বাঙালীর প্রিয় কবি মধুসূদন ও তার কবি- মানসপট ।। সুদীপ ঘোষাল



বাংলা ভাষাকে ভালোবেসেছিলেন অন্তর থেকে।তাই বাকদেবীর আশীর্বাদে ধন্য হয়েছিলেন তিনি। ভালোবাসার কেন্দ্রে আছে কবির মাতৃভাষার ও সাহিত্যের উন্নয়নজনিত আত্ম প্রসাদ।ছোটোবেলায় যখন তার কবিতা পড়তাম,হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন.... তখন কোন এক জাদুমায়ায় আচ্ছাদিত হত মন। সামান্য কয়েকদিন তিনি ইউরোপে বাস করলেই কি মন কল্পলোক ইউরোপময় হয়ে যায়।বাল্যকাল থেকেই ভারতবর্ষের জল হাওয়ায় তার বাস।বাংলার পটভূমিতেই এই পন্ডিতের  মানুষ হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি শুরু।আপামর বাঙালি মধুসূদন বাংলা সাহিত্যের এক নবতম সংযোজন।সনেট রচনায় যে বস্তুটি কবি মানসে আবেগের তরঙ্গ জুগিয়েছে তা হল তার প্রতিভার নবতর খেলা। কবির প্রতিভা লীলাখেলার কেন্দ্রেও বাংলার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশিত হয়।চতুর্দশপদী, তাঁর এক অনন্য আবিষ্কার। প্রণাম তাঁর কবি মানসকে।

তাঁর চতুর্দশপদী বা সনেটের মধ্যে তাঁর কবি মানসকে খুঁজে পাই।বিদেশে বাস করেও তাঁর মন পড়েছিলো ভারতবর্ষের মাটিতে,জল হাওয়ায়, নদীপুকুরে,জলডোবায়।এই স্বদেশ পাগল মনটি গড়ে তোলে বাংলার সনেট জগৎ।কবির বিদশবাস না ঘটলে সনেট রচনা হত না। আপন দেশকে ছেড়ে যে বিদেশে বাস করেছে একমাত্র সেই বুঝতে পারবে এই ভালোবাসার যন্ত্রণা। আমি পড়াশোনার খাতিরে গ্রাম থেকে বাবা মা কে ছেড়ে বাইরে কিছুদিন ছিলাম। একবছর পর পর যখন গ্রামের মাটিতে পা দিতাম তখন মনে হত আমি কোথায় এলাম
এই আমার একান্ত আপন বাসভূমি।মাটি নিয়ে সারা অঙ্গে মেখে নিতাম। গ্রামের গাছ গাছালি,বনবাদাড়,জীবজন্তু  নদী, নালা,ডোবা সবকিছুই নিজের অত্যন্ত আপন মনে হত। আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করত না শহরে। এইরকম মন নিয়েই কবির ছটফটানি।দেশে থাকাকালীন তিনি সনেট রচনা নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করেন।তাঁর নানা সৃষ্টি ভিড়ের মধ্যে, একান্ত তপস্যায় নয়।একই সঙ্গে একাধিক রচনা তিনি বলে যেতেন ক্রমাগত।কয়েকজন লিখতেন সেইসব শুনে।তাঁর অনির্ণেয় আন্তর তাগিদ এবং অদম্য সংকল্প সমস্ত কাব্যসৃষ্টির মূল উৎস।দেশে থাকতেই কবি ইতালি ভাষার চর্চা শুরু করেন
।কবি তাসোর মূল কাব্য পাঠ করে অপার আনন্দ লাভ করেন।পেত্রার্ক পড়ে পন্ডিত হওয়ার নিছক আনন্দলাভ নয়, সঙ্গে সঙ্গে তিনি সনেটে হাত পাকিয়েছেন।কঠিন তপস্যার মধ্যে খুঁজে  গেছে পরশপাথর, তাঁর হৃদয়।

তাঁর রচনা কৃষ্ঞকুমারী, এক বিয়োগান্তক নাটক।মাত্র ছয়মাসের মধ্যে লেখেন।একগুচ্ছ গীতিকবিতা লেখেন যাঁর নাম ব্রজাঙ্গনা ও খাঁটি মহাকাব্যের অর্ধেক লেখেন, মেঘনাদবধ।তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে, চলছিলো কবির অমিত্র ছন্দে কাব্যরচনার যুগান্তকারী পরীক্ষা।

মধুসূদনের কবি মানস সম্বন্ধে দুই একটি কথা বলি।নিজে এক মহৎ লোক না হলে কাব্য সৃষ্টির ব্যাপারে বিচার সম্ভব নয়। কবির প্রধান নির্ভর রস।ইতিহাস তাই বলে।কবিতার মধ্যে ব্যক্ত্বিত্বের স্পর্শটুকু প্রয়োজন।এ এক অতি গভীর ব্যাপার।কবিকে আমরা বুঝলাম তাঁর কাব্যে।

সাহিত্য ছিলো আবেগপ্রধান।বাস্তব জীবনের সমস্যা, জীবনের সামগ্রিক আলোচনা, দুঃখ প্রভৃতি নিয়েই সৃষ্টি হত সাহিত্য।আধুনিকতা বলতে কি বোঝায়  গতানুগতিকতার বাইরে যাওয়া।তাহলে কবি মামূলি সাহিত্যপথ একটু নড়িয়ে দিয়েছিলেন বৈকি।বাংলা ভাষার এক অভিভাবকের মত তাঁর আবির্ভাব। ব্যাস,বাল্মিকী,হোমার,ভার্জিল,মিলটন,ট্যাসো প্রমুখ মহাকাব্য রচয়িতাগণ যে জীবনদর্শন রূপায়িত করেছেন পাঠকরা তার সঠিক মূল্যায়ন করেছেন।কবিদের মানসমুকুরের ছাপ তাঁদের রচনাতে পড়েছে।ভাবগভীরতার সঙ্গে প্রতিবিম্বিত হয়েছে তাঁদের কাব্যিক অনুভূতি।কবি মধুসূদন এর ব্যাতিক্রম নন।বহুকালের একঘেয়েমীর অবসান ঘটান দান্তে।দান্তের কবি মানস সাহিত্যের আকাশে স্বমহিমায় দীপ্যমান।সার্বভৌম ভাব সংস্কৃতির এক অদ্ভূত সমন্বয় সাধিত হয়েছে।মহাকাব্যের ঘটনাবিন্যাস,গঠনবৈশিষ্ট্য ও অখন্ত ভাবসংস্কৃতি অক্ষুণ্ণ রেখে চিরনির্দিষ্ট আধারে সমসায়িক ইতিহাসের তীব্র মানসবিক্ষোভ ও আদর্শসংঘাত, দ্রবীভূত গৈরিক প্রবাহের ন্যায় প্রবৃত্তির ধর্মীয় উচ্ছ্বাসে সমস্ত কলা কৌশল সমন্বয়ে সাধিত হয়েছে।

মধ্যযুগের ধর্ম বিশ্বাস ও যাজক তন্ত্রের মধ্যে এক বিরাট আত্মার অধ্যাত্ম আকূতি, স্বর্গনরকের রহস্যভেদী দিব্যদৃষ্টি, দৈববিড়ম্বিত মানবিকতার বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা যে কেমন করে সংকীর্ণ বোতলের মধ্যে বিধৃত হলো তা শিল্পপ্রতিভার এক অপূর্ব বিস্ময়।আমরা কবির মানস পটে সংস্কারমুক্তি ও চিত্তের উদার অগ্রগতির পরিচয় পাই তার মেঘনাদবধ কাব্যে।নবজাগৃতির যুগে মানবচেতনায় এসেছে নব প্লাবন ও নব চিন্তার জোয়ার।মানুষ নিজেকে দৈব নির্ভর না করে অনন্ত সম্ভাবনার প্রতি অনুরক্ত হলো।সেক্সপিয়ার,শেলী,সমারসেট মমের রচনা মানব হৃদয়ের বিচিত্র বিকাশের মধ্যে যে জীবন দর্শনের সন্ধান দিয়েছেন তার প্রশান্ত গভীরতা মানব হৃদয়কে সিক্ত করলো অনিবার্যভাবে।
আমাদের প্রিয় কবি তার উন্মুক্ত স্বাধীন কলমে এঁদের পাশেই আপন প্রতিভার প্রমাণ রাখলেন,ভিন্ন নব জীবনদর্শনে।অষ্টাদশ শতকে সমগ্র ইউরোপের কাব্য সাহিত্যে কবিকল্পনা অপেক্ষা যুক্তিবাদ ও মননশীলতার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়।যুক্তিবাদ ও তার্কিকতা এযুগের সাহিত্যের সাধারণ গুণ হিসাবে প্রকটিত হয়।এই পটভূমিকায় মধুসূদনের আবির্ভাব ও তাঁর কাব্য রচনার পূর্ণ তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে আমার তাঁর কবি মানসের প্রকৃত পরিচয় পাবো।

আপামর বাঙালীর হৃদয়ে আছে প্রিয় কবি মধুসূদনের প্রতি ভালোবাসা।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।