প্রদোষে প্রাকৃতজন: আবহ বাংলার জীবন্ত গল্পগাঁথা ।। আতিক মেসবাহ লগ্ন


লেখক মাত্রই স্রষ্টা; গল্প, উপন্যাস, কাব্য- এসব তাঁর সৃষ্টি। কখনো সৃষ্টির মহিমা ছড়িয়ে যায় স্রষ্টাকে। স্রষ্টা পরিচিত হন তার নিজের সৃষ্টিকর্ম দিয়ে। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ (১৯৮৪) শওকত আলীর (১৯৩৬-২০১৮)এমনই এক বিখ্যাত সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত এই শিল্পী নাম নিলে তাঁর সাথে এই উপন্যাসের নাম চলে আসে। এই উপন্যাসের শক্তিশালী কারিষ্মায় শওকত আলী বনে গেছেন ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন-খ্যাত’ লেখক।

সময় ও ভৌগলিকতার সীমাবদ্ধতায় পূর্ব-বাংলার লেখকদের সৃষ্টি সাহিত্যই বাংলাদেশের সাহিত্য। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের লেখকদের হাতেই বাংলা উপন্যাস প্রকৃত গতিপথ খুঁজে পায়। রচনারীতি ও বিষয়বস্তুর পরিবর্তনে নবারুণের আভা জাগে। নবচেতনার ধারায় দেশভাগ, বাঙালীর আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের বৃহৎ ক্যানভাস, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আবেগ অনুভূতি স্থান পেয়েছে ঔপন্যাসিকদের মন ও মননে।

বাংলাদেশের লেখকরা সময়কে ধারণ করেছেন। লেখনীর দ্বারা প্রকাশ করেছেন দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংকটকে। আলাউদ্দীন আল আজাদ, রশীদ করীম, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, হুমায়ুন কাদির, দিলারা হাশেম, শওকত আলী, রিজিয়া রহমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রমুখ এই ধারার লেখক। নতুন রাষ্ট্র, উদ্বাস্তু গ্রামীণ অবকাঠামো, পারিবারিক জীবন, টানাপোড়ন সবকিছুর আভাসই এসময়ের লেখকদের লেখায় পাওয়া যায়। শওকত আলী নিজেও এই ধারায় উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর সম্পর্কে সমালোচকের মন্তব্য,

“শওকত আলী তাঁর জীবনকে সমকালীনতার কেন্দ্রে স্থাপন করে মানুষের সাথে মেশেন… … … যাপিতজীবনের প্রতিটি সংকটকে তিনি তার লেখনীতে ধারণ করেন। মানবমুক্তি ও জীবনের জয়গাঁথা রচনা করেও তিনি মানুষকে বৈজ্ঞানিক রচনা করে দেখান”।

(তথ্যসূত্র: শওকত আলী জীবন ও শিল্পের উন্মেষ, শাফিক আফতাব, জোনাকী প্রকাশনী, পৃষ্ঠা-২২)

 

শক্তিমান কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর গল্প-উপন্যাস পাঠকমনে নাড়া দিয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই। তাঁর লেখনীতে ফুঁটে উঠেছে সমকালীন সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ, ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা ও ধারাবাহিকতার অনিবার্য পরিণতি। ফলে, তাঁর উপন্যাসগুলো হয়ে উঠেছে মহাকালের জীবন্ত গল্পগাঁথা। একই ধাঁচে লেখকের অনবদ্য সংযোজন ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’।




 

‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ শওকত আলীর সবচেয়ে আলোচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস। গতানুগতিক রাজা-বাদশাহর বদলে এই উপন্যাসে ঠাঁই পেয়েছে আটশ বছর পূর্বের বাংলার প্রাকৃতজনেরা। তৎকালীন সমাজমানসকে তুলে ধরার জন্য লেখক অসংখ্য চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়েছেন, স্থান দিয়েছেন সময়ের আলোকিত মঞ্চে। সুদূর অতীতের প্রেক্ষাপটে উপন্যাস লিখলেও এর নেপথ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাকে তিনি স্বগতোক্তিতেই স্বীকার করেছেন।

ঐ লেখাটা উপন্যাস হয়েছে কিনা জানি না- কিন্তু এটির মধ্যে শুধু ইতিহাসের বাস্তবতাই নয়, প্রকৃত বাস্তবতাও আছে। ৭১ এ শত্রু কবলিত ও আক্রান্ত বাংলাদেশই হল ঐ লেখাটির প্রেরণা এবং একই সাথে বাস্তব উপাদান।

(তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার, নিসর্গ, বগুড়া, শওকত আলী সংখ্যা, বর্ষ-৭, সংখ্যস-১, পৃষ্ঠা-৪)

‘প্রদোষ শব্দের অর্থ সন্ধ্যার পূর্বাবস্থা বা গোধূলী বেলা। উপন্যাসে প্রদোষকাল বলতে দ্বাদশ শতকের শেষের দিকে লক্ষণসেনের অন্তিম সময়কে বোঝানো হয়েছে। আর প্রাকৃতজন হল- নিম্ন শ্রেণির অসহায় ও সম্বলহীন মানুষ। উপন্যাসে সেন-সামন্তশাসিত বাংলার অন্ত্যজ মানুষদের প্রতিনিধিত্বশীল অংশ স্থান পেয়েছেদিনের আলোর মত স্পষ্ট করে। উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে বহুবছর আগের এই জনপদের সামাজিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের স্থলিত অবস্থার এক স্পষ্ট চিত্রদলিল।

ইতিহাসের তিনটি ঘটনাক্রম উপন্যাসে এক হয়েছে। তূর্কীদের বঙ্গ ও গৌড় বিজয়ের অভিযান, তৎকালীন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের সনাতনদের বিরোধ, সামন্ত-মহাসামন্তদের প্রতি জনমনের ক্ষোভের গল্পগুলো এখানে একই মালায় বাঁধা পড়েছে। উপন্যাসের দুটি অংশ- প্রদোষে প্রাকৃতজন আর দুষ্কালের দিবানিশি  জুড়ে আছে শ্যামাঙ্গ, লীলাবতী, মায়াবতী, বসন্তদাস, মিত্রানন্দের মতো অসংখ্য সরল মানুষ। তাদের ইতিহাস ভাঙ্গার লড়াই, তলোয়াড়ের ঝঙ্কার, নিপীড়িত মানুষের বেদনাই এ উপন্যাসের আলোচিত অনুষঙ্গ।

উপন্যাসের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই গুরুগৃহ থেকে বিতাড়িত মৃতশিল্পী শ্যামাঙ্গকে। ব্রাত্যজনের মুখচ্ছবির বন্দনা করে শ্যামাঙ্গের প্রতিবাদ পাঠককে জানিয়ে দিয়েছিল, নতজানু হওয়া শিল্পীর ধর্ম নয়। সেই শিল্প বন্দনাই ছিল শিল্পের ভেতর দিয়ে শ্যামাঙ্গের বিশ্বরূপের সাথে সংযোগ সৃষ্টি এবং রাজশাসনে নিগৃহীত প্রাকৃতজনদের জন্য প্রতিবাদ।

“গুরুদেব, মার্জনা করবেন- এগুলি আমার বহুবর্ষের সাধনার ফল-এগুলি বিনষ্ট করা যাবে না”

(প্রদোষে প্রাকৃতজন)

ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর মধ্যেই শ্যামাঙ্গ, মায়াবতী ও লীলাবতীরা একটি নির্বিবাদ, নিরাপদ প্রত্যুষের অপেক্ষা করে। প্রত্যাশা নিয়ে ছুটে চলার মাঝেই উচ্চারণ করে,

“এই কি মানুষের জীবন? সুখ নেই, স্বস্তি নেই, গৃহ নেই, কেবলই পলায়ন করতে হচ্ছে- এর শেষ কোথায়?”

(প্রদোষে প্রাকৃতজন)

 

বখতিয়ারের আগমনের পূর্বে ইসলাম প্রচারক যবন তথা মুসলমানদের আগমনের বার্তা শওকত আলী মাঝে মাঝেই দিয়ে গেছেন উপন্যাসের পরতে পরতে। অনেকের মনেই তখন যবন মুসলিম পুরুষ বখতিয়ারের স্বরূপ চিত্রায়নে একজন অনুল্লেখযোগ্য কৌতূহলীর মুখে,

“ভয়ানক যবন জাতি শনৈঃ শনৈঃ পূর্বে অগ্রসর হচ্ছে-কখন কী হয়, বলা যায় না। এমত শোনা যাচ্ছে যে, এই রাজমূর্তিমান যম একেবারে। খর্বদেহ, কিন্তু বাহুদুটি যেন ভূমি স্পর্শ করে।”




 

এরকম নানান অভিযোগ আর অত্যাচারের মাঝেও বসন্তদাসের মতো কিছু চরিত্রকে চোখে পড়ে। অত্যাচারী বৌদ্ধ ব্রাহ্মনদের রূখে দিতে সোচ্চার হলেও সমাজ ছিল এক ভিন্ন অস্থিরতায় পুষ্ট। সামন্ত শক্তিবর্মণের কাছে পাওনা চেয়ে বিস্মিত হয়েছেন, ক্ষিপ্ত মনে বিদ্রোহের অনলে পুড়েছেন। সামন্তের এক কথাই যেন তৎকালীন সময়কে ধারণ করে, প্রমাণ করে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব।

“ভবিষ্যতে কথাপি এরূপ বাক্য উচ্চারন করবে না, সামন্ত বা মহাসামন্ত কারও প্ররোচনায় আদেশ প্রদান করেন না”

প্রদোষকালীন সময়ের এরকম হাজারো দূর্বিষহ ঘটনার সাক্ষ্য বয়ে বেড়াচ্ছে শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন। স্বচ্ছ দর্পনের মতো সময়যন্ত্রে পাঠককে নিয়ে যায় আটশ বছর পুর্বের বাংলায়। সেই বাংলার প্রাকৃতজনের প্রতিনিধি চরিত্রগুলো স্বকীয়তার ছাপ ফেলে পাঠক মনে।

 

 

শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজনের সমকালীন গল্প নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র রচনা করেছেন ‘মৃণালিনী উপন্যাস। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করেছেন উপন্যাস ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ যার বিস্তৃতি প্রদোষে প্রাকৃতজনের অনেকটা কাছাকাছি সময়ের ইতিহাসকে অবলম্বন করে। পাল বংশের শাসক নয়পালের আমলের কিছু ঘটনাকে উপজীব্য করে এই উপন্যাস রচিত। ‘বখতিয়ারের তলোয়ার নামে শফীউদ্দীন সরদারও একটি অনন্যসুন্দর ঘটনাসমৃদ্ধ উপন্যাস রচনা করেছেন একই ঘটনার বাতাবরণে। প্রত্যেকটি উপন্যাসই আপন বৈশিষ্ট্যে অনন্য। তবে, শওকত আলীর মত করে নিরেট বর্ণনা খুব কম লেখকই পেরেছেন।

আবহ বাংলার মানুষের অতীতের হাজারো ঘটনাবলীর সম্মেলন এই প্রদোষে প্রাকৃতজন। ঐতিহাসিক পক্ষান্তরে রাজনৈতিক উপন্যাস অভিধা দিয়ে আপন উদ্যোমে উদ্ভাসিত হয়েছেন লেখক শওকত আলী। ইতিহাসকে জীবন্তরূপে পাঠকের হৃদয় পটে উন্মোচিত করেছেন, সাক্ষ্য দিয়েছেন বাংলার সংগ্রামী অতীতের। সর্বোপরি, সেকেলে বাংলার সচিত্র বর্ণনায় প্রদোষে ‘প্রাকৃতজন উপন্যাস’ বাংলাদেশের সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।

লেখক: আতিক মেসবাহ লগ্ন

শিক্ষার্থী

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সহ-সম্পাদক

বর্ণপ্রপাত

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।