নজরুলও যেথায় বিধ্বস্ত।। সঞ্জিব কুমার রায়



জীবনস্রোতের উল্টো চলা, মন চায় যখন যেমন ধরণের কবি হচ্ছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এক হাতে বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণতূর্য নিয়ে চলা কবি নজরুল ইসলাম।

সময়ের প্রতিকূলে চলা, বাধার বেঁড়ি ডিঙিয়ে চলা,পূরাতনকে ভেঙে নতুনের জয়গান করা কবি - কাজী নজরুল ইসলাম। 

কাজী নজরুল ইসলামের জীবন বিচিত্রতায় ভরা। জীবনের এমন কোন অভিজ্ঞতা নেই, যা তিনি জীবনে স্বাদ গ্রহণ করেননি। এমন কোন কর্কশ বস্তু নেই, যা তিনি অবলীলায় দুমড়েমুচড়ে কোমল করেননি। তিনি মিথ্যার কাছে পরাজয় বরণ করেননি। সত্যকে আলিঙ্গন করেছেন সুন্দর করে। সত্য সুন্দর কে   পুজো করেছেন, আবার মিথ্যে, জালিমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন নির্ভয়ে। কখনো প্রকাশ্যে, কখনো লিখনিতে। 

তিনি দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়েছেন। তবুও দারিদ্র্যের কারণে জীবনে হেরে যাননি।  দারিদ্র্য কে নিয়েছেন আশীর্বাদ হিসেবে। দারিদ্র্য তার কাছে বাধা হতে পারেনি বরং হয়েছে জীবন পরীক্ষার এক নাম। সে পরীক্ষায় তিনি ঠিকই উতড়ে গেছেন। শেষে দারিদ্র্য হয়েছে পরাজিত, নজরুল হয়েছেন উজ্জ্বল। তাইতো তার লেখায় ফুটে ওঠে -" হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছো মহান "।


বাংলার সাহিত্যাকাশে হঠাৎ ধূমকেতুর মতো উদ্ভব হয়েছে এই বাঁধনছেঁড়া মানুষটির। এই ধূমকেতু তার উত্থান পতনের কোন বিধি নিষেধ মানে না, সময় ক্ষণ তার জন্য কোন বেড়াজাল তৈরি করতে পারে না। তিনি যেমন বের হতে পেরেছেন স্বাভাবিক জীবনের গন্ডি থেকে, তেমনি বের হতে পেরেছেন তৎকালীন সাহিত্য আবহ থেকে। কবি নজরুল ইসলাম এমনি করে হয়ে উঠলেন এক ইতিহাস, এক নবযুগস্রষ্টা, এক বিস্ময় পূরুষ। 


এই এক জীবনে তিনি তাই হতে পেরেছেন - একজন সশস্ত্র  সৈনিক  , একজন কবি,একজন ঔপন্যাসিক, একজন নাট্যকার,   একজন গীতিকার, একজন সুরকার, একজন গায়ক, একজন অভিনেতা, একজন বৈচিত্র্যময়   মানুষ  ইত্যাদি। 


জীবনের প্রতিটি ক্ষণে তিনি এক নবস্রস্টা।  সমস্যা কখনো সমস্যা তৈরি করতে পারে নি তাঁর কাছে। যখন সমস্যায় পড়েছেন, চিন্তা করেছেন কিন্তু দুশ্চিন্তা কখনো তাকে গ্রাস করতে পারে নি। বিচলিত হননি জীবনে বরং চলন তাঁর ঠিকই ছিলো । দূঃখকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন। সমস্যা কে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। নিজ জীবনে, নিজ  সমাজে     বিরাজমান শত সমস্যার সমাধানের চিন্তা করতেন। দারিদ্র নিষ্পেষিত সাধারণের   মুক্তির জন্য চিন্তা করতেন, বিভিন্ন রকম  কাজ করতেন। তৎকালীন হিন্দু মুসলিমের মাঝে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছেন বহুভাবে বহুবার। দেশকে স্বাধীন দেখার তরে সমগ্র দেশবাসীকে নিজের এবং পারস্পরিক অাপন ভাই- বোন হিসেবে কল্পনা করতেন।  জালিম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কলম তুলে নিয়েছেন। তীব্র শব্দের বাণে বিদ্ধ করেছেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকদের। একের পর এক তাঁর বিভিন্ন বই বাজেয়াপ্ত হয়েছে, তিনি বরণ করেছেন কারাগারের শোভা, তবুও অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। 


কিন্তু ক্যান্সার হবার জন্য যেমন শরীরের সমস্ত জায়গায় হবার দরকার নেই বরং কোন এক জায়গায় হলেই তা ক্রমশ শরীরের সব জায়গায় বিস্তৃত হয়, তেমনি নজরুলের জীবনেও হয়েছে এমন প্রাণচাঞ্চল্যরোধময় ঘটনা। কেবল একটি কারণ কবি নজরুলকে করেছে বিধ্বস্ত। আর সেটি হলো -- তার প্রিয় পুত্র বুলবুল এর অকাল প্রয়াণ  ।  কবিপুত্রের এ অকাল প্রয়াণ কবিকে এতটাই বিধ্বস্ত করেছে যে, চিরতরুণ, সৌপ্তিক, আশার কবি হঠাৎই  বার্ধক্যে বাধা পড়েছেন, জীবন যুদ্ধে পালিয়ে এসেছেন, জীবনকেই ভয় পেয়েছেন, জীবনে আশা স্বপ্ন, সুর সব হারিয়ে ফেলেছেন। নজরুল এর লেখার সেই বিদ্রোহের চিরবৈশিষ্ট্য সুর যেন গেল হারিয়ে। সেখানে এসে ভির করলো ধ্যান- স্তিমিত ভাব অার আধ্যাত্মবাদের সুর( যুগস্রষ্টা নজরুল ; খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিন)। 


শুধু তাই নয়, এই বাঁধনছেঁড়া কবি ক্রমশ বাঁধা পড়তে লাগলেন অস্পৃশ্য বন্ধনে। দীক্ষা নিলেন গৃহী-যোগী শ্রীযুক্ত বরদাকান্ত মজুমদারের কাছে আর হয়ে উঠেছিলেন কালী সাধনায় মত্ত। 


আবার কোন এক মুসলমান দরবেশের শাাগরিদ হয়ে মারফতী তত্ত্ব আলোচনা নিয়ে মাতামাতি শুরু করেছেন। কুরআন-শরীফের গূঢ়রহস্য উদঘাটনে তিনি সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করেছেন ( যুগস্রষ্টা নজরুল ; খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিন) । 


বস্তুত, বাংলাভাষী ও বাংলা সাহিত্য প্রেমি      মানুষেরা      যে নজরুলকে চিনতো, সেই নজরুলেরও অকাল প্রয়াণ হয়েছে ঠিক এখানেই। নজরুলকে আর পাওয়া যায়নি চিরচেনা নজরুলরূপে। নজরুল হয়েছিলেন এক ধ্যান - স্তিমিত নজরুল। নজরুল হয়েছিলেন এক সঙ্গহীন নির্জন পথচারী। নিজ ভূবনে থেকেও নজরুল ছিলেন যেন এক অন্য ভবনের মানুষ, পাল্টে যাওয়া এক মানুষ, দুমড়েমুচড়ে যাওয়া এক মানুষ। হঠাৎ অাবির্ভূত ধূমকেতুর জীবনে আচমকা ছন্দপতন। জীবনের সুর হারিয়ে বেসুরো এক নজরুল। 


এরপরের নজরুল এক বিষন্ন নজরুল। হাহাকার অার বিষাদঘন নজরুল যেন মরিয়া হয়ে খুঁজে ফিরেছিলেন তাঁর প্রিয় পুত্রকে।কোটি সন্তানের জননী বঙ্গে নজরুল তবু কারোর মাঝে পায়নি নিজের শূন্যতা পূরণ করতে। তাইতো তাঁর কলমের আঁচড়ে বিষাদের নিঃশ্বাস ফেলে -"শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয় ফিরে অায় ফিরে অায়। তোরে না হেরিয়া সকালের ফুল অকালে ঝড়িয়া যায়।। "   


যে কারোর জীবনে সৃজনশীলতা তখনই বুঝি থমকে দাঁড়ায়, যখন প্রেরণাশক্তিগুলো শেষ হয়ে যায়। তারপরও হয়তো সৃষ্টি হয়, কিন্তু সে সৃষ্টি আর জীবন খুঁজে পায় না। অসুস্থ স্রষ্টার অসুস্থ সৃষ্টি!  সে সৃষ্টি  জীবনে কেবল বরষাই দেখতে পায়, বসন্ত যেন মিলিয়ে যায় দূর দিগন্তে। স্বয়ং নজরুলের মতো ক্ষণজন্মা সাহিত্যিকও খেই হারিয়ে ফেলে আপন জনের প্রয়াণে নিজ ক্ষয়ে।      


লেখক - সঞ্জিব কুমার রায় 

রাজারহাট, কুড়িগ্রাম। 

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।