স্রোত ।। রঞ্জিত মল্লিক

 

চর্চিতা হৃদয়পুর স্টেশনে নেমেই ডাউন লাইন ক্রস করে সরু গলি দিয়ে ঢুকেই সোয়েলিং বাঁধানো অন্ধকার রাস্তায় পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে হাঁটতে শুরু করল। মাঘের শুরু। ভালোই ঠাণ্ডা আছে। আজ একটু দেরী হয়ে গেছে।

            যে জন্যে ছুটছে সেটাই যদি না হয়.....।বুকের ভিতর পালস্ রেট বেড়েই চলেছে। পরনের ব্লাউজটা হালকা ঘামে ভিজছে.....। সান্যালদের বাড়ির কাছে আসতেই ঘরের চিকণ আলোটা দেখতে পেল। তার মানে আসর ভাঙেনি। চোরের মতন বাড়ি লাগোয়া চায়ের দোকানে চাদর লেপ্টে বসল। ঘরের ভিতর থেকে শব্দ ভেসে আসছে.....

           "......গুড়ুম...!
             .......গুড়ুম......!

           গুলির আওয়াজ। দৌড়োনোর শব্দ....।

           "......বন্দে..... মা........তরম......!
              বন্দে মা........তরম......!"
             "পুলিশ.....!"
             "পিছনের খিড়কির দরজা দিয়ে পালাও......"
              "অন্ধকারে ব্রিটিশের পুলিশ কেন কেউই টের পাবে না....."            "বন্দে......মা.....তরম......!"
             "আর দেরী কোরো না......"

               চর্চিতার গায়ের লোম খাড়া হয়ে আসছে। বুকের ভিতর লুকোনো ভিসুভিয়াস যেন জেগে উঠছে। চোখের কোণে মাঘ শিশিরের চন্দন......।

              ঘরে রুটি সেঁকতে সেঁকতে.....

         "মা, ক্ষুদিরাম কে ছিলেন.....?"
          "উনি বিশাল বড় বিপ্লবী......"
           "বিপ্লবী মানে......?
           "বিপ্লবী হল যাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করেছেন, জেল খেটেছেন.... শহীদ হয়েছেন,........."
            "স্বাধীনতা কি জিনিস....."
             "তুই এখন বুঝবি না....।বড় হলে তারপরে....."
             "উনি নেতাজী ছিলেন.....?"
               "না সোনা, নেতাজী আরও বড় স্বাধীনতা সংগ্রামী........."

              পুচকেটার সব প্রশ্নের জবাব ওর কাছে নেই। বললেও বুঝবে না। ওকে মানুষ করতেই হবে.....।

               আজ বৃহস্পতিবার সান্যালদের ঘরে আলো সন্ধ্যে থেকেই জ্বলছে। ভিতর থেকে সেদিনের মতন শব্দ ভেসে আসছে। চর্চিতা চায়ের দোকানে বসে সব শুনছে। আর চোখ বেয়ে নামছে বুড়িগঙ্গা।

               আজ ছেলেকে চেকআপে নিয়ে গিয়েছিল। ফেরার পথে রাস্তার মোরে স্বামীজির জন্মদিন পালিত হচ্ছে.....। তাই তো,  উনি ঠিক বলেছেন "জীব প্রেম করে.....ঈশ্বর......"

              বুকের ভিসুভিয়াস আরও একবার জ্বলে উঠল। কিছু একটা করতেই হবে। আর মাত্র কটা দিন।

                বেশ কিছুদিন ধরে সান্যালদের বাড়ির ভিতর থেকে আসা শব্দগুলো ওকে তাতাচ্ছে। সান্যালবাবু একদিন ঘর থেকে ওকে দেখে ফেলল....। লজ্জায় আমতা আমতা করছে। মিথ্যে কথা বলে পার পেল....।

                 আজ তেইশে জানুয়রী। সান্যালবাবুর মাথায় হাত। সন্ধ্যে হলেই নাটক শুরু হবে। কিন্তু "মাতঙ্গিনী"র রোলটা করার মতন কেউই নেই.....। যিনি করবেন তিনি অসুস্থ।চর্চি এগিয়ে এসে.....

              "বাবু, আমি ঐ  মাতংগিনির রোলটা পারব করতে ...."
              "তুই পারবি.....?"
              "আমার তো নাটকটার সবটি কথা মনে আছ .....।আপনি  তো  সবটা জানেন, বাবু....।....."
            "বেশ, তাই হবে.....। আমরাও পর্দার আড়ালে, পাশে দাঁড়িয়ে তোকে হেল্প করব.....।"
           
              চর্চি লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের নাটকের মহড়া শুনেই ওর মনে দেশপ্রেম জেগে উঠেছিল। "মাতঙ্গিনী"র নাম শুনেছে। ওরই পাশের জেলার কন্যা। নাটকে বিভোর হয়ে কখন যে মাতঙ্গিনীর আত্মার সাথে নিজের আত্মা মিশে গেছে, ও নিজেই জানে না। 

             রোলটা ভালোই করেছে। চালাক মেয়ে। বাবুদের মনোরঞ্জন করে। বাবুদেরই কোন একজনের মোবাইলে ইউটিউব ঘেঁটে ঐ মহান মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামী সম্বন্ধে  সব দেখেছে, জেনেছে। তবে ওর লিপে অন্য কেউ বলেছে....।

              নাটকে সবাই "মাতঙ্গিনী"  রোলটার প্রশংসা করেছেন। তবে ওর যে আলাদা পরিচয় আছে, এ লাইনে একেবারেই নতুন সেটা  কেউই ধরতে পারেনি। আসলে প্রতিভা....! আর তার সাথে মিশে গেছে পবিত্র দেশাত্মবোধ।   

       সান্যালবাবু ভালোই পুরষ্কার দিলেন। ব্লাড ডোনেশানের পুরো খরচটাই উনি দিলেন।

                রিপাকলিক ডেতে আবার ঐ নাটক মঞ্চস্থ হল। আর সকালে রক্তদান।

                রেডলাইট এলাকার মেয়েরা এবার রক্তদান করল প্রথম। ওদের হিমোগ্লোবিনে দেশপ্রেমের স্রোত বইছে.....।

                 নেতাজীর বাণী ভাসছে মননে চিন্তনে....

         "তোমরা আমাকে রক্ত.....
            ........স্বাধীনতা........."

            চর্চিতারা অশিক্ষিত, শরীর বেচে খেলেও একটা দেশপ্রেম আছে। সেটা পরিষ্কার হল। চোখ মুখের পরিভাষাতে, পেশীর সবুজ, সতেজ আস্ফালনে দেশাত্মবোধের টাটকা গন্ধটা দামাল নদীর স্রোত হয়ে বইছে.....।

             ওর বড় ছেলেটা থ্যলাসেমিয়া বিটা মেজরে বলি হয়েছিল। এই প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনে। সেদিন সবাই পতাকা তুলেছিল.....।  ওর ছেলেটার  চিতার কমলা লেলিহান শিখা জাতীয় পতাকার মত আকাশের দিকে মুখ বাড়িয়ে ছিল।

           সবটাই ওর মনে আছে। ছোটটাও থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত....। ওর ছেলের মতন আর কাউকে এবার  রক্তের জন্যে হাহাকার করতে হবে না........। এবার থেকে প্রতিবছর ঐদিনে পালা করে রক্তদান শিবির করবে নিষিদ্ধ পল্লীর মা বোনেরা।

               সান্যালবাবুর চোখে দিয়ে নামছে নোনা শিশির। জোরে গর্জে উঠলেন.....

              "বন্দে মা.....তরম....."
          
           মিও আমোরের প্যাকেটটা ময়লা শাড়িতে জড়িয়ে চর্চিতা টগবগ করে ছুটছে স্টেজের দিকে। স্টেজে ওর পুচকেটা তখন নজরুলের "বিদ্রোহী" আওড়াচ্ছে...। বুকের ভিসুভিয়াসটা আরও একবার দপদপ করে জ্বলে উঠল

        "......বল বীর......
        চির উন্নত মম শির....."

Address: 85, Kalibari Road, Nalta
                 Near Air Port Auto Stand
                 PO: Italgachha
                  Kolkata -28
                  North 24 Parganas

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।