তিস্তার পাড়ে বুড়িরহাটের বাঁধের কাছে। সেখানে সপ্তাহে দুই একবার খোলা আকাশের নিচে গিয়ে বাঁশিতে সুর তোলেন বাঁধন। বাঁধনের সাথে সাগর ও ছিলো । সাগর বাঁশির সুর পছন্দ করে সেও শিখতে চায়। বাঁধন এখন আর সব সময় বাঁশি বাজায় না। মাঝে মধ্যে তিস্তার পাড়ে আসলে বাজায়। সেদিন রীতিমতো অবাক হওয়ার পালা। হঠাৎ করেই তিনটা মানুষকে দেখেই বাঁধন তিস্তার পাড়ে বাঁশির সুর থামালেন। তার চোখ মুখ মলিন হয়ে গেলো যেন কোনো কিছু হারিয়েছে। সাগরকে বলল বাড়ি যাবো । সাগর সাইকেল হাতে নিয়ে ফাল্গুনের পড়ন্ত বিকেলে বাঁধনের পিছে পিছে আসতে থাকলো। বাঁধনের মুখোমুখি তিনটা মানুষ হতে না হতেই মুখ ফিরিয়ে ওরাও পূর্বদিকে মেঠোপথ ধরে হাঁটতে লাগলো । তার পিছুপিছু বাঁধন। মাস খানেক আগে যার সাথে এতো যোগাযোগ ছিলো সে এখন নাগালের বাইরে। ঈষৎ ব্যাঙ্গ হাসি দিয়ে নিজেকে শান্তনা দিতে চাইলেও সাগরের চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না। সাগর বাঁধনের আটকে রাখা চোখের জলের কারণ খুঁজে। বাঁধনদা কি হয়েছে কিছু তো বলো, অন্যদিন তো সন্ধ্যে হওয়ার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত তিস্তার পাড়ে থাকি। আঙুলের ইশারায় সাগরকে থামিয়ে দেয়।
রাতে বিছানায় শুয়ে মনের কষ্টটাকে চেপে ধরে রাখার অনেক চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। কি করে ভুলে যাবে কুসুমকে। আর কুসুম! এতো তাড়াতাড়ি কয়েকদিনের ব্যবধানে এতো পরিবর্তন হয়ে গেছে। বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছে, নয়তো অভিমান? না না অভিমান এখন আর করবে কিভাবে। কুসুম এর কথা গুলো মনে পড়ে হৃদয় জমিন যেন আধভরা তিস্তার পানিতে ভেঙ্গে পড়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, সেই শব্দগুলোতে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। কার কাছে গিয়ে বলবে যে
আমার বাগের কুসুম কলি, অন্যের ঘরে শোভা পায়৷
সন্ধ্যা থেকে মাথা ঝিম ঝিম করছে বড় ভাবি অল্প স্বল্প জানে, ঘুম যেন আজ বিদায় নিয়েছে নয়নে অশ্রুধারা, ষোড়শীর প্রেমে কত যে জ্বালা বুঝে না প্রেমিক ছাড়া৷ টিনের বেড়ার উপরের অংশ দিয়ে আলো বেরোচ্ছে জননী পাশের ঘরে যদি জেগে যায় তাহলে বাঁধন ঘুমাসনি কেন? খাবার খাইস নি কেন ? বেশি রাত করলে শরীর খারাপ করবে নানাবিধ স্বাস্থ্যমন্ত্রণা দিবেন৷
লিপি ভাবি বলবে খাবার ভালো না লাগলে বিয়ে করে বউ নিয়ে আয়। সে তোকে রেঁধে খাওয়াবে৷ ঘরের ইলেকট্রিক বাতিটা বন্ধ করে মশারি খাটিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরের দিন সকালে স্নান করে ফোন করলো প্রমিতকে৷ প্রমিত ওর ক্লাসের বন্ধু৷ এখন একটা শহরের কলেজে পড়াশুনা করে৷
প্রমিত আজ বিকেল বেলা আসতে চেয়েছে৷ আকাশের সূর্যটার তাপে পরণের টি শার্ট ঘেমে যাচ্ছে৷ তবে কালকের চেয়ে আজ মাথার ঝিমঝিম করাটা থেমেছে৷ দুপুরে তেমন কিছু সংসারের কাজে মনোযোগ দিলেন না৷ লিপি ভাবি বাসি ভাতের থালাটা গরুর চারায় দিলেন তরকারি গুলো ছাঁইগাদার। ওপাশে ছুঁড়ে মেরে ফেলে দিলেন।
বিকেল বেলা একটা টং দোকানে বসে এককাপ চা বিজ্ঞ বয়স্কদের মতো গলায় নিংড়ে ঢালতে ঢালতে প্রমিত এসে হাজির । চা এর অফার দিলো । প্রমিত বাইরে কিছুই গ্রহণ করবে না। প্রমিত বলল
"বাঁধন এখানে বসবি?"
-না আমগাছের তলার দিকে বসলে কেমন হয়?
-হু ভালোই হয়। চল তবে।
- কুসুমের সাথে কলেজে প্রথম পরিচয়। ও আমাকে আর আমি ওকে খুব পছন্দ তারপর ফোনে টেক্স করা কথা বলা ভালো বন্ধুত্ব থেকে কুসুম আমাদের বন্ধুত্বটাকে সম্পর্কে পরিণত করলেন। আমার অসম্মতি ছিল না।
- হু তারপর? সে এখন কোথায়?
- গত মাসের কথা বৃহস্পতিবার প্রাইভেট শেষ করে বাড়িতে ফিরলাম। ঐ রাতেই কুসুম আমাকে ফোন দিয়ে বলল "আমি খুবই অসুবিধায় আছি প্লিজ আমার সাথে কালকে দুপুর বারোটায় দেখা করিও। শনিবার প্রাইভেট এ তো দেখা হবে।সে কান্না শুরু করলো বলল তুমি যদি কালকে দেখা না করো তাহলে আমাকে আর কখনো দেখতে পারবে না। পরের দিন একটা বান্ধবীর বাসায় আমাকে ডাকলো । কুসুম আজ নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। আমি পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলাম। তারপর বললাম, কি যেন বলতে চেয়েছিলে? কুসুম বলল।
- তুমি তো ভালোবাসো আমাকে তাই না ।
- হ্যাঁ । ও আরো পাশে আমার হাত দুটো ওর কোমল হাতে ধরে বলল আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। দর্জিকে জামা বানাতে দেয়ার বাহানা করে। তুমি সারাজীবনের জন্য আমাকে চাও তো আমাকে নিয়ে যাও।
- কুসুম কি বলছো। একবার কি ভাবছো? হ্যাঁ ভেবেছি । প্লিজ, এ কিছু একটা করো। আজ সম্পূর্ণ আমি তোমার। কুসুম আমার মাথায় ছাদ নেই । সব কিছুই জানো তারপর ও এতো তাড়াতাড়ি....আমার কথা শেষ না হতেই কুসুম বলল শনিবার আমার বিয়ে, ছেলেটা ব্যাংকের চাকুরি করে। আমি তোমাকে ছাড়া কিভাবে মেনে নিবো তাকে?
আমি নির্বাক সেদিন আমার উপায় ছিলো না অর্থ ছিলো না। আমি কুসুমের জন্য চোখের পানি আর প্রাণ খুলে দোয়া করেছি। কুসুম বলেছিলো আমি নাকি অন্য রকম। সে আমাকে ঘনিষ্ঠ করে কাছে পেতে চেয়ছিলো । আমিই ফেরায়ে দিয়েছি। প্রমিত তুই বল, প্রেম তো পবিত্র। তার নাম করে কুসুমের পাপড়িতে দাগ টেনে দেই কি করে!
- বন্ধু এতো কিছু হয়ে গেছে একটা বছরে। বাস্তবটা সত্যিই কঠিন। প্রমিত বাঁধনের কাঁধে হাত রেখে আরো বলল নিজেকে প্রতিষ্ঠিত কর। আর কারো পিছনে ছুটিস না। কিরে ধ্যানমগ্ন হলি যে,
- হু । ভাবছি,আমাদের আম গাছের নিচের জমিটাতে গোল একটা বাড়ি বানাবো বাইরে থেকে দেখা যাবে একটা পদ্মফুল। খোলামাঠে চারপাশেই থাকবে ধানের ক্ষেত। গরু, ছাগল ও মাছের খামার করবো। আর খামার বাড়িতে ছবির দেয়াল থাকবে সেখানে নিজের হাতে কুসুমের ছবি এঁকে সেঁটে দিবো। বাধঁনের কথা গুলো মাঠের প্রান্তরে ভাসতে ভাসতে তিস্তার পাড়ে দেখা তিন মানুষে ভাসমান ছবি চোখের কোঠরে জল জমে অস্পষ্ট হয়ে যায়।
১৯/০৯/২০২১