একাত্তরে কুড়িগ্রামবাসীর ভূমিকা ছিল অনন্য। মুক্তিযুদ্ধে কুড়িগ্রামের রৌমারীতে গড়ে তোলা হয় মুক্তাঞ্চল। যার কারণে পাকিস্তানী বাহিনীর টার্গেট ছিল কুড়িগ্রাম। বিশেষ করে চিলমারী আক্রমণের পর থেকে পাক-হানাদার বাহিনী ও তার দোসর রাজাকার, আল-বদর খুঁজতে থাকে কোথায় অবস্থান করছে মুক্তিবাহিনী আর কিভাবে তারা আক্রমণ পরিচালনা করছিল। সেই সাথে প্রস্তুতি নেয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল আক্রমণের। তাদের ধারণা উলিপুর ও চিলমারীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান ঘাঁটি। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি অবস্থা বুঝতে পেয়ে উলিপুর থেকে খাইরুল আলমের এক প্লাটুন ফোর্স ছাড়া সকল ফোর্সকে ঘুঘুমারীর চরে স্থানান্তর করে। আবুল কাশেম চাঁদের কোম্পানিকে সর্তক অবস্থায় নিকটবর্তী চর এলাকায় অবস্থানের নির্দেশ দেন। ১১ নভেম্বর চাঁদ তার কোম্পানির দায়িত্ব প্লাটুন কমান্ডার শওকত আলী সরকারের উপর সাময়িকভাবে ন্যস্ত করে ব্যক্তিগত কাজে কুচবিহার গমন করেন। এই সময় বাদলের এক প্লাটুন ফোর্স বুড়াবুড়ির দাগারকোটেও অবস্থান করছিল।
১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর, ২৩ রমজান, শনিবার। গ্রামের বেশির ভাগ ধর্মপ্রাণ মানুষ সেহরি খেয়ে ঘুমিয়েছে, কেউ নিচ্ছে ঘুমানোর প্রস্তুতি। একটু পরেই মসজিদ থেকে ভেসে আসে সুমধুর আযানের ধ্বনি। নামাজের প্রস্তুতি নিতে অজু সেরে অনেকে মসজিদে যাওয়ার জন্য বাড়ী থেকে পা বাড়িয়েছে। কেউ কেউ পৌঁছেছে মসজিদে। ঠিক সে সময়েই তিন দিক থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার বাহিনীরা ঘিরে ধরে হাতিয়ার গ্রামগুলো তারপর মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে আর চালাতে থাকে তাণ্ডব। অনন্তপুর বাজারে এসে উচ্চস্বরে বলতে থাকে, ‘জ্বালাও, আগ লাগাও, কাহাহে মুক্তি, খোঁজো।’
যে কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা দাগারকোটে অবস্থান করেছিল তারা অধিকাংশই এই অতর্কিত হামলার পাল্টা জবাবে গোলাগুলি করে নিকটবর্তী চরে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা গুলজার হোসেন, নোয়াব আলী, আবুল কাশেম কাচু, দেলোয়ার, আবু বকর সিদ্দিক শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধা হিতেন্দ্রনাথ গর্তে লুকিয়ে থেকে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে তার কাছে থাকা পয়েন্ট থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে দেড় শ’রাউন্ড গুলি চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করেছিল। তার গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী তাকে বেয়োনেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে হত্যা করে। ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করতে করতে এই মহান মুক্তিযোদ্ধা জীবন উৎসর্গ করেন। এই আক্রমণে ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি কমান্ডার শওকত আলী সরকার পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে পাকিস্তানি বাহিনীর মর্টার সেল আর বন্দুকের অবিরাম গুলিবর্ষণে প্রকম্পিত হয়ে উঠে হাতিয়ার দাগারকুটি গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলো।
সহজ সরল নিরীহ মানুষগুলো কিছু বুঝে উঠার আগেই পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনী মিলে গ্রামের বাড়ী-ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। সাথে চলতে থাকে লুট-পাট ও নির্যাতন। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ছোড়া বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণে মানুষজন জীবন বাঁচাতে পার্শ্ববর্তী ধানক্ষেত, ঝোপ-ঝাড়ে শুয়ে জীবন রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টায় এলোপাতাড়ি ছোটাছুটি শুরু করে। জীবন বাঁচাতে অনেকে ঝাঁপ দেয় ব্রহ্মপুত্রে। তাদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ থেকে সেদিন মায়ের কোলের শিশুও রক্ষা পায়নি। এসব অসহায় মানুষের জীবন বাচাঁনোর চেষ্ঠা মুহুর্তেই শেষ হয়ে যায়। তাদের আর্তচিৎকারে ভারী হয় আকাশ-বাতাস। পাকিস্তানি বাহিনী, তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগীতায় আত্মগোপন করা মানুষগুলোকে ধরে নিয়ে এসে দাগারকুঠি গ্রামে সারিবদ্ধ করে নির্দয়ভাবে গুলি করে হত্যা করে। সারাদিনব্যাপী চলে হানাদার বাহিনীর হত্যা আর অগ্নিসংযোগ।
নারকীয় এই হত্যাকাণ্ড থেকে বাবর আলী তার পরিবার নিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। তার ঘরে টাঙানো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিতে গুলি করে ও ছবিটি মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে লাথি মারে মেলেটারীরা। পরে সারিবদ্ধ অনেকের সাথে তাকেও গুলি করা হয়। বাম হাত ও বুকে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। রাত ১১টায় গ্রামবাসী তাকে বাম হাত ও বুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠান। তিনি সুস্থ হয়ে ফিরলেও ফেরেনি তার ভাই আব্দুল ওহাব ও জোবেদ আলী। তাদের মা শোক-দুঃখে মাসসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেড় বছর পর মারা যান। স্বামীসহ শুয়ে ছিলেন আমেনা বেওয়া তার চোখের সামনে থেকে স্বামীকে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা করে। লুট করে নিয়ে যায় তাদের গোয়ালের গরু। বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কামাল হোসেন, তার বাবা বাবর উদ্দিন, চাচা বক্তার আলী ও দাদা শাহাদুল হককে গলা, হাত ও বুকে গুলি করা হয়। কামাল হোসেন প্রাণে বেঁচে গেলেও বাঁচেনি তার স্বজনেরা।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পা ধরেও রক্ষা করতে পারেনি স্বামী ও তিন দেওরকে জুলেফ বেওয়া। চোখের সামনে স্বামী ও তিন দেওরকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারপর ঘর-বাড়ি পুরে দেয়। অন্যের বাড়িতে আশ্রিত থেকে ভিক্ষা করে চলে তার সংসার। কচভান বেওয়ার যুবক স্বামীকেও হত্যা করে পাকিস্তান বাহিনী। ব্রহ্মপুত্রে ভিটে-মাটি হারিয়ে তিনিও বেঁচে থাকার জন্য কাঁধে তুলে নেন ভিক্ষার ঝুলি। রামখানা গ্রামের কিশোর আব্দুর রহমান পালিয়ে বাঁচলেও বাঁচেনি তার পরিবারের ৮ জন সদস্য। এভাবে দশঘণ্টা ব্যাপী নজিরবিহীন গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালিয়ে ৬৯৭ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি নরখাদক ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। তারপর তারা এলাকা ত্যাগ করে রেখে যায় লাশের স্তুপ। রক্তে ভেসে যায় ব্রহ্মপুত্র। চারদিকে পোড়া লাশের গন্ধে ভারি হয় বাতাস। তারা চলে গেলে বড় গর্ত করে শহীদের গণকবর দেওয়া হয়।
১৯৭১ সালের উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ড এই হাতিয়া গণহত্যা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও রাষ্ট্রীয় ভাবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। হত্যাকাণ্ডে শিকার পরিবার পায়নি রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ খ্রিস্টাব্দে ১৩ জন গ্রেপ্তার হলেও এখনো বিচার হয়নি এই গণহত্যাকাণ্ডে জড়িত রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসসহ পাকিস্তানি দালালদের। স্থানীয়ভাবে দিবসটি নানা কর্মকাণ্ডে পালন করা হলেও নিরবে মুছে যাচ্ছে ইতিহাসের পাতা থেকে। বর্তমান প্রজন্ম জানে না বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের অন্যতম বৃহত্তর এই গণহত্যা সম্পর্কে। বর্তমান সময়ের দাবী আগামী প্রজন্মকে এ হত্যাকাণ্ড জানাতে হাতিয়ায় স্মৃতিস্তম্ভের পাশে শহীদদের নামফলক স্থাপনসহ ১৩ নভেম্বর দিনটিকে জাতীয়ভাবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের ব্যবস্থা নেওয়া।
লেখক : অর্থ সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা এবং আহ্বায়ক সদস্য, রেল-নৌ, যোগাযোগ পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম।
লেখাটি বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত।