রাত কত হবে? আনুমানিক ১১ টা কিংবা তার বেশি অথবা কমও হতে পারে। মোবাইল এ চার্জ ফুরিয়েছে সেই কবে। গ্রাম বলে কথা ঐযে আকাশে মেঘ দেখে কারেন্ট পালাল আর এলোই না, নতুন করে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। ঘরে জলছে হারিকেনের আলো। ইতিহাস-ঐতিহ্য ধরে রাখা অনেকটাই। চার্জার লাইটের চার্জ ফুরালে যা হয় আর কি!
আজ এই বৃষ্টিতে তোমাকে কেন এত মনে পরে!
জানি না, জানি না!
তুমিও কি আজ স্মর মোরে ওগো প্রিয়.......
আমি জানালায় পাশে দাঁড়িয়ে গুনগুনিয়ে গানের এই চরণগুলোয় বার কয়েক গাইছি। গানটা কার লেখা জানি না । জেনেই বা কি লাভ! তখনো বাইরে শ্রাবণের বৃষ্টি। সে কি বৃষ্টি! আমার জন্ম দিনের মতোই। আম্মু বলেছেন আমাড় জন্ম শ্রাবণের এক বর্ষণমুখর রাতে। এই বৃষ্টিতেই মেঘের ফাঁকে দেখা যায় চাঁদকে। চাঁদ অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে বসুধা পানে। এমন জোৎস্নাঝরা বৃষ্টিতে কার ইচ্ছা হবে না ভিজতে? যাকে বলে জ্যোস্নায় বৃষ্টি বিলাস। আমি দেরি না করে বৃষ্টিতে ভিজব বলে ঘর ছেড়ে বারান্দায় আসতেই আম্মুর ডাক,
এয় ইভা কই যাও?
আম্মু বৃষ্টিতে ভিজব।
কি বলছো? তুমি ভিজবা? যাও রুমে যাও! এত রাতে ভিজা যাবে না সর্দি-জ্বর হবে।
আম্মু, আমি সেই ছোট্ট খুকি নই। জ্বর হবে না।
যা বলছি তাই কর। ঢং দেখে বাঁচি না। বিয়ে দিলে বাচ্চার মা হত, তার আবার রাত দুপুরে বৃষ্টি বিলাস। মন খারাপ করে আবারো ঘরে আসি! এরকম কথা শুনলে মন খারাপই হওয়ার কথা। মা হয়ে মেয়ের মন বুঝে না। কিছুই ভাল লাগছে না। আবারো জানালার কাছে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দেই বৃষ্টির পানি ছুতে। ভিজতে মানা কিন্তু ছুতে তো মানা নেই। মানা করবেই বা কেমন করে। আম্মু তো জানে না আমি .........।
সামনে সদ্য গাছ থেকে পেরে আনা একগুচ্ছ কদমফুল। হঠাৎ চমকে উঠি ভূত দেখার মত। কে যেন বাড়িয়ে ধরল। পিছিয়ে জানালা বন্ধ করব সেই সময় জানালায় দেখি রুহান! এই সব লোকদের বলা যেতে পারে গাধা মানব। গাধার মতো মাথা মোটা লোক। এত রাতে এইভাবে কাউকে চমকে দেয় না কি! রুহানের মাথা বেয়ে পানি গরিয়ে পড়ছে। হাতা গোটা শার্ট ভিজে জবজব। চোখে মুখে পানি। মুখটা বৃষ্টিস্নাত চাঁদের মতোই মায়াময়। যেভাবেই আছে যেন চেয়ে থাকি সহস্র বছর।
ইভা, তোমার জন্য...... আমি হাতটা বাড়িয়েছি। হাতটা কাঁপছে, আম্মু দেখলে খবর আছে। বুকটাও কাঁপছে রেলগাড়ির লাইনের মতোই।
কি হল নাও!
তু-তুমি! এতো রাতে কদম ফুল নিয়ে।
হ্যাঁ, আমিই।
এত রাতে এখানে কি কর?
কেন আবার তোমাকে কদমফুল দিতে এসেছি।
তা তো বুজেছি। আমি তোমার মতো গাধা মানব নই।যদি আম্মু দেখে?
তা তো বুজেছি। আমি তোমার মতো গাধা মানব নই।যদি আম্মু দেখে?
দেখুক। আমি ফুলগুলো অনেকটা কেড়ে নিলাম রুহানের হাত থেকে।
ফুল তো নিলাম। এখন যাও। কেন বুঝতে পারছো না!
বাইরে আসো বৃষ্টিতে ভিজব। কত দিন থেকে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজি না। তোমার মনে আছে তুমি এবং আমি একবার বৃষ্টিতে ভিজে কদমফুলের জন্য আরাই-তিন কি.মি. রাস্তা হেঁটে গিয়ে ফুল এনেছিলাম। সেবার আমাদের কি জ্বর-সর্দি, মাথাব্যথা। পাক্কা ১৫ দিন অসুস্থ ছিলাম!
দেখ এখন স্মৃতিচারণের সময় নয়। আমি ভিজব না। তুমি যাবা? একটু জোড়েই বললাম। মনেমনে আমিও যে বৃষ্টিতে ভিজতে ব্যাকুল। একটু আগে ভিজতে গিয়ে ঘুরে আসলাম তা কি আর বলতে পারি।
না। যাবো না আজ এখানেই থাকব।
রুহান ভাল হচ্ছে না! রুহান কিছু বলে না। আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর সে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
রুহান, যাচ্ছো। ও ফিরে চায়! কিছু বলবা না?
দেখি রুহানের চোখে পানি চিকচিক করছে! এ পানি বৃষ্টির নয় চোখ নামের মহা সমুদ্রের। ও কিছু বলতে চাচ্ছে। মুখ দিয়ে বলতে পারছে না। অভিমানী মুখটা দেখলে বড্ড মায়া লাগে। আমার খুব ইচ্ছে হল ওর সাথে বৃষ্টিতে ভেজার। ওর হাত ধরে কাকতাড়ুরার মতো ভিজি। দরজা দিয়ে বাহির হওয়ার উপায় নাই। জানালা দিয়ে যদি পারতাম কত যে ভালো হত! রুহান আর কিছু না বলে যেতে শুরু করল। রুহানের কাছেই বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকায়। আমার মুখ থেকে আপনাআপনি ফ্যাকাসে শব্দ হয় রুহান যেও না। রুহান.........।
যখন চোখ খুললাম তখন সূর্য মধ্যাকাশে। জানালা দিয়ে আমার চোখে মুখে এসে পড়ছে রোদ। রোদের তেজ চৈত্র মাসের মতোই। মাথার কাছে পরে আছে একগুচ্ছ কদমফুল। ঘরে অনেক লোক আমাকে ঘিরে ধরে আছে। কি হয়েছে মনে করার চেষ্টা করছি! ওহ রুহান কাল যখন বাইরে ছিল তখন..........। রুহান এখন কোথায়? ওকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।
আমি দাঁড়াতে চেষ্টা করতেই পরে গেলাম আম্মু এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। আমার দুচোখ দিয়ে পরতে লাগল শ্রাবণের অশ্রুধারা। আমি আম্মুর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।
গুচ্ছ কদমফুল আজও আমার পানে হাত বাড়িয়ে থাকে বৃষ্টি বিলাসের প্রতিক্ষায়। রুহান কি তা জানে?
সূচিতে ফিরতে ক্লিক করুন
আপনার লেখা ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস, সাহিত্যিকের জীবনী, সাক্ষাৎকার, সাহিত্যের খবর বর্ণপ্রপাতে প্রকাশ করতে চাইলে ইমেইল করুন bornopropat@gmail.com