কবিদের বর্ষা ।। আশরাফ রাসেল


"আইল আষাঢ় মাস লইয়া মেঘের রানী
নদীনালা বাইয়া আইসে আষাঢ়িয়া পানি"
ময়মনসিংহ গীতিকায় আষাঢ়িয়া ঋতু বর্ষাকে বর্ণনা করা  হয়েছে এভাবে। আষাঢ় এবং শ্রাবণের যুগপৎ নৃত্য ও নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে বর্ষা তার রুপের নিদর্শন জাহির করে।

কবি আল মাহমুদ জন্মেছেন এই বর্ষাতেই। বর্ষণমুখর দিনে, বর্ষার মাঝামাঝি। কবি আল মাহমুদ লিখেছেন, "আমার জন্ম হয়েছিল এক বর্ষণমুখর রাতে। সম্ভবত এ জন্যই বৃষ্টির শব্দ আমার অন্তরায় একটা ঝংকার তোলে।" কবি নজরুলও কিন্তু জন্মেছিলে এমন ঝড় বাদলের দিনে, তা বর্ষা না হলেও বর্ষা যখন প্রকৃতিতে আগমনের প্রস্ততি নেয়, বৈশাখে। জন্ম সম্পর্কে কবি নজরুল বলেছেন,"অবিশ্বাসীরা শোন শোন সবে জন্ম কাহিনী মোর/ আমার জন্মক্ষণা উঠেছিল ঝঞ্ঝা তুফান ঘোর।" তুফানের সে তুখোড় স্বভাব কবি জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য, যে কারণে হয়তো কবির জীবন এত প্রবল গতির। আর বরীন্দ্রনাথ তো জীবনব্যাপী বর্ষাকে নিয়েছেন জীবনের আশির্বাদ হিসেবে।

শুধু তাই নয় মধ্যযুগ থেকে আরম্ভ করে বর্তমান সময়ের কোন কবি লেখকই বর্ষাকে কোনরুপ অগ্রাহ্য করার সাহস করে উঠতে পারেনি। বর্ষার প্রেম প্রাচুর্য ,স্বকীয়তা প্রত্যেককে আলাদাভাবে হানা দিয়েছে। লালন, চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি, কালিদাস, মুকন্দরাম, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত,  স্বর্ণকুমারীসহ সকলের কবিতায় বর্ষা এনেছে নানাভাবে। বর্তমান সময়ের কবি সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজ, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আহমেদ, আনিসুল হক, রুদ্র গোস্বামী, বুদ্ধদেব বসুসহ অনেকেই। পল্লীকবি জসিমউদ্দীনকে তো আলাদা ভাবে ভাবতেই হয়। তাছাড়া মাইকেল মধুসূদন, সুকুমার রায়কে বাদ দেয়া যায় না কোন ভাবেই।

লালন তার গানে বর্ষাকে রুপক ভাবে নিয়েছেন, "আসমানে বরিষণ হ'লে/ দাড়ায় জল মৃত্তিকা তলে" আবার "অমৃত মেঘের বারি সে বারি /অনুরাগ নইলে কি যায় ধরা"। দার্শনিক লালন জীবনদর্শনে বর্ষাকে টেনে নিয়েছেন প্রসঙ্গতই। মুলত পুরানো সাহিত্যে বর্ষাকে উপস্থাপন করা হয়েছে প্রেম-বিরহের চিহ্ন হিসেবে। চন্ডীদাস লিখেছেন, এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা আইলো কেমনে বাটে, আঙিনার মাঝে বধুয়া ভিজিছে দেখিয়া পরাণ ফাটে'। বর্ষা দিনের, বাদলের ঝরঝর বারি কবি হৃদয়ে নবপ্রেমের প্রেষণা দিয়েছে।  তাই বর্ষাস্নাত দিনগুলোকে কবি হৃদয় কোনভাবেই পাশ কাটিয়ে যেতে পারে না। বর্ষার রঙ ঢঙের খেলা, আষাঢ়-শ্রাবণের আকাশের লীলাখেলায় কবি হৃদয়কে ব্যাকুল করেছে। তাই তো রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন," এ কী গভীর বাণী ঘন মেঘের আড়াল ধরে, সকল আকাশ আকুল করে।" জীবনানন্দ দাসের কবিতা' শ্রাবণের রাতে',"শ্রাবণের গভীর অন্ধকার রাতে ধীরে ধীরে ঘুম ভেঙ্গে যায়.......।" বর্ষার এ ডাক প্রেম ছাড়া আর কিই বা হতে পারে!

 সকল যুগের সকল কবি বর্ষার প্রেম নিবেদনকে গ্রহন করতে বাধ্য হয়েছেন। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছেন, শ্রাবণে বরিষে মেঘ দিবস রজনী/ সিতাসিত দুই পক্ষ একই না জানি। বর্ষার দিনগুলোতে অবিশ্রান্ত বারিধারায় জীবনের উপলব্ধি করেছেন কবিমন স্বতন্ত্রভাবে।  কেউ সুখ, দুঃখ কেউবা প্রেম বিরহের ক্ষণ হিসেবে বর্ষার চরিত্র উপস্থাপন করেছেন। আবার কেউ চাঞ্চল্য জীবনের এক ঘেয়েমি কাটিয়ে উপভোগ্য সময় হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যেমন 'পল্লীবর্ষা' কবিতায় পল্লীকবি সেসময়ের জীবন চালাচলের উপভোগ্য বিষয়টি দেখিয়েছেন সাবলীলভাবে। লিখেছেন" গাঁয়ের চাষীরা মিলিছে আজিকে মোড়লের দলিজায়/ গল্পে গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়।" আল মাহমুদ লিখেছেন,  শুধু দিগন্ত বিস্তৃত বৃষ্টি ঝরে যায়, শেওলা পিছল/ আমাদের গরিয়ান গ্রহটির গায়।" সুকুমার রায় তার 'বর্ষার কবিতা'য় লিখেছেন, কোনখানে হাটু জল কোথা ঘন কর্দম/ চলিতে পিছল পথে পড়ে লোকে হরদম/ ব্যাঙদের মহাসভা আহ্লাদে গদগদ/ গান করে সারারাত অতিশয় বদখদ্। বর্ষাদিনের কাশবনে কাশফুল, নদীর ভরা যৌবন, বৃষ্টির জলে ধুয়ে হাঁসের বাঁশের ঝাড়ে শ্রান্ত হবার যে সৌন্দর্য্য তা কবির মনকে না নাড়া দিলে কবি কবিতার জন্ম দিতে পারতেন না কোন কালেই। আহসান হাবীবের থৈ থৈ বাদলের ধারায় তবু শ্রান্তি খোঁজে জীবন। যে কারণে মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছেন,' রমনী রমণ লয়ে সুখে কেলী করে'। বর্ষা ভাবনার যেন শেষ হয়না কবি মনে, দোলা দেয় তার বহুরুপী ব্যঞ্জনায়।

বুদ্ধদেব বসু বর্ণনা করেছেন, বর্ষা ও বিরহ এ বিষয় দুটি ভারতীয় সাহিত্যে আজ পর্যন্ত এক হয়ে আছে।  প্রেম থাকলে বিরহ থাকবে সেই চিরাচরিত। বর্ষা যে প্রেমের মোহে কবিসত্তাকে শিহরিত করে তা অস্বীকার করার কি কোনো পথ আছে? একদম নেই। রবীন্দ্রনাথ যে প্রেমে পাগল হয়েছেন, ময়ূরের মতো নেচেছেন, আবার এই বর্ষার প্রেমেই কবি সর্বহারা হয়েছেন। বর্ষা মেঘের ডানায় ভর করে কবি যেমন উড়েছেন তিনিই কিন্তু আবার সংশয়ে সঙ্কিতও হয়েছেন শ্যামা সুন্দরীর মোহময় প্রেমের ছলনায়। মহাদেব সাহা লিখেছেন, কাগজ আবিস্কারের পূর্বে মানুষ প্রেমের কবিতা লিখে রেখেছে আকাশে।/ সেই ভালবাসার কবিতা এই বৃষ্টি, এই ভরা বর্ষা।" কবির সে ভাবনা শুধুই ভাবনা যে নয় তা কবিদের বর্ষাপ্রেমের কবিতা ও গানে তার প্রমাণ মিলেছে। রবীন্দ্রনাথ  যেমন বলছেন, এমনি দিনে তারে বলা যায়/ এমনি ঘন ঘোর বরিষায়। হেমন্তমুখপধ্যায়ের গানে পাই, এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন/ কবে যাবো কাছে পাবো / ওগো তোমার নিমন্ত্রন। হুমায়ুন আহমেদের,  যদি মন কাঁদে/ চলে এসো, চলে এসো এক বর্ষায়। রুদ্র গোস্বামী যেমন লিখেছেন, 'মেঘ মেঘ চুল তার/ অভ্রের আয়না'। বৃষ্টি ও বর্ষার এ রুপগুলো সহজেই কবির নরম মনে হানা দিয়ে যায়। হাসান হাফিজ বৃষ্টিকে বিরহ জ্বালার চোরা প্রতিশব্দ বলেছেন। এই যে প্রেম- বিরহ, এইযে হৃদয়ের তালে ঝড়া বৃষ্টির ছন্দ যেমন কবি জীবনে প্রেমের আভাস দিয়েছে তেমনি নাপাবার বেদনায় ব্যাথাতুর হয়ে কবি বেদনার সুরে যেন মুর্ছা গেলেন। বর্ষায় যেমন প্রেম আছে, আছে বিরহ, আছে জীবনানন্দ তেমনি আছে কলঙ্ক।  যেমন থাকে প্রেমে। বন্যাকে বর্ষার কলঙ্গ বলা হয় সেকারণে। কলঙ্গ ছাড়া প্রেম যেমন খাঁটি হয় না, বন্যা ছাড়া তেমনি বর্ষা পূর্ণতা পায় না। বন্যার তিক্তাকে কাটিয়ে তবু কবি হৃদয় প্রেমের আনন্দে উৎফুল্ল হয়েছে, ডুবেছে বিরহ জলে। অভিমানে এবং শত প্রতিক্ষায় যখন কবিমন হতাশায় ভোগে বর্ষায় তার প্রাপ্তির আশা তখন প্রবল হয়। তাই কবি নজরুল হয়তো সেই আশাই রেখেছেন,
 "শাওন আসিলো ফিরে সে ফিরে এলো না,
বরষা ফুরায়ে গেল আশা পূরণ হলো না।'


বিদ্যাপতি যেমন বলেছেন-
সখি আমার দুখের নাহি ওর
ভরা ভাদর মাহ বাদর
শুন্য মন্দিরো মোর।

সূচিতে ফিরতে ক্লিক করুন


আপনার লেখা ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস, সাহিত্যিকের জীবনী, সাক্ষাৎকার, সাহিত্যের খবর বর্ণপ্রপাতে প্রকাশ করতে চাইলে ইমেইল করুন bornopropat@gmail.com

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।