বাসের চলতি দুলুনিতে একটু অভ্যস্ত ঝিমুনি এসে গিয়েছিল হরেনবাবুর| ছেলেকে নিয়ে করুণাময়ী থেকে একটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সরকারি (বা আধাসরকারি) বাসে উঠেছেন তিনি| নামেই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত| ফেব্রুয়ারীর শুরুর এই পড়তি শীতে জানলা দিয়ে গায়ে এসে লাগা ঝাঁঝাঁ পরা রোদ্দুরে বেশ ভালোই তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে| সেই কখন থেকে ঢিকঢিক করে বাস এগোচ্ছে, আর মাঝে মাঝে মসৃণ রাস্তার বুকে, সদ্য যৌবনা কিশোরীর গালের ব্রণর মত গর্তে তার চরণগুলি পরে তীব্র ল্যান্ডফল অনুভূত হচ্ছে| হঠাৎ একটা চেঁচামেচিতে হরেনবাবুর দিবানিদ্রা ভঙ্গ হল| চোখের চশমাটা নাকের ডগায় তুলে তিনি দেখলেন বাসের ভেতর এক বিহারী ছোকরার সাথে এক মাঝবয়সী লোকের তীব্র বিতন্ডা বেঁধেছে|
-“হাম মারকে তুমহারা মুখ তোড় দেগা| শালা বিহার সে আকে ইহা মস্তানি করতা হ্যায়? বুরবাক কাঁহিকা!!”
-“আরে দাদা, হাম বিহার সে আয়া, অর আপ কেয়া বাংলাদেশ সে আয়া? চুপচাপ সিধা খাড়া রাহিয়ে!!”
-“তবে রে বেটা লিট্টিখোর!! বুরবাক বিহারী, এক থাবড়ায় তোমাকে বিহার বাপাস ভেজ দেগা, সমঝা??”
-“আপ মুঝে মারেঙ্গে, অর হাম চুপচাপ খারা রাহুঙ্গা ইধার?”
-“কি করবি রে বিহারী? ক্যায়া করেগা?”
-“হাম ভি মারেঙ্গে, মারামারি চালতা রাহেগা|”
কিছুক্ষন এরকম “বাংলা পক্ষ” মার্কা উস্কানি চলার পর সেটা থামতে বাধ্য হলো, বয়স্ক বাঙালি ভদ্রলোক বাস থেকে নেমে যাওয়ায়| সঙ্গে তার অল্পবয়সী মেয়েও ছিল| বাবার ওপর রাগ দেখিয়ে সে তখন আগে আগে হাঁটা দিয়েছে| ছেলেকে নিয়ে উঠে পড়লেন হরেনবাবু| কাঁকুড়গাছি ঢুকতে আর বেশী দেরী নেই| ছেলেটাকে নিয়ে হয়েছে জ্বালা| আধদামড়া ছেলে, ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বসে আছে| বাপের পয়সায় কেনা ফোনে ফেসবুক আর মেয়েদের সাথে আলগা পিড়িত, এই তার কর্ম| ইদানিং কোন মেয়ের সাথে চক্কর টক্কর চলছে মনে হয়|
“ধরতে পারি, মেরে ঠ্যাং ভেঙ্গে দেবো একেবারে| খানেকা ঠিকানা নেই শোনেকা ধান্দা|” সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বড় রাস্তা ছাড়িয়ে সরু গলি ধরেন হরেনবাবু| ছেলে বাপের কয়েক পা পিছনে হাটছে| আজ এই ছেলেকে নিয়েই গিয়েছিলেন তথ্য প্রযুক্তি পাড়ায় একটা ছোটোখাটো চাকরির ইন্টারভিউ দিতে| হারগিলগিলে চেহারা নিয়ে হরেন বাবুর দিকে দাঁত বের করে হাসতে থাকা গলি টার শরীর বরাবর হাঁটতে হাঁটতে পাড়ার লাল রঙের পার্টি অফিসটার দিকে চোখ গেলো হরেনবাবুর| হঠাৎ করেই বাড়িটার সামনে বেশ কয়েকজন নমস্য ব্যক্তির ইয়া বড় বড় ফ্লেক্স টাঙানো হয়েছে| একরাশ কৌতূহল আর বিসর্গমার্কা শ্রদ্ধা মেশানো, একাদশীর কাস্তে মার্কা চাঁদের মতো মুখ করে হরেনবাবু ছবিগুলির দিকে তাকিয়ে রইলেন| সর্বহারার মাসিহা এইসব আন্তর্জাতিক তারকাদের বড় চেনা চেনা ঠেকে তাঁর| আপনমনে বলতে শুরু করেন, “মার্কস..অ্যাঙ্গেলস..লেনিন..”| ব্যস, হরেনবাবুর বিদ্যের দৌড় ফুরোয়| সর্বশেষ ছবির উন্নত সুঠাম দেহের পুরুষটিকে আর চিনে উঠতে পারেন না তিনি| ভদ্রলোক ভীষণ উদ্ধত ভঙ্গিতে সামনের দিকে মুষ্ঠি পাকিয়ে যেন কিছু বলতে চাইছেন| হরেনের ভীষণ চেনা চেনা মনে হয়, কিন্তু ঠিক চিনে ওঠা হয়ে ওঠে না| সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে সবিনয়ে তিনি প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দেন, “ইয়ে…মানে দাদা, উনি কি মুসোলিনী?”
হরেনের আঙুল নির্দেশ করে সেই সুপুরুষ ব্যক্তির ছবিটি র দিকে| ভদ্রলোক হরেনবাবুর প্রশ্ন শুনে হাতের সিগারেট টা শেষ করে, সেই হাতটা নিজের পুরু গোঁফে একবার বুলিয়ে নিয়ে, মহাজগৎের শ্রেষ্ঠ অজ্ঞানী, অকিঞ্চিৎকর জীবকে সামনে পেয়েছেন এমন ভাব করে, তাচ্ছিল্যভাবে উত্তর দেন “দোর মশাই মুসোলীনি কেন হবে? উনি তো স্ট্যালিন|”
আসলে ছবির ভদ্রলোকের সামনের আকাশের দিকে মুষ্টিবদ্ধ হাতটা দেখে হরেনবাবুর মনে মুসোলিনী নামটা এসেছিল| যে যাই বলুক, ভদ্রলোককে মুসোলিনী ভাবতে অসুবিধাটা কোথায়!! বেশ যুতসই লাগ ছে না নামটা ছবিটার সাথে!!
বাড়ি ফিরে আকাশ সমান বিরক্তি আর হতাশা ছুড়ে দেন হরেনবাবু ছেলেটার দিকে| ডাস্টবিনে দলাপাকানো ছানার মতো সেগুলো ঘুরতে থাকে বাড়িময়| “ছেলেটা কোনো কম্মের নয়| রাতদিন খালি মোবাইল নিয়ে খুটুর খুটুর|” বাড়িতে কম্পিউটারটা পরে আছে, সেটা আজই খোলা দরকার| ভীষণরকম দরকার| স্ট্যালিন ভদ্রলোককে নিয়ে ঘেঁটেঘুঁটে ছোটোখাটো একটা থিসিস আজই করে ফেলতে হবে তাঁকে| আসলে বিকেলের ঘটনাটা হরেনবাবুর মতো এক ছাপোষা কেরানীর আজন্ম অধিকার “সাধারণ জ্ঞানের স্বল্পতা” র সাথে তাঁর মধ্যবিত্ত ইগো কেও আঘাত করেছে| আন্তর্জাল ঘাঁটতে ঘাঁটতে হরেনবাবু আবিষ্কার করেন তাত্ত্বিক ভাবে ওই ছবিটির খুব ভুল নাম তিনি কিছু দেননি আদপেই| ক্ষমতার উৎসই আসলে একনায়কতা| যুগে যুগে সেটা সর্বত্র সত্য| আকণ্ঠ সাম্যের পূজারীরা যদি তাঁকে আড়ম্বরে এনে পুজো করতে পারেন, তবে হরেনবাবুর মত লোক, কেরানীগিরি আর জীবনসমুদ্রের ছোটোছোটো না পাওয়ার হিসেব রাখতে রাখতে যাঁর জীবনটাই হয়ে গেছে, সন্ধ্যের নিমতলা ঘাটের অন্ধকার পিছল সিঁড়িটার মতো, তাঁর পক্ষে নিজের সীমিত জ্ঞানের ভাঁড়ার থেকে একটা যুতসই নাম কাউকে দিতে অসুবিধেটা কোথায়?? ইউ টিউবের বিভিন্ন ভিডিও দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা অ্যাড ভেসে এল পিতামহ ডেস্কটপটার ঝাপসা হয়ে যাওয়া স্ক্রিনে| যেন কোনো আলাদিনের দৈত্য আরেকটা জ্ঞানের চিরাগ নিয়ে এল হরেনবাবুর চোখের সামনে| ভ্যালেন্টাইন দিবসের উপহারের জন্য মেয়েদের পছন্দের নানা জিনিসের ই-কমার্স সাইটটা যেন প্রেয়সীর মনলাভের সোহাগী কামধেনু|
নাহ, এই ভ্যালেন্টাইন ব্যাপারটা খুব বিশেষ অপরিচিত নয় হরেনবাবুর কাছে| আজকালকার ছেলে ছোকরা মহলে এমনকি নিজের বাড়িতে যে রত্নটিকে পুষছেন তিনি, তাদের ধাতে পরে দিনটির তাৎপর্য্য বিশেষ, তার নিরেট মনেও প্রবেশ করেছে, স্তব্ধ দুপুরের বেলোয়ারী দখিনা হাওয়ার মতো|
সেদিন রাতে নিজের বত্রিশ বছরের দাম্পত্য সঙ্গিনীর সাথে বিছানায় শুয়েছিলেন হরেনবাবু| হালকা করে গায়ের চাদরটা টেনে নিলেন, এক লপত আলগা আরামি উষ্ণতার জন্য| সন্ধ্যে থেকে পাশের জন তপ্ত চাটুর মতো ছ্যাঁকছ্যাঁকে হয়ে আছেন| অবশ্য এ গরমের ওষুধ হরেনবাবুরও মোক্ষম জানা আছে| আলতো করে মাথার বালিশের তলা থেকে মোহিনী জর্দার কৌটোটা বার করে স্ত্রীর মুখের সামনে ধরলেন তিনি| ব্যস তারপর ফস করে বলে বসেন, “উইল ইউ বি মাই ভ্যালেন টিন? মানে ইয়ে ভ্যালেস্টাইন, দুত্তোরি নিকুচি করেছে, পেটে আসছে জিভে আসছে না, মানে ভ্যালেন স্টালিন??”
এই বিপুল স্থিতি বিভ্রাটের উত্তরপর্বটি সহজেই অনুমেয়| ফুটন্ত তেলে যেন লঙ্কা ফোড়ন পরলো| একদা ধ্রুপদী কন্ঠী, ত্রিশ বছরের সংগ্রামী সংসার জীবনে ক্রমাগত ধনতান্ত্রিক শোষণ ও পেষনের ফলে, একটি বাঁজখাই ঈষৎ কর্কষ শব্দযন্ত্রে পরিণত হয়েছেন| সেই ষড়যন্ত্রে মৃদু কম্পন তুলে ভেসে এল কঠোর নির্ঘোষ, “আ মরণ, বুড়ো মিনসের আদিখ্যেতা দেখো!! রস কত!! বলি মাসের মাঝখান হতে চলল, এরই মধ্যে মাসকাবারি শেষের পথে, সে খেয়াল আছে?? কাল সক্কাল সক্কাল বাজার দোকান করে, অফিস ছুটবে| এখন ঘুমাও”|
ততক্ষণে মেঘ জলহীন বসন্তের বিরহী মায়া, চৌকো হয়ে পুরো পাড়াটাকে ঢেকে ফেলেছে নিজের আলতো চাদরে|
শোভাবাজারের পোড়োবাড়ির গায়ের শিকড়ে জড়িয়ে থাকা, পড়তি রোদের মতো একটা দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে পাশ ফেরেন হরেনবাবু| হাতের কৌটোটা হাতেই থেকে যায়, গোল করতে না পারা স্ট্রাইকারের মতো| পাশের বাড়ির রেডিওতে তখন বাজছে “ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ|”
লেখক পরিচিতি
লেখকের জন্ম ১৯৮৯ সালের জানুয়ারী মাসে পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার শ্রীরামপুর শহরে । হুগলী জেলারই রিষড়া শহরে শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম বিদ্যালয় থেকে স্টার মার্কস নিয়ে যথাক্রমে ২০০৫ ও ২০০৭ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন । ছোটবেলা থেকেই তিনি লেখালেখির সাথে যুক্ত। বিভিন্ন নামী পত্রিকা যেমন সন্দেশ, জোয়ার, কোরক, পথ ও পাঁচালি ইত্যাদি পরিবারের তিনি নিয়মিত সদস্য ছিলেন । বহু স্বনামধন্য লেখক-লেখিকাদের সাথে তিনি বিভিন্ন পত্রিকার শারদসংখ্যায় লেখালিখি করতেন ।
পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষা ও কেরিয়ারের জন্য সাময়িকভাবে সাহিত্যচর্চার জগৎ থেকে বিরতি নিয়েছিলেন । ২০১১ সালে ইলেকট্রনিক্স এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হবার পর একজন সফল আউটডোর ব্রডকাস্টিং ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে একটি খ্যাতনামা বাংলা স্যাটেলাইট চ্যানেলে যোগ দেন ও পরবর্তীতে তিনি ইন্ডিয়ান নেভি ডেপুটেশনেও কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি একটি নামি বহুজাতিক সংস্থায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কর্মরত । বর্তমানে তিনি পুনরায় সাহিত্যর্চচার জগতে প্রবেশ করেছেন। তার বিভিন্ন লেখালিখির মধ্যে উল্লেখযোগ্য রচনা “ডরাইয়া মরে”, “রূপান্তরের পথে”, “প্রবাসের বিভীষিকা”, “বইমেলা ও একটি গোলাপ”, “পুরোনো মর্গটার কাছে”, এবং “পিশাচসিদ্ধ” যা একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত। এছাড়া ভ্রমণকাহিনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য “পরবাসী টুসুর দেশে”||
তার লিখিত কবিতাগুলির মধ্যে “একটি ব্যর্থ প্রেমের ক্ষুব্ধ আখ্যান”, “উদ্বর্তিনী”, “প্রাণের পুজো”, “কালো মেয়ের উপাখ্যান”, “বাংলা ভাষার দেশ”, “অন্য বসন্ত”, “ ভালোবাসা ও একটি বসন্ত”, “ মন- শরীরী” উল্লেখযোগ্য ও জনপ্রিয়||