কাল চাঁদ দেখা গেছে। আজ ঈদ। পূর্ব দিক থেকে লাল সূর্য টা টগবগে ফুটন্ত লাল গোলাপের মতো লাগছে । গেল রাতে গ্রামের দূরন্ত ছেলেরা যখন ঈদের আগমনে আনন্দে পটকা ফোটাচ্ছিল, তখন সিন্নার মা সালেহার মন অকস্মাৎ কেঁপে ওঠেছিল। কাল ঈদ, ঘরে তার খাবার নাই। মকবুল সাহেবের বাড়িতে কাজ করার সময় মুটের চাউল রাখতো একটা কলসি তে। সে চাউলই সম্বল, তা দিয়ে ঈদের দিন টা চললেও রাতটা কাটাতে হবে না খেয়ে।
আবার দিনে গোসত খেতে হবে কিন্তু সে উপায় ত নেই, তাই আগাম ব্যবস্থা করে রেখেছে সে মকবুল সাহেবকে বলে। হয়তো ছেলের সাধ কিছুটা পূরণ করতে পারবে। একজন মা হিসেবেই কেবল নয়, মৃত্যুর সময় সিন্নার বাবা সালেহাকে বলে গিয়েছে - রক্ত বেঁচে হলেও ছেলেকে মানুষ করবি, ছেলের যেন কোন দূর্গতি না হয়। তাই মায়ের পাশাপাশি স্বামীর কথাও অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা সর্বদাই করে সালেহা।
পূরণো পাঞ্জাবির
ছেঁড়া অংশটা
সেলাই করে
এবারের ঈদ
টা কাটাতে
হবে সিন্নার। ফজরের নামাজ পড়ার
সময় সালেহা
আল্লাহর নিকট
দোয়া পড়ে
নিয়েছে " হে আল্লাহ, আজকের
দিনটা বালা
মছিবৎ ছাড়াই
যেন পার
হয়।
" ঈদের কারণে
এনজিওর কিস্তিও
বন্ধ।
তাই ঈদের
আনন্দের মতো
এটাও সালেহার
আনন্দের ব্যাপার।
ঈদের দিন
সকালেই রশিদ
মিঁয়ার বউয়ের
প্রসব বেদনা
উঠলো।
এ্যাম্বুলেস এ
করে হাসপাতালে
নেওয়া হচ্ছে
তাকে।
বউটার শরীর
স্বাস্থ্য খারাপ,
রক্তশূন্যতাও আছে। সে
রক্তও আবার
সহজলভ্য নয়। ও নেগেটিভ।
রশিদের বউকে
একবার দেখে
দোয়া করে
এসে সিন্না
কে গোসল
করিয়ে দিয়ে
মাথায় সরিষা
তেল মেখে
সিঁথি টা
ফাটাতে ফাটাতে
বলতে লাগলো
- তোর মুখ
খ্যান দ্যাখলে
তোর বাপের
কথা মনে
পড়ে যায়।
- ক্যান আম্মা?
- তুই একদম তোর বাপের মতো হইছিস!
সিন্নার বয়স যখন দুই বছর, তখন তার বাবা মারা যায়। তাই বাবার মুখখানা সিন্নার মনে নাই। তবে ঘরে একটা ছবি টাঙানো আছে- সিন্না, সালেহা ও তাঁর স্বামী আকবরের। ওই ফটোখানাই সিন্নার বাবাকে দেখার একমাত্র সম্বল।
ছেলেকে সাজাতে
সাজাতে স্বামী,
পুত্র, সংসার,
স্বপ্ন কতকিছুর
কথাই সালেহার
মনে ভেসে
আসে।
অজান্তেই তাঁর
চোখে জল
আসে।
তবুও কিছু
সান্ত্বনা আছে
মনে।
ছেলে টা
বড় হচ্ছে। দেখতে
মাশাল্লাহ, ঠিক
তাঁর বাবার
মতো।
পড়ার মাথাও
বেশ ভালো। স্কুলের
শিক্ষক রা
বেশ প্রশংসা
করে।
হঠাৎ সিন্না
প্রশ্ন করে
ওঠে
- আম্মু, আমার আর
কোনো ভালো
ডাক নাম
রাখতে পারো
নাই? সিন্না কোন নাম
হইলো?
সালেহা হেসে
উঠলো৷
বললো ঃ
স্কুলের খাতায়
তোর নাম
কি?
- সালাউদ্দীন আকবর!
- ওটাই তোর নাম। আর
কোন নাম
নাই।
- তাহলে মাইনসে যে
সিন্না কয়?
- কপাল! তোর বাপ
মরার পর
থেকে খুব
কষ্ট হয়েছে। খাইতে
পাইস নাই
ভালো।
কোস্টার সিন্নার
মতো চিকনা ছিলি খুব। সেজন্য
মাইনসে তোক
সিন্না কয়া
ডাকতো।
পরে ওটাই
তোর নাম
হইলো।
-
আচ্ছা আম্মা,
আব্বায় মরলো
ক্যামনে?
- আইজ না, আরেকদিন
শুনিস।
- আম্মা, অনেকদিন ত
এই কথা
কইছো।
আজকে কও। এমনি
শুনি।
- তোর বাপ গাছ
কাটতো মকবুল
সাহেবের কামলা
হিস্যাবে।
একদিন গাছের
ওপর থাইক্যা
পড়ে হাড়-গোড় সব ভাইঙ্গা
গেছে।
মাথায় আঘাত
পাইছে৷ বমিও
করেছে।
পরে তাক
হাসপাতালে নিয়্যা
গেছি।
তোর মকবুল
বড়াব্বা সাহায্যও
করেছে কিছু। আমাদের হাতের কোচ
যা ছিলো,
সব শ্যাষ
করছি কিন্তু
তাঁকে আর
বাঁচাতে পারি
নাই।
কত আশা
ছিলো তার
তোকে নিয়ে....
হঠাৎ পেছন
থেকে সুদখোর
গুঁতা মিয়া
বড় বাঁশের
কণ্ঠে হুঙ্কার
ছাড়লো ঃ
সিন্নার মাও,
গরীব হইলে
কি কথার
দামও থাকে
না?
সালেহার মাথায়
বাজ পড়লো। গতকাল
পটকা ফোটার
সময় তাঁর
বুকের কাঁপুনি
টা এবার
স্পষ্ট হলো। গত
বছর গুঁতা
মিয়ার কাছে
সুদের ওপর
যে টাকা
নিয়ে টিনের
ঘর তুলেছে,
আজসেই টাকার
মাসিক সুদ
দেয়ার দিন। গত
কয়েকদিন আসন্ন
ঈদ কে
ঘিরে তাঁর
এত চাপ
গেছে যে,
গুঁতা মিয়ার
সুদের কথা
সে ভুলেই
গেছে।
গত কয়েকমাস
সঠিকভাবে সুদের
টাকা দিতে
না পারায়
এমাসে আর
ওরকম হবে
না মর্মে
কথা দিয়েছে। এমনকি
এও বলেছে
যে, সুদের
টাকা নিতে
গুঁতা মিয়া
কে সালেহার
বাড়িতে আসতে
হবে না,
বরং সালেহা
স্বয়ং গিয়ে
তাঁকে দিয়ে
আসবে।
নিজের কথার
ব্যত্যয় হয়ে
গেছে, সলজ্জিত
চিত্তে সালেহা
বেগম সুদগ্রহণকারীকে
বসতে বললে,
গুঁতা মিয়া
গর্জে ওঠে
বলে-
আমি কি
তোমার বাড়িত
সাগাই খাবার
আসছি?
- মিয়া ভাই, আজ
ত ঈদ..
- ঈদ ত ঠিক
আছে কিন্তু
কথা কি
ছিলো?
- মিয়া ভাই, অভাবী
সংসার।
ঈদ ক্যামনে
কাইটবে, সেই
টেনশোনে মনেই
আছিলো না। কিছু
মনে করেন
না।
- হয়েছে হয়েছে।
কথা রাখতে
না পারো
কথা দাও
ক্যান।
সে যাকগে,
এখন টাকাটা
দাও তো। ঈদের
দিন ক্যাচাল
করতে ভালো
লাগে না।
- মিয়া ভাই, বিশ্বাস
করেন, হাতে
কোন টাকা
নাই।
ছাওয়াটার ছেড়া
জামায় সেলাই..
- অত প্যাচাল ত
শুনতে চাই
না।
টাকা চাই।
- ক্যামনে দেই ভাই?
দুয়েকদিন গ্যালে..
- গুঁতা সুদারুক চেনো
না? দুয়েকদিন
বললেই যে
হবে, তার
গ্যারান্টি কোটে?
টিনের ঘরের
নিচোত ত
থাকতে ভাল
লাগে! আবার ব্যাটাক নাকি
মানুষ করবি,
এটাও কানোত
আসছে।
এই ক'টা সুদের টাকা
দিতে না
পাইস, টোটাল টাকা ক্যামনে
দিবি? যদি আজকের মধ্যে
সুদের টাকা
দিতে পারিস,
তাইলে মুল
টাকার চাপ
দেব না
কিন্তু যদি
না পারিস,
তাইলে সামনের
দুই দিনের
মধ্যে মুল
সমেত সব
টাকা দিতে
হবে, নইলে
তোর ঘরের
টিন সব
খুলে নেব।
গুঁতা মিয়া চলে গেল। সালাউদ্দিন আকবর নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। সালেহা ফজরের নামাজের দোয়া মনে করে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
রশিদের বউ
এর সিজার
হয়েছে কিন্তু
রক্তশূন্যতার কারণে
রক্ত দরকার। রশিদ
হম্বিতম্বি করে
বাড়িতে ঢুকে
সালেহা কে
বললো
- ভাবি, তোমার রক্তের সাথে আমার বউ এর রক্ত মেলে। তোমাক যাওয়া লাগবে।
সালেহা মনে
মনে কিয়েক্টা
ভেবে বললো-
চলো।
০৭.০৫.২০২১
তালতলা, কুড়িগ্রাম