদি চায়,
মধ্যরাত্রি দি প্রহরে হাবলঙ্গের বাজার বসে,
যাইতে হবে চুপি চুপি, কথা হবে ঠারে ঠারে
যেন কেউ মুখের কথা শুনিতে না পায়..."
৭
" বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বান
যদি ডেকে বলি, এসো হাত ধরো
চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে
এসো গান করি মেঘ মল্লারে
করুনাধারা দৃষ্টিতে
আসবে না তুমি; জানি আমি জানি
অকারনে তবু কেন কাছে ডাকি
কেন মরে যাই তৃষ্ণাতে
এই এসো না চলো জলে ভিজি
শ্রাবণ রাতের বৃষ্টিতে...। "
আমার দেখা সময়ের সেরা সাহিত্যিক ও গীতিকবি
হুমায়ূন আহমেদ, যিঁনি রবীন্দ্রনাথের পরবর্তীতে বর্ষার বাদলা দিন নিয়ে সবচেয়ে
জনপ্রিয় গান রচনা করেন। তাঁর এসব গান শুনে যেমন আমরা নস্টালজিক হয়ে যায়,
আবেগ আবেগপ্রবণ হয়ে যায়, মরমে প্রিয় জনের প্রিয় শূন্যতা অনুভব করি, তেমনি
এসবই গানেই উঠে এসেছে, প্রেম, প্রকৃতি গায়ের কন্যার রুপ। শুধু তাই নয়,
তাঁর রচিত প্রতিটি গানের কথায় রয়েছে আত্মার খোরাক ও আধ্যাত্মিকতা, যা
আমাদের সহজ-সরল চোখে দৃষ্টিগ্রাহ্য নাও হতে পারে। আমরা হুমায়ুন আহমেদের
গানেই পেয়ে থাকি জোছনা রাতের প্রেমের ছন্দ, প্রিয়জনাকার্ষণ, বৃষ্টিতে ভেজার
পূর্ণতা, অনাদরে ঝরে পড়ার কদমের বিরহী সৌন্দর্য, রুপ-লাবণ্য কিংবা
অকৃত্রিম প্রস্ফুটিত ভালোবাসার বিশুদ্ধ কোমলপ্রাণের ছোয়া।হুমায়ুন আহমেদের
গানের কথা বললে অন্য যেকথাটি বলতে হয়, অনেক শিল্পী, অনেক মানুষও সমৃদ্ধ
হয়েছেন তাঁর ও তাঁর গানের সংস্পর্শে এসে। নিজের সহধর্মিনীর শাওনের কথা বাদ
দিলেও এই তালিকায় আছেন এস আই টুটুল, সেলিম চৌধুরী, মকসুদ জামিল মিন্টু।
এইছাড়াও হুমায়ুনের হাত ধরে গানে আত্মপ্রকাশ অনেকেই কিংবদন্তি হয়েছে, সেইদলে
আছেন, কুদ্দুস বয়াতি বা বংশীবাদক বারী সিদ্দিকীর চিরঞ্জীব শিল্পী।
এইছাড়াও, হুমায়ূন আহমেদ এর সঙ্গে কাজ করেছেন সুবীর নন্দী, সাবিনা ইয়াসমিন,
এন্ড্রু কিশোর, হাবিব ওয়াহিদ, কনা প্রমুখ, যারা আজ স্ব স্ব ক্ষেত্রে
সুপ্রতিষ্ঠিত। এই সব বিবেচনায় বলতে পারি, সাহিত্যের অন্যান্য
শাখা-প্রশাখায় ন্যায় হুমায়ূন আহমেদের রচিত গানসমূহ আমাদের হৃদয়ের পটে রয়ে
যাবে আমৃত্যু। আমি সাহিত্যিকের আরেকটি গানের কবিতা লিখেই শেষ করছি-
" মরিলে কান্দিস না আমার দায়।রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়মরিলে কান্দিস না আমার দায়সুরা ইয়াসীন পাঠ করিও বসিয়া কাছায়।যাইবার কালে বাঁচি যেন শয়তানের ধোঁকায়রে যাদুধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়।................................... কাফন পড়িয়া যদি কান্দো আমার দায়মসজিদে বসিয়া কাইন্দো আল্লা’রই দরগায়।রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়।"
রহিম উদ্দিন,কবি ও প্রাবন্ধিক।