আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আমরা মুসলিম পরিচয়ে যেমন আত্মতৃপ্তি পাই তেমনি বাঙালি পরিচয়েও।অন্যদিকে ঈদ আমাদের শিয়ার। ইসলামি ঐতিহ্যের প্রতিক। ধর্মীয় উপাচারগুলি বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে মিশে আছে অনেকটাই। কাজী নজরুল ইসলাম(১৮৯৯-১৯৭৬) ধর্মীয় বস্তুগুলোকে ইসলামের রূপে রূপান্তরিত করেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের লেখাজোঁকায় 'মুসলমানী ঢং' এসেছে খুব বেশিই।
কবিতা বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ চূড়া। কবিতার দাবি সবার আগে। কাব্যে এঁকেছেন অনেকেই ঈদের তাৎপর্য ও ঐতিহ্যকে। সর্বপ্রথম সৈয়দ এমদাদ আলী (১৮৮০-১৯৬৫)এর কাব্যগ্রন্হে ঈদ নামে দু'টি কবিতা লেখেন। তারপর কবিতাটি ১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে নবনূর পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।যতটুকু জানা যায়— এটিই মুসলিম বাংলার প্রথম ঈদ কবিতা। কবি তার ঈদ কবিতার প্রথম স্তবকে লেখেন—
"কুহেলি তিমির সরায়ে দূরে
তরুণ অরুণ উঠিছে ধীরে
রাঙিয়া প্রতি তরুর শিরে
আজ কি হর্ষ ভরে"।
শুধু সৈয়দ এমদাদ আলীই নয়, ইসলামি ভাবধারার কবি কায়কোবাদ(১৮৫৭-১৯৫১) আর নারী কবি ও লেখিকাদের মধ্য থেকে বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২)ও ঐতিহাসিক 'নবনূর' পত্রিকায় ঈদ বিষয়ক কবিতা,গদ্য ও প্রবন্ধ লিখেছেন। কবি কায়কোবাদ তার 'ঈদ আবাহন' নামের কবিতায় হিন্দু ও মুসলমানদের একসাথে ঈদ উৎসব পালনের আহবান জানিয়েছেন। কবি বলেন—
"আজি এ ঈদের দিনে হয়ে সব একপ্রাণ,
জাগায়ে মোশ্লেম সবে গাহ আজি
মিলনের গান।
ডুবিবে না তবে আর ঈদের এ জ্যোতিস্মান রবি,
জীবন স্বার্থক হবে,ধন্য হইবে এ দরিদ্র কবি"
কুরবানির ঈদে সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য গরু কুরবানি করা ওয়াজিব।এটি একটি ইসলামি ঐতিহ্যের প্রতিক। এই ঈদকে বলা যায় উৎসব ও বিসর্জনের ঈদ। বিসর্জন প্রতিষ্ঠা করাই এঈদের মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু, একবার ঈদে গরু জবাহের বিরুদ্ধে মীর মোশাররফ হোসেন লিখে প্রচুর সমালোচনা আর প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তারপর মৌলভী মোহাম্মদ নইমুদ্দিন তার 'ইসলাম দর্শন' গ্রন্হে গরু কুরবানি প্রসঙ্গে প্রবন্ধ লিখে বিরুদ্ধাচারণ করেছেন। তার কথার সারমর্ম এমন ছিল—" কতিপয় গণ্ডমূর্খের দল ইসলামকে ভালোভাবে না বুঝে গো জবাহের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়ে মুসলমানদের ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে যা কাম্য নয়"( মুসলিম দর্শন শ্রাবন ১৩২৮)
তৎকালীন যুগে শুধুমাত্র মৌলভী মোহাম্মদ নইমুদ্দিনই ঈদুল আজহা ও গো জবাহের পক্ষে লেখেন নাই। তখনকার সময়ের ঐতিত্যবাহী পত্রিকা 'মুসলেম ভারতে' খাজা নামক একব্যক্তি ছদ্মনামে প্রবন্ধ লিখেন।লিখেছেন তৎকালীন লেখক শেখ ফজলুল করিম (১৮৮২-১৯৩৬) ও। তিনি তার ঈদ কবিতায় লেখেন—
"অলস অধম মোরা এখনো কি অবহেলে যাব রসাতলে?
অদৃষ্টের উপহাস এখনো কি আনিবে না তেচনা ফিরিয়া?"।
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় মুসলিম কবি। তিনি অনেক ছড়া-কবিতা,গান ও প্রবন্ধ-নিবন্ধে নিজের ধর্মের কথা বলেছেন সুউচ্চ সুরে। সৌন্দর্য্য মণ্ডিত করেছেন স্বীয় ধর্মের ধর্মীয় উপাচারগুলোকে। ঈদ প্রসঙ্গে লেখেছেন বহু কবিতা।লিখেছেন 'কৃষকের ঈদ','জাকাত লইতে এসেছে ডাকাত চাঁদ', 'ঈদ মোবারক' ও 'সর্বহারার' মতো তিলোত্তমাপূর্ণ কবিতা। লিখেছেন ঐতিহাসিক গানও। 'খুশির ঈদ','নতুন চাঁদের তাকবির',ঈদ মোবারক হো ঈদ' এর মতো কালজয়ী গান। তিরিশের দশকে আত্মার জাগরণের রূপ মিশিয়ে লেখেছেন—
" ওমন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাকিদ।
তোর সোনাদানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে জাকাত মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ"। এর মতো আনন্দময়,সাম্যবোধ ও আত্মার জাগরণ এই ত্রিমাত্রিক গান। আন্দোলিত করেছেন মুসলিমদের।
নজরুলের সময়কালে অনেকেই ঈদের কবিতা,গদ্য, প্রবন্ধ লিখে জোয়ার তুলেছেন।প্রসংশা কুড়িয়েছেন। তাছাড়া, তার পরবর্তী সময়ে ঈদ বিষয়ক কবিতা লেখেছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন— কাজী ইমদাদুল হক(১৮৮৭-১৯২৬), এয়াকুব আলী চৌধুরী (১৮৮৯-১৯৩৫),ও ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ(১৮৮৫-১৯৬৯) প্রমুখ লেখকবৃন্দ। এদের পরবর্তী যুগ হচ্ছে— বেগম সুফিয়া কামাল, কবি মুঈনুদ্দীন ও আশরাফ আলী খানের যুগ; এরা সবাই কলম ধরেছেন ঈদ প্রসঙ্গ নিয়ে।
এরপর আসা যায়— ফররুখ আহমদ, আজিজুর রহমান, আহসান হাবীব,তালিম হোসেন, মনোমোহন বর্মণের যুগ। ইসলামি রেনেসাঁর কবি সনেটে লেখেছেন 'ঈদের স্বপ্ন' কবিতা। তিনি লেখেন—
" আকাশের বাঁক ঘুরে চাঁদ এলো ছবির মতন,
নতুন কিশতি বুঝি এলো ঘুরে অজানা সাগর
নাবিকের শ্রান্ত মনে পৃথিবী কি পাঠালো খবর
আজ এ স্বপ্নের মাঠে রাঙা মেঘ হলো ঘন বন"।
কবি শামসুর রহমান ও শহীদ কাদরীও লেখেছেন ঈদ কবিতা। শহীদ কাদরীর রচিত 'সুনীল ঈদগা' বেশ প্রসংশা কুড়িয়েছে।
বর্তমান তরুণদের কলমেও আঁকা হচ্ছে ঈদের ছবি। রচিত হচ্ছে ঈদের ছড়া,কবিতা ও প্রবন্ধ। সুতরাং বলা যায়, বঙ্গদেশে সে প্রথম থেকে এই সময় পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে ঈদ আলোচনা বেশ তোড়জোড় দিয়ে হয়েছে। দখল করে আছে বাংলা সাহিত্যের বিশাল একটা অংশ।
সাইনবোর্ড, ডেমরা,ঢাকা