ডরাইয়া মরে ।। শাশ্বত বোস


জলা-জঙ্গলে ঘেরা জায়গাটা, মফস্বলের মূল শহরের বাইরে| পুরো এলাকাটার বেশীর ভাগই বাঁশবন, মাঝে দুটো ডোবা, জলা ধান জমি, ভয়ানক সাপের উপদ্রব| পুরো এলাকায় ভদ্র ঘর বলতে দুটি, বাকি সব কিছুদূর অন্তর ধোপাদের বস্তি| জায়গাটা আগে শ্রীরামপুরের ছোটোখাটো জমিদার দে-মল্লিকদের বাগানবাড়ি লাগোয়া ছিল| দীপাবলীর আগের চতুর্দশীর সন্ধ্যেয় গোল হয়ে চ্যাটার্জ্জী বাড়ির ছানাপোনারা গল্প শুনছিল| গোবর আর কাঁচা মাটিতে নিকোনো উঠোনে চোদ্দ প্রদীপ জ্বালাচ্ছিলেন তাদের মা প্রভাবতী দেবী| কার্তিকের হিমেল ঠান্ডা হাওয়ায় ঘরের লম্পটা দপদপ করছে মাঝে মাঝে| অমাবস্যার নিকশ কালো অন্ধকারকে ফালাফালা করে মাঝে দূরে ধোপা বস্তিতে দু-একটা তুবড়ি জ্বলতে দেখা যাচ্ছে| তাকিয়ায় হেলান দিয়ে ফতুয়া গায়ে আধবোজা চোখে গল্পটা বলছিলেন বাড়ির কর্তা শ্রী দীননাথ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়| পাকানো পৈতেটা তাঁর ফতুয়ার ফাঁক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আছে| দীনুবাবুর বড় মেয়ে “মিনু” রান্নাঘরে উনুন জ্বেলে বাবার জন্য চা তৈরী করছে| দীনুবাবুর মোট চার মেয়ে, দুই ছেলে, বাকিরা সবাই আসরে উপস্থিত| পূর্ববঙ্গের বরিশালের বাসিন্দা হলেও, দেশভাগেরও আগে ঠাকুরদা-জ্যাঠামশাইয়ের হাত ধরে দীনুবাবুরা সপরিবারে কলকাতায় পাড়ি জমান চাকরির উদ্দেশ্যে| তাই তাঁদের হাবেভাবে, ঘরানায় বাঙাল ছাপ স্পষ্ট| যদিও তাঁদের কথাবার্তায় বরিশালি অপিনিহিতির সাথে শুদ্ধ বাংলা মিশে জন্ম নিয়েছে বাংলা ভাষার এক নতুন বাগ্ ধারা| এটা ৭৮ এর শেষ দিক, কদিন আগের ভয়াল বন্যা রেখে গেছে ধ্বংসের নির্মম নিদর্শন, গরু-বাছুর নিয়ে বাড়ির ছাদে দিন কাটাতে হয়েছে তাঁদের| বাটি থেকে অল্প মুড়ি নিয়ে চিবোতে চিবোতে দীননাথ বলছিলেন, “মোগো পাশের গ্রাম ‘উদয়হাটি’| তখন গ্রামকে গ্রাম উজাড় হইয়া যাইতো কলেরায়| হেইবারে তেমনি মড়ক লাগছিলো, পুরো গ্রামই প্রায় উজাড় হইয়া গ্যাসে| মোগো গাঁয়েরই ছেলে দুলাল, তার দিদির বিয়া দিসিল উদয়হাটিতে| বহুদিন দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই, তাই হেইবারে গেসিল দিদিরে দ্যাখতে| প্রায় তিন ক্রোশ পথ হাইট্যা যাওন ছাড়া উপায় নাই| পৌছাইলো যখন, তখন হইন্ধ্যা নাইম্যা গ্যাসে| নদীর ধারডাতে দিদিদের বাড়ি, পাশডাতে বাঁশবন| দিদিরে গিয়া দ্যাখল ক্যামন যেন হুকাইয়া গ্যেসে| ভাবল বুঝি শ্বশুর শাশুড়ি খাইতে দেয় না| কিছু কইতে গেলেই দিদি শুধু ফ্যালফ্যাল কইরা মুখের দিকে চাইয়া থাকে, কোন কথা কয় না| দিদির ফ্যাকাশেপানা মুখটা দেইখ্যা কেমন যেন মায়া হয় দুলালের| বাড়ির আর লোকদ্যারও দ্যাখতে পাইতাসে না| দিদি কিন্তু যত্নআত্তিতে ত্রূটি রাহে নাই, সময়ে সময়ে হাত পা ধোয়ার জল, গামছা-কাপড়, জল-বাতাসা সবই গুছাইয়া রাখছে| রাতে খাবার পান্তা আর ইলিশ ভাজা, সাথে চাউম্যার ঝাল রাইধ্যা দিসে| খাইতে বইয়া কেমন য্যান একখান আঁশটানি গন্ধ পাইলো দুলাল| দুলাল কয় 'দিদি নেবু হইলে ভাল হইত'| দিদি উইঠ্যা চইল্যা যায় লেবু আনতে| সময় পার হইয়া যায় দিদি আর আসে না| ঝোড়ো হাওয়ায় পাশের বাঁশবনে বাঁশগুলান ঠোকাঠুকি খাইয়া মরমর শব্দ করতাসে| হাওয়ার দাপটে হ্যারিকেনখান ফড়ফড় করিতে লাগিল| মনটা কেমন ভয় ভয় কইরা ওঠে দুলালের| খাওয়া ছাইড়া উইঠ্যা পরে দুলাল| ঘটিটা হাতে লইয়া হাত ধুইতে যাইবে, এমন সময় বাঁশবাগানে তাকাইয়া চক্ষু কপালে ওঠে দুলালের| দ্যাহে বাঁশবাগানে বাঁশ গাছে উইঠ্যা দিদি লিকলিকে বাঁশের ডগার মতন হাত বাড়াইতেসে পাশের লেবু গাছটার দিকে| কঙ্কালসার পা দুইখান হাওয়ায় দুলতাসে আর ঠোকাঠুকি খাইতাসে বাঁশের কচি আগার সাথে| সেই দেইখ্যা দুলাল পড়ি কি মরি কইরা দৌড় দ্যায় উল্টো দিকের ছিলা দিয়া| চারপাশডায় বাঁশবাগানে লিকলিকে সব হাত পা কাঁপছে শনশন কইরা| দূর থেইক্যা পাতিহালের ডাক ভাইস্যা আসছে| পিছন থেইক্যা আওয়াজ আসছে “অঁ ভাঁইটি, নেঁবু দিয়াঁ ভাঁত খাঁইয়া যাঁ|”
দীনুবাবুর ছোট মেয়ে পৃথা চোখ বড় বড় করে গল্পটা শুনছিল| মেয়েটা বড় রুগ্ন, একবার টাইফয়েড হয়ে গেছে| লিকলিকে প্যাকাটির মতো চেহারা, দুদিকে বিনুনি করা ছোট্ট মায়াময় মুখে ডাগর চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে| মেয়েটা একটু ভীতু প্রকৃতির| দূরের পুকুরটার জলে কালো অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। ঐ পুকুরধারেই সবেদা গাছের তলায় একটা ছোট্ট কুঁড়েঘরে থাকত “ভিখারিনী” তার বুড়ি মাকে নিয়ে। গেল বন্যায় তাদের কুঁড়েঘর ভেসে গেছে| সাপের কামড়ে মারা গেছে ভিখারিনীর মা| ভিখুদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে| কিন্তু বন্যার জল সরে যাওয়ার পরেও সবেদা গাছটার দিকে আর কেউ যায় না বড় একটা| কেউ কেউ নাকি ভিখুর মাকে ঐ সবেদা গাছে দেখেছে সন্ধ্যেবেলা এলো চুল ছড়িয়ে বসে থাকতে| পাড়ার ছেলে শৈলেন একটু ডানপিটে প্রকৃতির| সাহস করে উঠেছিল গাছটায় ঘুড়ি পারতে| প্রায় মগডালে আটকে ছিল ঘুড়িটা| হঠাৎ পা পিছলে মাটিতে পরে যায় ছেলেটি| অত ওপর থেকে পরার ধকল নিতে পারেনি ছোট শরীরটা, কোমর থেকে প্যারালিসিস হয়ে গেছে| পাড়ার এর ওর বাড়ি থেকে হাঁস মুরগী, এর ওর বাগান থেকে ফুল কিংবা পাকা ফল চুরি করার বদনাম ছিল শৈলেনের| ঐ টুকু বয়সেই বেশ ডেপো| পৃথাদের বাড়ির পোষা হাঁসটাকেই চুরি করে মেরে পিকনিক করেছিল শৈলেন রা, পৃথাদেরই বাড়ির পিছনে ফাঁকা জমিতে| পাড়ার সবাই বলাবলি করত ছেলেটার এই বদ স্বভাবের জন্য ভিখুর মা তাকে শাস্তি দিয়েছে| পৃথার চোখ চলে গেল দূরের সবেদা গাছটার দিকে| সেটাকে ঘিরে একটা জমাট অন্ধকার বাসা বেঁধেছে| অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকারে গাছটাকে ঠিক গল্পে শোনা যক্ষিনীর মতো লাগছে| পৃথার মনে হল গাছটা যেন অদ্ভুত রকম স্থির, সেটার গায়ে যেন বাতাস খেলছে না|
হঠাৎ তার মনে হল লম্ফের আলোটা বড় হতে হতে লিকলিক করে লম্বা হচ্ছে আর সরু হাত বার করে তার দিকে এগিয়ে আসছে| সহসা সেও যেন শুনতে পেল সেই অশরীরি কথন, “অঁ ভাঁইটি, নেঁবু দিয়াঁ ভাঁত খাঁইয়া যাঁ”|
ধুপ করে একটা শব্দ শুনে চোখ খুললেন দীনুবাবু| ততক্ষণে বাকি ছেলেমেয়েদের ভেতরও গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে, জটলার দিকে তাকিয়ে বুঝলেন তার ছোট মেয়েটা গল্প শুনে ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে| চিৎকার করে প্রভাবতীকে ডাক দিলেন তিনি, “মিনুর মা, শিগগিরি জল লইয়া আইস”|
প্রতিপাদে চ্যাটার্জ্জী বাড়িতে বাঙাল রীতি মেনে মহাসমারোহে ভাইফোঁটা হত, কষ্টশিষ্টের সংসারেও আয়োজনে কোনো ত্রূটি রাখতেন না আমাদের দাদামশাই |পরবর্তীতে আমাদের সময়ে সেই ভাইফোঁটা হত দ্বিতীয়ায়, ঠিক যেমন ঘটিদের হয়| আমার মায়ের কথায়, “বাবা মারা যাবার পর ঘটি পাড়ায় ঘটিদের সাথে মিশে গেছিলাম”| মায়েদের সময় দ্বিতীয়ার দিন মাটিতে আসন পেতে সব ছেলেমেয়েদের বসিয়ে দাদামশাই গণ্ডূষ করাতেন হাতে ধান-দুব্বো আর শিশির দিয়ে| নিজে শ্বেতশুভ্র বসনে তাকিয়ার উপরে বসে জোরে জোরে মন্ত্র পড়তেন
“ওঁ অন্নপতেঃন্নস্য নো দেহ্যনমীবস্য শুষ্মিণঃ
প্র প্র দাতারং তারিষ ঊর্জং নো ধেহি দ্বিপদে চতুষ্পদে।।“
আর তার ছেলেমেয়েরা মুখে মুখে সেই মন্ত্র আওড়াত, সব মিটে গেলে প্রত্যেকের হাতে একটা করে মিষ্টিভর্তি থালা দিতেন আমাদের দিদিমা প্রভাবতী দেবী| ছোট ছোট ছেলে-মেয়েগুলো নিজেরা ভাইফোঁটার মন্ত্র বানিয়েছিল, "দ্বিতীয়ায় দিয়া নিতা, আমি খাবো গোটা গোটা"| মিষ্টির প্লেটটা ধরে নিজের মুখে সেই মন্ত্র আওড়াতো সব|
এসব কথা বলতে বলতে স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েন আমার মা|
“বাবার আমার খুব সাহস ছিল| আর আমি ছিলাম ততোধিক ভীতু| একবার মাথার এলো চুল উল্টো করে মাথার পেছন দিক থেকে সামনে ফেলে, লাল পেড়ে শাড়ি পরে, মেজদি এমন ভয় দেখিয়েছিলো, আরেকটু হলে ভিরমি যাই আর কি! বাবার মুখে অঁ ভাঁইটি র গল্প শুনে  আমরা ভাইবোনেরা বাবার সাদা পাঞ্জাবির হাতায় হাত গলিয়ে কত ভয় দেখিয়েছি একে অন্যকে| ওটা আমাদের একটা খেলা হয়ে গেছিলো| কত বড় বয়স অবধি রাত্রিবেলা ঘরের আলো বন্ধ করে একলাফে মেঝে থেকে খাটে উঠতুম| মনে হতো এই বুঝি খাটের তলা থেকে বেরিয়ে এসে সাদা ভূত আর কালো ভূতে পা ধরে টানলো|” কথাগুলো শেষ করে আপনমনে হেসে ওঠে মা| ঠিক যেন একটি শিশুর মেয়েবেলার দিনযাপনের ছবি ফুটে ওঠে তাঁর মুখের প্রতিটি কোণায়|
“আমার বাবা খুব ছোটবেলায় মা কে হারিয়েছিল তো, তাই আমাকেই মা বলে ডাকত| খুব ভালোবাসত আমায়| পুজো পার্ব্বণে ভাইবোনের মধ্যে জামা আসবে শুধু বড় মেয়ে আর বড় ছেলের| আর আমি বায়না করতাম বলে আমার জন্য আসবে একটা| বাকিরা কেউ পাবে না| আসলে আর এম এসের কেরানীগিরি করে অতগুলো পেট চালানোই তো দুষ্কর হতো| সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫ টা অবধি অফিস করে তার পর আবার ওভারটাইম, তাতেও টেনেটুনে সংসার চালাতো বাবা|”
বেশ বুঝতে পারি ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করতে করতে আমার মা ফিরে গেছে স্মৃতির সরণির উপান্তে, ঠিক যেখানে সযত্নে রক্ষিত আছে তাঁর বড় আদরের আশ্রয়, তাঁর একান্ত নির্ভরতার ধন, বটবৃক্ষ সম পিতার সকল স্মৃতি। যদিও খুব বেশিদিন সেই নিশ্চিন্ত আশ্রয় আমার মা এর কপালে জোটেনি, খুবই ছোট বয়সে নিজের বাবাকে হারিয়েছে|
“বাবা আমার বেশ একটু গোলগাল, ফর্সা, ছোটোখাটো দেখতে ছিল| পেটের কাছে চামড়াটা তো পুরো বাঘের পেটের মতন নরম ছিল| তাই বাবার ডাকনাম ছিল ঠাকুর| সকালে ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে, পায়ে নিউ কাট জুতো গলিয়ে যখন বাবা অফিস যেত পুরো মনে হতো আর বাংলার জমিদার| বাবা বলত একবার বাবাদের দেশ বরিশালের ঝাল কাঠিতে খাটো ধুতি পরে সব ছেলে ছোকরারা বাতাপী লেবু নিয়ে মাঠে ফুটবল খেলছে| তখন গ্রামকে গ্রাম কলেরায় উজাড় হয়ে যেত| সেবার বাবাদের গ্রামেও একই অবস্থা, সন্ধ্যে হলেই ভূতের ভয়ে বাড়ি থেকে আর কেউ বেরোয় না| সেদিন খেলতে খেলতে অন্ধকার প্রায় হয় হয়| হঠাৎ পায়ের লেবুটা চলে গেল মাঠের পাশের কলাবাগানে| বল আনতে আর কেউ এগোল না, সবাই একে ওকে ঠেলছে| হঠাৎ দেখে দূরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে একটা বউ ছায়ার মতো হাতে করে আঁচলটা টেনে কোমর দুলিয়ে নাচছে আর হাওয়ার তালে তালে তার পুরো শরীরটা দুলে উঠছে| সূর্যের আলো তখন দিগন্তে মিশেছে| সেই আলো আঁধারির আবছায়াতে ওই দৃশ্য দেখে বাকি ছেলেপুলেরা তো উল্টো দিকে দে ছুট| ছুটতে ছুটতে তো একটা ছেলে ভিরমি খেয়ে পরে গোঁ গোঁ করতে লাগল| বাবা কিন্তু সাহস করে মাটি থেকে একটি শুকনো ডাল তুলে সেই দিকে এগিয়ে গেল| পেছন থেকে কেউ কেউ বলে উঠল “ঠাওরে যাইও না, চইল্যা আইস”| বাবা কোন দিকে কান না দিয়ে সোজা এগিয়ে গেল| ছায়াটা থেকে যখন বাবা ঠিক এক হাত দূরে, সজোরে ডালটা দিয়ে এক বারি মারল ছায়াটার উপর| অমনি দুটো কলাগাছের বড় পাতা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল| সন্ধ্যের চাঁদের আলো মাঠের ধারে খালের জলে পরে ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে| সেই আলোতে ওই কলাগাছই এই ভ্রমের কারণ| বাবা বলত, আমাগো দ্যাশে পোলাপান সব ডরাইয়া মরত, কেউ আর আগাইয়া দ্যাখে না, হেইডা আসলে কি? যম? না যমডার পুত| বলেই হো হো করে হেসে উঠত|”
বলতে বলতে কিছুটা সময় আনমনা হয়ে পরেন মা| বয়সের বলিরেখা সারা মুখমণ্ডলে ছাপ রেখেছে তাঁর| অস্পষ্ট ঘোলাটে চোখে সিলিং পাখাটার দিকে তাকিয়ে থাকেন একমনে কিছুক্ষন| স্পষ্ট বুঝতে পারি বাস্তব আর পরাবাস্তবের মাঝে এক ক্ষণস্থায়ী সাম্যালয়ে বিরাজ করছেন আমার মা| চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তাঁর ক্ষীণ অশ্রু ধারা| বাঁ হাতের তালু দিয়ে সেটা মুছে মা বলতে থাকেন, “গল্পটা কিন্তু এখানেই শেষ না| সেদিন বাবাও সত্যি ভূত দেখেছিল| আসলে বাবারা খুব সৎ নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিল| ভোরে উঠে গায়েত্রী মন্ত্র জপ না করে মাটিতে পা ফেলতো না| ও দেশে থাকার সময় বাড়ির নারায়ণ মন্দিরে শালিগ্রাম শিলায় তুলসী না দিয়ে কেউ জল গ্রহণ করতো না| বাবা বুঝতে পারত কোনো কিছু অতিলৌকিক উপস্থিতি| যা কেউ দেখতে পেত না, কেউ বুঝতে পারত না, আমার বাবা ঠিক টের পেতো| সেদিন সেই জ্ঞান হারানো ছেলেটাকে অজ্ঞান অবস্থায় ধরাধরি করে বাকিরা বাড়ি দিয়ে এসেছিল| বাবা খালের জলে পা ধুয়ে বাড়ি ফেরার সময় দেখে এক বিধবা মহিলা চুল ছেড়ে খালের পাড়ের নৌকা বাঁধার ঘাটে, জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে, মাথার চুল খালের কালো জলে মিশে এক অব্যক্ত বেদনা ফুটিয়ে তুলেছে, চারপাশের হাওয়ায় ভেসে আসছে এক অদ্ভুত ডাক, ও চানু জল দে, বড় তেষ্টা পাইসে|"
 
আমাদের পুরোনো ঘরটার সিলিঙের পলেস্তারা খসে পরে তখন তৈরী করেছে বিশ্ব মানচিত্রের এক আজব নকশা। একটি কল্পনা প্রবণ মন সেই দৃশ্য সম্ভারে ভর করে আপন মনগাঁথায় কত সহস্র শব্দ রচনা করতে পারে, সৃষ্টির নিঃসীম ছন্দে এঁকে ফেলতে পারে কাব্যিক জীবনের এক অমোঘ এপিটোম| ষাটের কোটায় পৌঁছে আমার মা সেই ভাইফোঁটার সকালে তখন রচনা করে চলেছেন নিজ শৈশবের এক আশ্চর্য্য আরব্য রজনী| চারপাশ থেকে ভেসে আসছে শঙ্খ- উলু ধ্বনি| আমাদের ফোঁটা উঠে গেছে সেইবছর থেকেই| ভাইবোনেরা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে দেশে বিদেশে| গেলো বছর ভাইফোঁটায় মায়ের হাত থেকে ফোঁটা নেওয়া আমার বড় মামা, গত হয়েছেন শেষ বৈশাখে| মাতৃকুলে আমার আর কেউ নেই এই এক মা ছাড়া|
“কথাগুলোকে মিথ্যে ধরি কি করে বল? একবার তো ওপারে থাকতে ভোররাতে আমার বাবা শ্রীকৃষ্ণের পা দেখেছিলো| রাঙা দু খানি পায়ে ঝরে পরছে ভোরে সদ্য ফোটা ফুল| বাবা আমার সত্যিই বুঝতে পারতো এসব|” আহ্লাদী মা আমার ততক্ষনে আবার ফিরে গেছে স্মৃতি-তটিনী  ওপারেদীর্ঘ্য দিনের ডায়াবেটিস থেকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স্বরূপ আসা “শর্ট টার্ম মেমরি লস” কিন্তু হরণ করতে পারেনি মায়ের এই একান্ত আপন মধুভান্ড| মায়ের ঝাপসা চোখ তখন আবার আনমনা| শূন্যে তাকিয়ে সেদিনের ছোট্ট পৃথা যেন দেখতে পায় খাটের উপর তার বাবা স্থুল উদর-সম্বলিত মেদবহুল শরীরে বাবু হয়ে বসে, পৈতেটা দু হাঁটুর মাঝে নিয়ে পাঁক দিচ্ছেন “কাশ্যপ, আবৎসার, নৈদ্রুব, শ্রী দীননাথ চট্টোপাধ্যায়, দেবশর্মন..”| আর মেদবর্তী লোলুপ গন্ডদেশযুক্ত মায়াময় মুখটিতে ক্ষুদ্র দুটি চোখে স্নেহভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলছেন, “মাইয়া আমার ডরাইয়া মরে|”

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।