মুর্শিদাবাদ জেলার সাগর দিঘী একটি গ্রামীণ জনপদ।থানা হওয়ার সুবাদে ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো সেজন্য ওখানে ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। তাছাড়া অনতিদূরে সাগর দিঘী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হওয়ায় শহরের রূপ ধারণ করেছে। গ্রামীন হাতপাতাল ও বিদ্যালয়ে মানুষের সঙ্গীত শিক্ষার স্কুল স্থাপিত হয়েছে।
আজকে গীত সাধনা মন্দির সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় ও তার অধ্যক্ষ সম্পর্কে আপনাদের জানাতে চাই।
হ্যান্ডবিল স্কুলের ছেলে মেয়েদের মারফৎ তাদের অভিভাবকদের হাতে পৌঁছাল। এলাকার বেশীরভাগ চাষী,সবাই চাষাবাদ করেন। তাঁরা বললেন তোদের পড়াশোনা, টিউশনি তার উপর গান। কখন তোরা এসব করবি। পাশের গ্রামের এক অভিভাবক গ্রামের সান্ধ্য বৈঠকে একথা পাড়লেন। মণ্ডপে গ্রামের সব পাড়ার মাতব্বর আছেন। মোহন ভট্টাচার্য বললেন আমার মেয়ের ইচ্ছা গান শেখার তাই আপনাদের মতামত নিতে চাই। গ্রামের এক মোড়ল মদন মণ্ডল বললেন - লেখাপড়া বেশি না করে রান্না বান্না শেখা ভালো। তাহলে শ্বশুরবাড়িতে হোঁচট খেতে হবেনা।সুনামের সঙ্গে ভালো গৃহবধূ তকমা জুটবে। আর খামোখা গানের জটলায় পুরে দিলে মেয়ের বদনাম হবে।তার চেয়ে ওপথে না যাওয়ায় ভালো। নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনা।
হঠাৎ ঐ পথ ধ'রে গ্রামের শেষপ্রান্তে অবস্থিত হারু বৈষ্ণব ও তার বৈষ্ণবী দিনান্তে ভিক্ষাবৃত্তি করে বাড়ি ফিরছেন। মোড়ল তাদের বললেন - তোরা তো গান করিস্ । তোদের পেশা এটা । এটা করে তোরা ভিক্ষাবৃত্তি করে সংসার জীবন যাপন করিস্। আচ্ছা এই যে আমাদের গ্রামের সবাই চাষাবাদ করে , তাদের তো ভাতের অভাব নাই। তাহলে এদের ছেলে মেয়ে কি চাষাবাদ ছেড়ে ভিক্ষাবৃত্তি করবে। হায়রে সুখে থাকতে ভুতে কিলায়?যারা হাভাতে তারা গান গেয়ে ভিক্ষা করে দুটো ভাতের জন্য। মা সরস্বতী সবাইকে বিদ্যা ভাগাভাগি করে দিয়েছেন। পড়ুয়াদের জন্য বই, লেখকদের জন্য কলম, বৈরাগীদের জন্য গলা।
বৈষ্ণব বললেন - গান সবার দ্বারা হয়না ,এটা সরস্বতীর কৃপা। আপনি বা আপনারা শেখাবো বা শিখবো বললেই হবে না। সঙ্গীত মানুষকে সম্মান দেয়, লেখাপড়ার চেয়েও সঙ্গীত মানুষের মন জয় করে।
মোড়ল - মানুষের মন জয় করা মানে তো আমাদের ছেলে মেয়েদের উপর নজর। ঐ জন্য তো বলেছি কুনজর থেকে সুনজরে পাত্রস্থ করা ভালো। এতে পাড়ায়, গ্রামে, এলাকায় মুখ দেখানো যাবে না। তাই ওপথে না যাওয়ায় ভালো।
বৈষ্ণব - এক কাজ করুন আপনারা সবাই।দেখে আসুন একবার কর্মকাণ্ড সঙ্গীতের। সঙ্গীতের স্কুল সাগরদিঘীতে আছে।আপনারা রবিবার ছুটির দিন ওখানে সঙ্গীত তালিম দেওয়া হয় দেখে আসবেন। তাহলে বুঝতে পারবেন কিভাবে সাধনা করতে হয় সঙ্গীতের। ভজন সাধন ছাড়া দেব দেবীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না।
মোড়ল সবাইকে বিধান দিলেন সামনের রবিবার সাগর দিঘী গিয়ে দেখে আসবো।
পরের রবিবার মোড়ল সকলকে একত্রিত করে সাগর দিঘী রওনা দিলেন।গানের স্কুলে পৌঁছে দেখলেন স্কুল শুরু হয়ে গেছে! একজন ঘাড়ে লাঙলের জোয়াল নিয়ে শুধুই হা হা হা হা হা করছেন আর সামনের দিকে মাদুরে বসে ছেলে মেয়েরা জোয়াল কাঁধে তুলে হা হা হা হা হা হা করছে।
মোড়ল - স্কুলে বিনা অনুমতিতে ঢুকেই অক্ষয় কুমার খাঁড়াকে বললেন - আপনি কে? অক্ষয় খাঁড়া বললেন - আমি অধ্যক্ষ এই গানের স্কুল পরিচালনা করি। ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষা দিই।
মোড়ল বললেন- এ তো রাখাল বাগালের কাজ লাঙল বাওয়ানো। জোয়াল কাঁধে পড়লেই গোরু মোষ ঠিক চাষ শুরু করে দেবে। শুধুমাত্র হা হা হা করে পাঁচন দেখিয়ে চাষ শেষ করতে হয়। তা বাবা তুমি এই ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া ছাড়িয়ে চাষের কাজ শেখাচ্ছো। আবার টাকার বিনিময়ে। এ শিক্ষা আমরা তাদের যখন তখন দেবো , শুধুমাত্র একটু লেখাপড়া শিখে যোগ বিয়োগ শিখুক। গান শুনেছি বাউল, কীর্তন ,পঞ্চরস, যাত্রা । এ আবার লাঙলের জোয়াল কাঁধে চাষের শিক্ষা। বাবা গলা ফেটে যাবে ! ওসব বুজরুকি করিও না ,এই ছেলেমেয়েদের নষ্ট করিও না। তাও যদি হা কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ করতে তাও পরলোকের পথ সুগম হতো।
সঙ্গীত গুরু অক্ষয় খাঁড়া বললেন - শুনুন যেমন বর্ণপরিচয় , ধারাপাত পড়ে লেখা পড়া শিখতে হয়, তেমনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গেয়ে সুরসাধনা করতে হয়।গলা তৈরি হলেই সব গান অনায়াসে গাওয়া যাবে। এটা জোয়াল নয় ,এটা তম্বুরা বা তানপুরা। এই তারের যন্ত্রের সুরে গলা লাগানোয় সাধনা।
মোড়ল মশাই -জোয়াল তো গলায় ঝোলে তারপর বোঝা টানে বা লাঙ্গল বয়। মুণ্ডুপাত হবে! দেশটা উচ্ছন্নে যাবে ! পূর্বপুরুষের কথা কি ফেলা যায়? প্রবাদবাক্য জ্ঞানী,গুনি,কীর্তন্যা এই তিনজনেই উচ্ছন্ন্যা। আ আ হা হা আ ক'রে আমরা ঠাণ্ডা লাগলে লবন জল গরম করে গার্গেল করি ঠাণ্ডা থেকে গলার সেক দিয়ে আরাম অনুভব করি।আর এখানে হা হা হা হা হারাম যতো সব। চল্ রে সব এই ভাবে ছেলে মেয়ে নষ্ট হতে আমি দেবো না। ছেলেমেয়েদের বয়স হলেই জোয়াল কাঁধে পড়বে। সংসার চালানো শিখবে। গ্রামে এসে মোড়ল ঢেড়ি বাজিয়ে জানিয়ে দিলেন।গান শিখতে যাওয়া হবে না।সময় নষ্ট ও গলা ফেটে চৌচির হওয়ার সম্ভাবনা। ওর চেয়ে রেডিওর পল্লীগীতি শোনা অনেক ভালো।