থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক । বিশ্বের অন্যতম পর্যটকপ্রিয় শহর । দারুণ গোছানো ও পরিচ্ছন্ন নগরী । মূলত দুটো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা পুরস্কার গ্রহণের উদ্দেশ্যেই ব্যাংককে আসা । তবে একটি দিন রেখেছিলাম বিখ্যাত সাফারি ওয়ার্ল্ড পরিদর্শনের জন্য । ব্যাংকক এসে সাফারি ওয়ার্ল্ড দেখতে যাবো না তা কিছুতেই হয়না । যারা এখানে এসেছেন বা আসবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমার মনে হয় সত্যিই টাকা উসুল হয়ে যাবে ।
১৯৮৮ সালে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক শহরের মিনবুড়ি এলাকার অব্যবহার্য ভূমির সর্বমোট ৪৮০ একর জমি নিয়ে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র সাফারি ওয়ার্ল্ড। এখানে গড়ে তোলা হয়েছে খোলা চিড়িয়াখানা ও পাখির পার্ক।
খুব সকালে হোটেলের নিচে গাড়ি এসে হাজির । আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফিরোজ আলমসহ আমাদের ৫ জনের টিম । আমরা প্যাকেজ নিয়েছি যার মধ্যে যাতায়াত, সাফারির প্রবেশ ও বিভিন্ন শো এর টিকেট, দুপুরের খাবার অন্তর্ভূক্ত ছিল । হোটেল থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম এখানে । হাতে পেলাম প্রবেশ টিকেট ও শোগুলোর সময়সীমা । প্রবেশ গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখলাম বহু পর্যটক এসেছে, এসেছে স্থানীয় স্কুলের ক্ষুদে শিক্ষার্থীবৃন্দ । ওদের সাথে ছবি তুললাম, বাংলাদেশের অপামর সৌন্দর্য্য ও বাংলাদেশে ভ্রমণ করতে কথা বলছিলাম এক শিক্ষকের সাথে, হঠাৎ মনে হলো এখনিতো শুরু হবে ওরাঙউটান শো মানে বন মানুষের বিশেষ শারীরিক প্রদর্শনী । দিলাম দৌঁড় ।
হাজারখানেক দর্শকের কেউ গ্যালারিতে বসেছেন, আবার কেউ বসার জায়গা খুঁজছেন। আমিও সিটে বসতে যাচ্ছিলাম এমন সময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাথার উপর দিয়ে হঠাৎ দ্রুতগতিতে একটি বন মানুষ ঝুলতে ঝুলতে ছুটে গেল মঞ্চে। তার পেছন পেছন একে একে ছুটে গেল আরো চারটি বন মানুষ, শুরু হল হইহুল্লোড়, সাথে সাথে সাফারি ওয়ার্ল্ডে বিশ মিনিটের হাস্যরসাত্মক ওরাঙউটান শো । এমনি দৃশ্যেরই মুখোমুখি হতে হয় ব্যাংককের সাফারি ওয়ার্ল্ডে। প্রশিক্ষিত বন মানুষ গিটার, ড্রাম, বেহালা বাজিয়ে নেচে গেয়ে শুরু করে বিনোদনমূলক বক্সিং খেলা। এতে প্রায় এক হাজার দর্শক হাসি আনন্দে মেতে থাকেন পুরো বিশ মিনিট। শো শেষে বন মানুষের সাথে শিশু-কিশোরসহ সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত।
এক শো শেষ হলে দর্শক পায়ে হেটে চলছে আরেকটি গেম শো দেখতে। এভাবে চলে সী লায়ন শো, ডলফিন শো, কাউবয় শো, এ্যালিফেন্ট শো, বার্ড শো,স্পাই ওয়ার শো। যেখানে দেখা যায় সি লায়ন ও ডলফিনগুলো দর্শকদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে। দেখাচ্ছে নানা শারীরিক কসরত, ডিগবাজি। পুলের এক প্রান্ত থেকে পিঠে মানুষ নিয়ে ছুটে চলেছে অন্য প্রান্তে। সুরের তালে তালে চলছে কখনো একক আবার কখনোবা দলীয় নৃত্য।হাতিদের ফুটবল খেলা, রঙ তুলি দিয়ে ছবি আঁকা, পাখিদের গেম শো, কাউবয়দের অস্ত্র হাতে ঘোড়া নিয়ে ছুটে চলা আর মারামারি।
সেই সকালে এসেছি এখানে, মজার বিষয় হচ্ছে সামাণ্যতম ক্লান্তি অনুভব করেনি । মজার মজার শোগুলো দেখতে দেখতে দুুপুর হয়ে এলো এবং যোহরের নামাযের সময়ও হয়েছে । সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে এখানে মুসলমানদের নামাজের ঘর রয়েছে । আমরা সবাই নামায আদায় করে নিলাম । হঠাৎ মনে হলো প্রচন্ড ক্ষুধার্ত আমরা। সবাই ‘জঙ্গল ক্ররস রেস্টূরেন্ট’-এ খাবারের জন্য ঢুকলাম। এখানে সবই ভারতীয় খাবার। বিরানি, লুচি, তরকারি, কলা, ফিরনিসহ নানা খাবার। আমাদের অভ্যস্ত আর সুস্বাদু খাবার পেয়ে সবাই মজা করে খেলাম। এদিকে সময়ও হয়েছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্পাই ওয়ার শো এর । স্পাই ওয়ার শো হলো হলিউডের ছবির আদলে বিশেষ অভিনয় পারফর্মেন্স । শোটি শেষে মনো হলো এতোক্ষণ বুঝি হলিউডের ভিতরেই ছিলাম । এক কথায় দারুণ উপভোগ্য শো ।
বিনোদনের সমস্ত উপকরণের মিলন ঘটানো অপরূপ এ সাফারী ওয়ার্ল্ডে প্রতিদিন ভীড় করছেন কয়েক হাজার দর্শনার্থী।
এক শোর মঞ্চ থেকে বেরিয়ে আরেকটি মঞ্চে যাওয়ার পথে দেখা মিলবে উন্মুক্ত গাছের ডালে বসা ম্যাকাউ পাখির সাথে। চাইলে এদের হাতে নিয়ে ছবি তোলা, খাবার দেয়া ও আদর করা যায়।
এছাড়াও দেখা মিলবে ওয়ালরাস, পোলার বিয়ার, ফার সিল, বড় বড় এ্যাকোরিয়াম ফিসসহ শত শত প্রজাতির পশু পাখির সাথে। এদের কোনটি কাঁচের খাঁচা আবার কোনটি লোহার খাঁচার ফাঁক গলে চেয়ে রয়েছে বাইরের দিকে। সত্যিই অসাধারণ ।
এবার যাবো সাফারি পার্কে । এখানে রয়েছে ৮ কিলোমিটার লম্বা সাফারি পার্ক। যা গাড়িতে চড়ে ঘুড়ে আসতে সময় লাগে ৪৫ মিনিট। এ ছাড়াও রয়েছে মেরিন পার্ক, পশু পাখির হাসপাতাল, বিস্তির্ণ এলাকা জুড়ে পাখিদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর পশু এখানে জড়ো করা হয়েছে। এমন কোন প্রাণী নেই যা এই সাফারি পার্কে নেই। বাঘ,সিংহ,হরিণ,উট, জিরাফ, জেব্রা, গন্ডার, হাতি, ময়ূরসহ কয়েক হাজার পশু পাখির অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র এ পার্ক।
গাড়িতে করে এক প্রাণীর আবাসস্থলে থেকে আরেক প্রাণীর আবাসস্থলে যাচ্ছি আমরা। প্রাণীদের আবাস এলাকায় পৌঁছুলে অটোমেটিক ইলেকট্রিক্যাল গেইট খুলে যাচ্ছে আর গাড়ির ভেতরে বসেই জঙ্গলের সৌন্দর্য্য অবলোকন করছি আমরাসহ আগত সকল দর্শনার্থীরা।
গাড়ির খুব কাছাকাছি ঘুরছে পশুপাখিগুলো। দেখে মনে হবে না এই চিড়িয়াখানার পশুদের দেখতে এসেছে মানুষ, বরং পশুরা দেখছে খাঁচায় বন্দি মানুষকে।
প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী প্রাণী থেকে শুরু করে বিনোদনের প্রতিটি কাজ সুনিপুণভাবে সম্পাদন করে চলেছে। মাত্র ৩২ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই সাফারি ওয়ার্ল্ড বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে শুধুমাত্র এর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য।
এদিকে পড়ন্ত বিকেল মনে করিয়ে দিচ্ছে, সময় হয়েছে এখন হোটেলে ফেরার...........................।
রুহিত সুমন
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ময়ূরপঙ্খী শিশু-কিশোর সমাজকল্যাণ সংস্থা ও ময়ূরপঙ্খী ট্রাভেলার্স ফোরাম।