পিসতুতো দাদার বৌ, অথাৎ আমার বৌদিকে তাঁর বাপের বাড়িতে রাখতে গিয়েছিলাম মিরিকে। চা বাগানের ভিতরে, সাহেবদের কোয়ার্টারের পাশাপাশি বস্তি লাইনে তাঁদের বাড়ি। বৌদিকে সেখানে রাখতে গিয়েই আমার প্রথম মিরিক দর্শন। মিরিক যে এত অপরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারী হতে পারে, তা আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারি নি!
আমি বাড়ি ফিরছিলাম। বৌদির ছোটভাই শ্রীনিবাস আমাকে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত ছেড়ে দিতে আসলেন। প্রায় আধঘন্টা মতো স্ট্যান্ডেই দাঁড়িয়ে-- কিন্তু কোনো বাস দেখা গেল না। শ্রীনিবাস বলল, “দাদা, অনেকটা দেড়ি হয়ে গেল, আমি না হয় আসি। বাস পেলে চলে যেও তুমি।”
সেখানে একটি চায়ের দোকান ছাড়া বাকি সব দোকান বন্ধ। আমি বললাম, চা-বিস্কিট খেয়ে যাও।
ও বলল, “না দাদা, আমি চা খাই না। তুমি খেয়ে নাও। আমি আসি...”
ঠিক আছে ভাই, এসো-- বলে চায়ের দোকানের দিকে এগিয়ে গেলাম। দোকান্দার সহ সেখানে আর একজন নেপালি ভদ্রলোক বসে আছেন। লোকটির পড়নে একটা ঢিলেঢোলা স্যুট, ফুলহাতা শার্টের উপর একটা হাতাকাটা কোর্ট আর মাথায় টুপি। কাঁধে একটা ব্যাগ ঝোলানো। সেখান থেকে একটা পান বের করে দোকানের বেঞ্চে বসে চিবোচ্ছেন। লোকটাকে কোথাও দেখেছি বলে মনে হলো আমার। মনের ভিতরে অনেক ছবি ভেসে উঠতে লাগলো-- কোন ছবিটা তার হতে পারে! কোনোটার সাথেও যে মিলছে না ভদ্রলোকের চেহারা। লোকটিও আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। তিনি হয়তো আমাকে চিনেছেন। একটু অস্বস্তি বোধ করছিলাম। আমি এগিয়ে যেতেই দোকান্দার বললেন, “চা খাবেন, সাহেব?”
আমি বললাম, দিন এক কাপ।
সাথে সাথে একটা গরম চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন, “বিস্কিট দিবো একটা?”
আমি চায়ের সাথে বিস্কিট খাই না। কিন্তু দোকান্দারের মুখ দেখে মনে হল, সাথে একটা বিস্কিট নিলে হয়তো তার বেশ উপকারই হয়। আমি বললাম, না লাগবে না। আপনি বরঞ্চ আমাকে একটা বিস্কিটের প্যাকেট’ই দিন। আমি বিস্কিটের প্যাকেটটা ব্যাগে ভরছিলাম, ঠিক সেই মুহুর্ত্বে দার্জিলিং কিংবা কালিম্পং-এর দিকে থেকে একটা অল্টো কার এসে দাঁড়ালো দোকানের সামনেই। এতক্ষণ অপেক্ষা করার পর এই প্রথম একটা গাড়ি দেখতে পেলাম। গাড়িতে কোনো প্যাসেঞ্জার নেই, ড্রাইভার একা। গাড়ি থেকে নেমে তিনিও এক কাপ গরম চা খেলেন। তারপর একটা সিগারেট টানতে টানতে আমাকেই উদ্দেশ্য করে বললেন, “কোথায় যাবেন?”
আমিও আপ্লুত হয়ে বললাম, যেতে হবে তো গয়েরকাটা।
গাড়িওয়ালা বললেন, “যাবেন নাকি? আজকে তো বাস চলাচল বন্ধ। আপনি খবরের কাগজে পড়েন নি?”
আজ্ঞে না, এরকম কোনো খবর শুনি নি তো! আপনি কি গয়েরকাটা যাবেন?
তিনি বললেন, “গয়েরকাটা যাবো না। তবে ভাড়া পেলে যেতেও আপত্তি নেই।”
চলুন, ভাড়া নিয়ে চিন্তা করবেন না-- বলেই গাড়ির দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম।
তিনি কিছু একটা ভাবলেন, তারপর বললেন, “অন্যান্য দিনের তুলনায় কিন্তু আজকে ভাড়াটা একটু বেশী দিতে হবে আপনাকে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন?
তিনি একটু হেসে বললেন, “আজকে বাস বন্ধ, একটু আগেই তো বললাম আপনাকে। সারাদিন অপেক্ষা করেও একটি বাস পাবেন না, গ্যারান্টি সহকারে বলতে পারি। যদি যেতে চান, তাহলে বলতে পারেন। নইলে আমিও এক্ষুনি চললাম...”
আমিও ভেবে দেখলাম, এতক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটি মাত্র অল্টো কার পেলাম! এখন সেটাও যদি হাতছাড়া করি, তাহলে তো কালকের ইন্টারভিউটাই দিতে পারবো না! আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভাড়া কত নেবেন?
তিনিও ভেবে-চিন্তে বললেন, “পাঁচ হাজার দিলেই চলবে।”
পাঁচ হাজার!
তিনি বললেন, “একটু কম করেই বললাম দাদা। অন্য কেউ হলে হয়তো আরও বেশী চাইতো।”
পাঁচ হাজার! তাও আবার কম বলে মনে হলো আপনার!
“কমই তো বললাম। ঠিক আছে, আপনি আর দুশো টাকা কম দেবেন।”
মাত্র দুশো!
“এর থেকে কমে আমি যেতে পারবো না দাদা। আপনি অন্য গাড়ি করে যেতে পারেন।”
আমি বললাম, আচ্ছা পঁয়তাল্লিশ-শ টাকা দেব। আর কথা বাড়াবেন না দাদা।
“আচ্ছা, আপনারটাই হলো। ভাড়াটা পেমেন্ট করুন আগে।”
এক্ষুনি ভাড়া পেমেন্ট করতে হবে!... অবাক তো হওয়ারই কথা আমার। মাত্র পাঁচ-শ টাকা যে পকেটে রয়েছে। বাসে করে গেলে এ টাকা দিয়ে আমি শিলিগুড়িতে মাংস-ভাত খেয়ে বাড়ি পর্যন্ত নিশ্চিন্তে পৌঁছে যেতাম।
“হ্যাঁ, ভাড়াটা পেমেন্ট করুন আগে। আপনি যদি বাড়ি ফিরে আপনার মত পাল্টান, তখন...”
এ আরও অবাক করার মতো কথা। আমার এই নিষ্পাপ মুখখানা দেখেও কি ওনার মুখে এই কথাটা আসতে পারলো! আমি বললাম, তাহলে আপনি আসতে পারেন দাদা। এখন মাত্র পাঁচ-শ টাকা ছাড়া আমার পকেটে আর এক পঁয়শাও বেশী নেই।
আমার কথা শুনে তিনি আর কিছু না বলে গাড়িতে ঢুকে বসলেন। এবারে বেঞ্চিতে বসে থাকা নেপালি ভদ্রলোক ঢুলতে ঢুলতে একটু এগিয়ে এসে গাড়িওয়ালাকে বললেন, “ওনার ভাড়াটাও আমি দিলে চলবে কি?”
“আমার ভাড়ার সাথে দরকার দাদা। কে দিলো না দিলো সেটা দেখে আমি কি করবো।”
নেপালি ভদ্রলোক পঁয়তাল্লিশ-শ টাকা পেমেন্ট করে, আমাকে বললেন, “উঠে পরুন।”
আমি বললাম, আপনি...
তিনি বললেন, “চিন্তা করবেন না। বাড়িতে পৌঁছে টাকাটা আপনি আমায় দিয়ে দিবেন। আমার বাড়িও মাখড়াপাড়ায়।”
আমি বললাম, আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দিবো দাদা...
এরপর দুজনেই গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়িওয়ালাও গাড়ি স্টার্ট করলো। প্রচন্ড হাওয়া ঢুকার কারণে আমি গাড়ির কাঁচ বন্ধ করে দিলাম। নেপালি ভদ্রলোককেও কাঁচ বন্ধ করতে বললাম। তিনিও আপত্তি করলেন না-- সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ করে দিলেন। কি একটা বিশ্রী দুর্গন্ধ আসতে লাগলো! এতক্ষণ গাড়ির কাঁচ খোলা অবস্থায় দুর্গন্ধটা ঠিক উপলব্ধি করতে পারি নি। কিন্তু এখন যেন গাড়িতে থাকাই মুশকিল! আমি গাড়িওয়ালাকে বললাম, দাদা-- গাড়িতে এমন কি রেখেছেন-- কি বিশ্রী দুর্গন্ধ হচ্ছে!
তিনিও দুর্গন্ধটা পেয়ে বললেন, “সত্যি তো! কিন্তু গাড়ি তো একদমই পরিস্কার আছে। মরা-পচাও তো কিছু নেই গাড়িতে!”
আমি এবার স্পস্ট অনুভব করলাম, দুর্গন্ধটা আমার পাশে বসা নেপালি ভদ্রলোকের শরীর থেকেই বেড় হচ্ছিল! তিনি মুখে তখনও একটা পান চিবোচ্ছেন। তার দাঁতগুলো যেন কোনো মরচে পড়া লোহার রড! হয়তো দীর্ঘ কয়েক কাল যাবৎ এ দাঁতের যত্ন করা হয় নি।... আমি একটু সরে বসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু-- জায়গা থাকলে তো সরে বসতে পারবো!
আমি গাড়ির কাঁচ খুলে দিলাম। নেপালি ভদ্রলোককেও কাঁচ খুলতে অনুরোধ করলাম। তিনি একটু অস্বস্তি বোধ করেও কাঁচ খুলে দিলেন। তখনও গন্ধটা যাচ্ছিল না! হুট করে কাউকে বলাও যায় না যে, “আপনার শরীর থেকে কেন এমন বিশ্রী দুর্গন্ধ বের হচ্ছে?” তাছাড়া তিনি তো আমাকে সাহয্য করেছেন। কিভাবে তাকে মুখের উপর এ কথাটা বলতে পারি!
গাড়ি ততক্ষণে সেবকের বাগপুল পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। নেপালি ভদ্রলোক বললেন, “একটু দাঁড়াবেন দাদা? আমার ইয়ে হচ্ছে... সহ্য করতে পারছি না।”
গাড়ি দাঁড় করানো হলো। একটা স্বস্তির নিঃস্বাস ছাড়লাম। এতক্ষণে একটু ভালো লাগছিল আমার। সেবকের অপরূপ সৌন্দর্য্য পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম বাগপুলে দাঁড়িয়ে। দু-দিকের উঁচু পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তার কলকল শব্দ আমার কানে ভেসে আসছিল। এর আগেও সেবকে আমি বহুবার এসেছি-- কিন্তু গাড়ির বিকট শব্দে তিস্তার এ শব্দ কখনও আমার কর্ণগোচর হয় নি!
আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। আবার একই সমস্যা-- কি বিশ্রী দুর্গন্ধ! যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি পৌঁছোতে পারলেই হাফ ছেড়ে বাঁচি। একজন মানুষের শরীরে কি এত বিশ্রী দুর্গন্ধ হতে পারে! এ শরীরে কি কখনও জল পড়ে না? এ শরীরে কি সাবান লাগে না? মাথায় কি শ্যাম্পু কিংবা সাবানের ব্যবহার কখনও হয়?... এ সব প্রশ্ন আমার মাথায় কিলবিল করতে লাগলো।
যখন থেকে দুর্গন্ধ বেড়িয়েছে, নেপালি ভদ্রলোকের সাথে আমার আর কথা হয় নি। অবশেষে কোনোরকম বাড়ি পৌঁছোলাম। গাড়ি থেকে নেমেই মুক্তি পেলাম। নেপালি ভদ্রলোক আমাকে বললেন, “দাদা, এই বুঝি আপনার বাড়ি?”
আমি দূর থেকেই বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ।
মরচে পড়া দাঁতগুলো বেড় করে একটা হাসি দিয়ে বললেন, “আমায় কি চিনতে পেরেছেন?”
আমি বললাম, খুব চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু মনে পড়ছে না-- কোথায় যেন দেখেছি আপনাকে!
“ভদ্রলোক বললেন, “মনে আছে আপনার-- মাখড়াপাড়ার সেদিনের ঘটনাটা। হয়তো সেদিন আপনি’ই ছিলেন...”
‘মাখড়াপাড়ার সেদিনের ঘটনাটা’ বলতেই আমার মনে পড়ে গেল-- ইনি সেই ভদ্রলোক, যিনি আমাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। একদল ছিনতাইবাজের সম্মুখীন হয়েছিলাম সেদিন। প্রানে বাঁচার কোনো সম্ভবনাই ছিলো না হয়তো! আমার মানিব্যাগ সহ বাইকটা হাতছাড়া হয়েই গিয়েছিলো! বাকি বলতে শুধুমাত্র প্রানটা! এমন সময় এই ভদ্রলোক সম্ভবত বীরপাড়া থেকে ফিরছিলেন। মাঝ পথে আমাকে এ অবস্থায় দেখে তিনি এগিয়ে আসলেন এবং ছিনতাইবাজদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করছিলেন। হয়তো তিনি ওখানকার মান্য কেউ একজন হবেন। এনার কথামতো ছিনতাইবাজরা আমাকে আমার মানিব্যাগ আর বাইক ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি না থাকলে সেদিন আমি...
আমি বললাম, ওহ, চিনতে পেরেছি। সেই স্মৃতি যে ভুলবার মতো নয়। আপনি না থাকলে সেদিন...! নেমে আসুন। চা খেয়ে যান।
তিনি বললেন, “অন্য দিন খাওয়া যাবে। আজকে ছাড়ুন...”
গাড়িওয়ালা বললেন, “দাদা, বেশী দেড়ি করবেন না প্লিজ। আমাকে আবার এতটা রাস্তা ফিরতে হবে।”
আমি ঘরে গিয়ে পঁয়তাল্লিশ-শ টাকা এনে নেপালি ভদ্রলোকের হাতে দিচ্ছিলাম। কিন্তু-- ভদ্রলোক বললেন, “আমার ভাড়াটা আপনাকে দিতে হবে না। আপনি আপনার ভাড়াটাই দিয়ে দিন।”
আমি বললাম, আমিই দিয়ে দিচ্ছি...
তিনি বললেন, “আমি কারো কাছে ঋণি হয়ে থাকতে চাই না দাদা। আপনি বরঞ্চ আপনার ভাড়াটাই দিন।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। দুই হাজার দুই-শ পঞ্চাশ টাকা নেপালি ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে, গাড়িওয়ালাকে বললাম, ওনাকে ওনার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন।
গাড়িওয়ালা নেপালি ভদ্রলোককে নিয়ে মাখড়াপাড়ার দিকে রওনা দিলেন। আমি মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাড়িটির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম, আর ভাবতে লাগলাম, কি অদ্ভুত মানুষ-- পরোপকারি, অথচ নিজের শরীরের যত্নটুুকু নেন না কেন ইনি! এ রকম সহযাত্রী হয়তো চলার পথে জীবনে আর কোনোদিন পাব না!
তারিখ: 05.03.2021