বিছানায় পা ছড়িয়ে বাতের ব্যথায় ফোলা মালাইচাকি তে হাত বোলাতে বোলাতে হাঁক পাড়লো ঠাকুমা,,
" ভোম্বোওওওল,, কোথায় তুই ? "
ভোম্বোল ঠাকুমার আদরের নাতি। সে তখন ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে ব্যস্ত। ঠাকুমার ডাক কানে যেতেই ভীষণ রকম বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে বললো,,,
" আমি এখন ঘুড়ি ওড়াচ্ছি , যেতে পারবো না যাও,,,। "
" বেশ, আসতে হবে না। তোর বাবাকে বল আমি ডাকছি "
" বললুম তো ছাদে আছি,,, তুমি ডাকতে পারছনা,, আমি পারবো না যাও। "
ভোকাট্টায়ায়ায়া,,,,ভেসে এলো একপাল কচি কন্ঠের সমবেত চিৎকার।
আসলে এটাও ছেলে কে ডাকার একটা মোক্ষম কায়দা।
আজ রবিবার। ছুটির দিন। সুতরাং আদিত্য বাড়িতেই আছে কিন্তু ডাকতে ইচ্ছে করলেও ইতস্তত বোধ বাধা দিচ্ছে কারণ নিয়মমাফিক গতানুগতিক ছুটির দিনের দুপুরে সানডে চিকেন দিয়ে ভাত মেরে বউয়ের পাশে শুয়ে হলিডে উৎযাপন বাঙালির বেশ প্রাচীন আরামপ্রদ অলস রীতি।
সময় কালে ঠাকুমাও এই রীতির বাইরে ছিল না।
সেসব এখন সুদূর অতীত হলেও স্মৃতি বিট্রে করে না।
রীতি রেওয়াজ পরম্পরায় হাঁটে। সুখের বিঘ্ন ঘটাতে নেই।
ঠাকুমার সংস্কার এবং অভিজ্ঞতা এই কথাই বলে। সেই কারণেই ভোম্বোল কে ডাকার ছলে নিজের কাজ হাসিলের এই অনন্য সাধারণ উপায় অবলম্বন।
আশ্বিন প্রায় শেষ। হাতে মাত্র দুটো দিন। তারপরেই কার্তিকের শুরু।
ছেলে আদিত্য কে ডাকবার কারণ ঠিক সেখানেই।
এ বাড়িতে বউ হয়ে আসা ইস্তক ইলা দেবী মানে ঠাকুমা দেখে আসছে। কার্তিক মাসের প্রথম দিন থেকে সম্পুর্ণ মাস ধরে ছাদে চিলেকোঠার ঘরের মাথায় খোলা আকাশের নীচে সারারাত ধরে টিমটিম ক`রে জ্বলে একটি বাতি। আকাশ প্রদীপ।
ঠাকুমার বাপের বাড়িতেও ছিল এই প্রথা। প্রাচীন প্রচলিত সংস্কার। এখন প্রায় বিলুপ্ত পথের যাত্রী। আকাশ প্রদীপ নাকি অতীত হয়ে যাওয়া পূর্বপুরুষদের আলো দেখায়। তাঁরা নাকি এইসময় এই পথে চলাচল করেন। তাঁদের আশীর্বাদ বর্ষিত হয় বর্তমান প্রজন্মের ওপর।
কেজানে বাপু হয় কী হয়না ! বিতর্কের শেষ নেই। তাছাড়া অত জেনেই বা লাভ কী! বিশ্বাসে মিলায় বস্তু,,,,
ওরে আদিত্য শোন বাবা , তুই কাজের মানুষ , পাঁচ কথায় ভুলে যাবি তাই আগে থেকেই বলে রাখলুম। আসছে মঙ্গলবার কার্তিকের পয়লা। ঐ পাঁজী ক্যালেন্ডারে দেখলুম।
তুই বাবা ওই চিলেকোঠার মাথায় বেশ উঁচু করে আকাশ প্রদীপ লাগানোর ব্যবস্থা করে দিস বাবা।
ঠিক তখনই আদিত্য র মোবাইল ফোন বেজে উঠল। সে ফোনে কথা বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ঠাকুমা সেই দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে মুখে জিভ দিয়ে চুক ক`রে আওয়াজ করে হাতের তালু উল্টে দিয়ে উচ্চারণ করলো,,
যাঃ,,, কেজানে কথা গুলো ঠিকমতো শুনলো কিনা !
এখন তো আগের মতো মাটির জাগ হাঁড়ির মধ্যে গাওয়া ঘি দিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে সরা সামান্য ফাঁক রেখে ঢাকা দিয়ে সেই উঁচু তে ঝুলিয়ে রাখা হয়না,,
প্রতিদিন সাঁঝনামার আগেই প্রদীপে ঘি ঢেলে আকাশ প্রদীপ দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।
এখন সেসব কোথায় ! এখন তো একটা কম পাওয়ারের রঙিন ডুম বাঁশের মাথায় লাগিয়ে বেঁধে দিলেই ব্যস মিটে গেল। সুইচ টিপলেই প্রদীপ জ্বালা।
ঠাকুমার অবিশ্যি এতে আপত্তি নেই। আপত্তি থাকলেও কিছু করার ছিল না। যুগের বাস্তবতা মেনে নিতেই হয়। যখন যেমন তখন তেমন পলিসি।
যদিও ঠাকুমা জানে এইসব লোকাচার প্রায় শেষের পথে। তার জীবনের সঙ্গেই বিদায় নেবে এই প্রাচীন অবিশ্বাস যুক্ত প্রথা।
ভাবে বয়েই গেলো তাতে। কি-ই বা এসে গেল। মরণের এই এক বিশেষ সুবিধে। না চোখে দেখা , না কানে শোনা। যে যেমন পারে থাকুক। শুধু একটাই প্রত্যাশা , সব্বাই ভালো থাকুক শান্তি তে থাকুক।
তবে এটাও তো ঠিক , ভালো থাকা যত শক্ত , ভালো রাখা তারচেয়েও বেশী শক্ত।
ঠাকুমার শাশুড়ী ঠাকুমাকে বলেছিলেন,,,
দ্যাখো বউমা , লোকাচার মানা ভালো তাতে মন শুদ্ধতা পায় নম্র বিনয়ী হতে শেখায়। সহিষ্ণুতা সৃজনশীল ধারায় প্রবাহিত হয় জীবন। সেকি বড় কম কথা বউমা!
ঠাকুমা টের পাচ্ছে সংসারে সুখের তান্ডবে শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে। সহিষ্ণুতার অভাব ঘটছে। কেউ কাউকে মান্যতা দিতে কার্পণ্য করছে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের লুকোচুরি খেলা চলছে। ভালবাসা বিদায় নিচ্ছে।
আজ পয়লা কার্তিক।
বেলা ছোট হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা নেমেছে। ভোম্বোল ছাদের সিঁড়ির পাশে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
ভোম্বোল আজ ঘুড়ি ওড়ায়নি। ওর বন্ধুরাও কেউ আসেনি। দুপুরে মন্টু কাকু চিলেকোঠার ঘরের মাথায় বেশ অনেকটা ওপর দিকে আকাশ প্রদীপ লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছে। এখন সাঁঝেরবেলায় নীল বাতির আকাশ প্রদীপ ঝকঝক করে জ্বলছে। অনেকটা তারা র মতো রং। মনে হচ্ছে যেন আকাশ থেকে একটা তারা ভোম্বোল দের বাড়ির একেবারে কাছে এসে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে।
হয়তো , অনেক রাতে সব্বাই যখন ঘুমে অচেতন হয়ে যাবে ঠিক তখনই সে নেমে আসবে চুপিচুপি। নিঃশব্দে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যাবে ঠাকুমার বিছানার পাশে।
ঠাকুমা নেই । শুধু শূন্য বিছানা পড়ে আছে।
আর আছে পরম্পরায় হেঁটে চলা প্রথা। ঠাকুমার বিশ্বাসের সাঁঝবাতি
" আকাশ প্রদীপ "।
সম্ভবত শেষ বারের মতো ।