আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯) ছিলেন বাংলা সাহিত্যে এক প্রাতিস্বিক শিল্পী। এই প্রতিভাধর শিল্পীর দানে আমাদের বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে।মনসুর সাহেবের রচনার মধ্যে শ্রেষ্ট রচনা হচ্ছে তার ব্যঙ্গরচনা। এই প্রতিভাধর শিল্পীর সমগ্র জীবনদর্শন এই সামান্য পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তাঁর জীবনদর্শন সম্পর্কে জানতে হলে তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যের মধ্যদিয়েই জানা সম্ভব। ধানীখোলা থেকে ধানমন্ডি কাটিয়েছেন জীবনের দীর্ঘ একাশি বছরের এক সংগ্রামমুখর ও কর্মবহুল জীবন। যে জীবন এই উপমহাদেশের এক সময়কার শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্ব করে; এর মধ্যেই রচিত হয়েছে তাঁর সাহিত্য।
আহমদ ছফা তাঁর “অলাতচক্র” উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম প্রথম সংস্করণে রেখেছিলেন ‘তনু’ আর দ্বিতীয় সংস্করণে দাঁড়া করিয়েছিলেন ‘তায়েবা’। দেখা যায় আহমদ ছফা শেষতক ‘ত’টা ছাড়লেন না। আবুল মনসুর আহমদ ধানীখোলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় কাটালেও জীবনের শেষ সময়টুকু কাটিয়েছেন ধানমন্ডিতে। এক্ষেত্রে দেখা যায়, আহমদ ছফার মতো তিনিও ‘ধ’টা ছাড়লেন না। আবুল মনসুর আহমদ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ তথা মুসলিম বাংলা তত্ত্বের উদ্ভাবক। এই মুসলিম বাংলা তত্ত্ব’ই বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বি.এন.পি-এর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। তিনি বিপ্লবী নন বিদ্রোহীও নন, তিনি ছিলেন সংস্কারবাদী। তাঁর মুসলিম বাংলার আদর্শ গোঁড়ামুসলমানদের মতো এত ধ্বংসাত্মক ছিল না। তাঁর চিন্তাধারা যে গোঁড়া মুর্সলমানদের চিন্তাধারার বাইরে তা মনসুর সাহেবের সাহিত্য পাঠ করলেই বুঝা যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন, “সাহিত্য মানেই জীবনভিত্তিক সাহিত্য, জীবন মানেই জন জীবন”। ব্যক্তির অন্তর্বাস্তবতায় মনস্থাত্ত্বিক জটিলতা আর আন্তঃসমীক্ষার নিরীক্ষাভূমি তাঁর সাহিত্য জগৎ। সে জগতে আরোপিত আখ্যানের ভারে তাঁর সৃষ্ট শিল্প ভারবাহী হয়ে ওঠে না, ব্যক্তির ভিতরেই অস্তিত্ববাদী চেতনা তাঁর শিল্পের রসদ যোগায়। রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত সামাজিক বিবর্তনসহ সমসাময়িক বাস্তবতা সেই শিল্পের ভূমিটিকে প্রস্তুত করে।আর মানুষের আদিম অন্তর্মুখী আহ্বান সে শিল্পের প্রেরণা হয়ে প্রার্থিত করে তোলে সেই শিল্পের ফসল। “গণ-মানুষের অসংখ্য দুঃখ-বেদনা, হাসি-কান্না, তাদের মহত্ব-নীচুতা, ক্ষমা-ঘৃণা, ত্যাগ-লোভ ইত্যাদি হৃদয়-বৃত্তি অবলম্বনে সাহিত্য রচিত হইলে সেটাই হইবে সত্যিকার শিল্প উপভোগ্য সাহিত্য”।
কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলা যায়, “ বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করিতে হইলে সর্বপ্রথম আমাদের লেখার জড়তা দূর করিয়া তাহাতে ঝর্ণার মতো ঢেউভরা চপলতা ও সহজ মুক্তি আনিতে হইবে। যে সাহিত্য জড়, যাহার প্রাণ নাই সে নির্জীব-সাহিত্য দিয়া আমাদের কোনো উপকার হইবে না। যাহার চিত্ত যত নির্মল, হাস্য-মুখর তাঁহার লেখাও তত নূতন নূতন সম্পদে ভরা। সাহিত্যিক নিজের কথা নিজের ব্যথা দিয়া বিশ্বের কথা বলিবেন, বিশ্বের ব্যথার ছোঁয়াও দিবেন। যাহা বিশ্ব সাহিত্যে স্থান পায় না তাহা স্থায়ী সাহিত্য নয়, খুব জোর দ’দিন আদর লাভের পরতাহার মৃত্যু হয়। তিনি’ই আর্টিস্ট, যিনি আর্ট ফুটাইয়া তুলিতে পারেন। আর্ট এর অর্থ সত্যের প্রকাশ এবং সত্য মানেই সুন্দর, সত্য চির মঙ্গলময়। আবুল মনসুর আহমদ বলেন, “আর্টের জন্য আর্ট নয়, আর্ট জীবনের জন্য। যে আর্ট মানুষের উপকারে আসিল না, সেটা সুন্দর নয় অসুন্দর”।
আড়ায় হাজার বছর আগে একজন গ্রিক দার্শনিক বলেছিলেন “এক নদীতে একজন মানুষ দু’বার অবগাহন করতে পারে না”। পরের বার যখন মানুষটি নামে তখন আর আগের মানুষটি থাকে না, নদীটিও আর আগের নদী থাকে না।
গ্যাটের“ফাউস্ট”-এ যেমন বলা আছে, “ একজন লোক যখন একটি পাইন গাছের নিচ দিয়ে হেঁটে যায়, পরের বার সেই লোকটি আর আগের লোক থাকে না, সে বদলে যায়”।
আবুল মনসুর আহমদকেও আমার নিকট সেইরূপ একজন শিল্পী মনে হয়, যার সাহিত্য পাঠ করলে পাঠক আর আগের পাঠক থাকে না। পাঠকের চিন্তার পরিবর্তন ঘটে এবং সমাজ বাস্তবতা সম্পর্কে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি জাগে। “লীডরে-কওম” গল্পের মূল চরিত্র যে মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ এবং “গো-দেওতা-কা দেশ” গল্পে তিনি হিন্দুদের ধর্মান্ধতাকেও ব্যঙ্গ করেছেন। এখানে যে ‘আনন্দ বাজার’ পত্রিকাকে খোঁচা দেওয়া হয়েছে তা বুঝতে গেলে দরকার পাঠকের স্বচ্ছ দৃষ্টি। তিনি বিদ্রোহ করেছেন সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, ভন্ডামির বিরুদ্ধে, প্রতারণার বিরুদ্ধে। তিনি ধর্মকে যারা বর্ম হিসেবে ব্যবহার করেন তাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছেন। আসলে যা সহজে বোঝার নয় তা বুঝে যাই, আর যা সহজে বোঝার তা কিছুতেই বুঝতে চাই না। তিনি শিল্পের জন্য শিল্প নয়, জীবনের জন্য শিল্প এই নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন।
“আয়না” এই বইয়ের প্রতিটি গল্পেই আমাদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের নানাবিধ মূঢ়তা নিয়ে রসব্যঙ্গ করেছেন। তিনি ধর্মান্ধতার আবরণে সমকালীন সমাজের সব ব্যাধি ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মাচন করেছেন।
“আয়না” সম্পর্কে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, “বস্তুগত আয়নায় শুধু মানুষের বাইরের প্রতিচ্ছবিই দেখা যায়, কিন্তু আমার বন্ধু শিল্পী আবুল মনসুর আহমদ যে আয়না তৈরী করেছেন, তাতে মানুষের অন্তরের রূপ ধরা পড়েছে। বাঙলা ভাষায় ব্যঙ্গ সাহিত্য খুব উন্নত হয় নি; তার কারণ ব্যঙ্গ-সৃষ্টিতে অসাধারণ সৃজনীশক্তির প্রয়োজন। এ যেন সেতারের কান মলে সুর বের করা-সুরও বেরুবে, তারও ছিঁড়বে না। ভাষার কান মলে রস-সৃষ্টির ক্ষমতা আবুল মনসুরের অসাধারণ। এ যেন পাকা উস্তাদী হাত”।
মনসুর সাহেবের শব্দ ব্যবহারের একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, তিনি লিখেছেন সাধু বাংলায় অথচ আববি, ফারসি, উর্দু শব্দ ব্যবহারেও সাহিত্যেরকোনরূপ অঙ্গহানি ঘটেনি বরং ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন। তিদি ‘ইলশাকাটার’ মত আঞ্চলিক শব্দ, ‘রান্নাঘরের’ স্থানে ‘বাবুর্চিখানার’ মতো তুর্কি-ফারসি শব্দ কিংবা ‘হাতঘড়ির’ বদলে ‘রিস্টওয়াচের’ মতো ইংরেজি শব্দ অক্লেশে পাশাপাশি প্রয়োগ করেছেন।
তাঁর “হুযুর কেবলা”র মতো পল্পে পরশুরামের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু পরশুরামে যতটা রহস্য আছে, ততটা বিষাদ নেই। আবুল মনসুর আহমদের সব গল্পেই আমাদের সংকীর্ণতা-শঠতা-অজ্ঞতা নিয়ে রঙ্গের সঙ্গে দুঃখবোধ জড়িত। পরশুরাম ছবি এঁকেছেন, সমাজের সংস্কার তাঁর লক্ষ্য ছিল না। আবুল মনসুর আহমদ সমাজের সংস্কার চেয়েছেন এবং তার সাথে সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁর গল্পে।
“হযুর কেবলা” ভন্ডপীরের গল্পটি পরশুরামের ‘বিরিঞ্চিবাবা’র মতো। তিনি (পীর সাহেব) এক জায়গায় বসে রুহকে ছেড়ে দেন, রুহ সাত হাজার বছর কাটিয়ে আবার তার জেসমে প্রবেশ করে।আর বিরিঞ্চিবাবা মহাদেবকে ডেকে আনান। তবে বিরিঞ্চিবাবার সঙ্গে হুযুর কেবলার অমিল হুযুর কেবলা মেয়ে-মহলে একটু বেশিক্ষণ থাকতে ভালবাসেন। সফরে গিয়ে রজবের স্ত্রী কলিমনের প্রতি তার দৃষ্টি যায়। সুফী সাহেবের দেহাশ্রিত পয়গাম্বরের রুহ তাকে কলিমনকে বিয়ে করতে আদেশ করে। হুযুর কেবলার এইসব ভন্ডমি এক পর্যায়ে এমদাদের কাছে ধরা পড়ে। এমদাদ শিক্ষিত যুবক। সে পীর সাহেবকে আক্রমণ করতে কসুর করেনি। এর ফলে সুস্থবুদ্ধির এমদাদকে‘পাগল’ আখ্যা দিয়ে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এখানে ‘লাল-সালু’ উপন্যাসের ‘আক্কাছ’ চরিত্রের কথা স্মরণ করা যায়। আক্কাছ গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল কিন্তু স্কুল প্রতিষ্ঠা হলে গ্রামরে মানুষ মজিদের ভন্ডামি বুঝতে পারবে। এক্ষেত্রে মজিদ তার ধর্ম-ব্যবসা চালিয়ে রাখার জন্য আক্কাছকে ‘পাগল’ বলে কৌশলে গ্রাম ছাড়া করেন।
“গো-দেওতা-কা-দেশ” গল্পে তিনি ইংরেজের মন্ত্রণায় গো-হত্যা নিয়ে গোঁড়া হিন্দু-মুসলমানদের বিরোধ, পরস্পর নিধন, শেষে গরুর দুধ খাওয়ার লোকের অভাবে দুধের বন্যায় সারাদেশ ডুবে যাওয়া এবং মনুষ্যহীন হয়ে দেশটির গো-দেবতার দেশে পরিনত হওয়া-এই গল্পের মর্ম।
“নায়েবে নবী” গল্পটি খেলাফত আন্দেলনের প্রেক্ষাপটে রচিত। ধর্ম-ব্যবসায়ী মোল্লা-মৌলবিদের আরেকটি ব্যঙ্গাত্মক চিত্র এটি। মৌলবি সুধারামী গ্রামের অশিক্ষিত জনসাধারণের কাছে ধর্মের দোহাই পেড়ে নিজের আয়ের রাস্তা সুগম করেন। নিজের স্বার্থের প্রশ্ন আসলে ফতোয়া জারি করেন, ‘এরকম ওয়াদা খেলাফে দোষ নাই’। স্বার্থরক্ষা না হলে তারা লাশের সামনেও হাহাতি করতে প্রস্তুত। গল্প থেকে পাই,
“লাশ রৌদ্রের মধ্যে পড়িয়া রইল। অপরদিকে মৌলবি সুধারামী তার প্রতিদ্বন্ধী মৌলবি মুনশি গরিবুল্লাহর সাথে তর্কে প্রথম-প্রথম পরস্পরকে ‘মুনশী-সাব’ বলিয়া সম্বোধন করিতেছিলেন বাহাছ গরম হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে এই সম্বোধন ‘জাহেল’ ‘নাদানে’ নামিল। কে কত টাকা লইয়া একজনের বিবাহিত স্ত্রীকে আরেকজনের সঙ্গে নিকাহ দিয়াছিলেন এই রকম অনেক নূতন নূতন তথ্য প্রকাশ পাইতে লাগিল। গালাগালি থেকে শেষ পর্যন্ত হাতাহাতি লাগিয়া গেল”। লেখক এই রস-রচনার মধ্য দিয়ে এদেশের গণমানুষের ধর্ম চিন্তার একটি বিশেষ রূপ প্রকাশ করেছেন এবং এদেশের ভন্ড ও ধূর্ত ধর্ম-ব্যবসায়ীদের একটি নিখুঁত চিত্র তুলে ধরেছেন।
“লীডরে-কওম” গল্পে ধর্মবিশ্বাসী মানুষের দুর্বলতার সুয়োগ নিয়ে ইসমাইল সাহেব কিভাবে পত্রিকার মালিক হয়ে গেলেন, মুসলিম বঙ্গের অদ্বিতীয় নেতা বনে গেলেন এবং দু-পয়সা লাভও করলেন, তার সবিস্তর বর্ণনা আছে।
নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য মোল্লা-মৌলবিরা কত জঘন্য ভূমিকা পালন করতে পারে, তার একটি মর্মভেদী চিত্র হল, “মোজাহেদীন” গল্প। স্বার্থবাজ মোল্লা-মৌলবিরা গ্রাম-বাসিদের মধ্যে আত্মকলহ লাগিয়ে দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে বাহাছের পুস্তিকা বের করেন। ‘তৎকালে হানাফী-মোহাম্মদী বিরোধ, বাহাছের সভাশেষে মারামারি এবং পরিণামে মামলা-মোকদ্দমা ও জেল-জরিমানা ছিল সাধারণ ব্যাপার’।
‘আত্মকথা’য় পাওয়া যায়, আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির গোঁড়া মোহাম্মদী পরিবারের সন্তান। ছাত্র হিসাবে তিনি ছিলেন মধ্যম মানের ভাল ছাত্র। ‘আত্মকথা’র এক জায়গায় লিখেছেন, ‘মোহাম্মদী কায়দায় এক-আধ রেকাত দাখিল মসজিদ বা কাবলুল-জুমা বোধ হয় পড়িয়াও ফেলিয়াছি। এমন সময় একজন মোটা গলায় চিৎকার করিয়া বলিলেন, এই বাচ্চারা তোমরা কেমনে নামায পড়িতেছ? তোমরা লা-মজহাবী না কি? নামায শেষ হওয়ার পর ঐ ব্যক্তি চিল্লাইয়া আমাদের মুখের সামনে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত নাড়িয়া বলতে লাগিলেন তোমরা খারেজী। আমাদের মসজিদে ঢুকিয়া মসজিদ নাপাক করিয়াছ’।
এরপর আরও পাওয়া যায়, ‘বন্ধুদের সাথে নামাযে গিয়া আমি পাক্কা মোহাম্মদী কায়দায় নামাজ শুরু করলে তারা বলিলেন ঃ আপনে ওজিনিস তা জানিতাম না। আপনার আর নামায পড়িবার দরকার নাই’। বর্তমানে এই হানাফী-মোহাম্মদী দ্বন্দ্বের খবর খুব কম জনই রাখে। মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি ভেদের খবর’ই জানে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর ভাষায় বলা যায়, ‘মনের চর্চা যাদের কম গোঁড়ামি তাদের বেশি, সামন্য পরিমাণ নূতনত্বেও তাদের বাধে’।
‘আসলে মুসলমানদের বুদ্ধি আড়ষ্ট ও চিন্তা অবরুদ্ধ হইয়া গিয়াছে। ইসলামের ভাল আদর্শ ত্যাগ করিয়া মুসলমানেরা শুধু আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই ধর্ম চর্চাকে সীমাবদ্ধ করিয়াছে। মুসলমানের এই সার্বিক অধঃপতনের জন্য দায়ী মোল্লারা’।
কবিগুরুর ভাষায়, ‘হিন্দুরা ধর্মের নামে শুধু আচার-অনুষ্ঠানকেই নিয়েছে’।
“বিদ্রোহী সংঘে” পাওয়া যায়, এর সদস্যদের কথা। এই সুবিধাবাদী শ্রেণির লোকেরা প্রথা-বিরোধী, কিন্তু স্বদেশের জন্য কোনো কষ্টস্বীকারে তারা প্রস্তুত নয়, কারণ মুখে যদিও তারা বিশ্ব-মানবতার আদর্শ প্রচার করে, তবে অন্তরে রাজশক্তির ভয়ে ভীত।
“ধর্ম-রাজ্য” গল্পে দেখি মসজিদের সামনে বাদ্য বাজানো নিয়ে হিন্দু-মুসলমানদের সহিংস সংঘাতের ফলে অনেকে নিহত হল এবং হিন্দু মৃতদেহের উপরে ‘আর্যবীর’ এবং মুসলমানদের বুকের উপরে ‘শহিদ’ চিহ্নিত বস্ত্রখন্ড রাখা রইল। ইংরেজদের এই ভেদ-নীতি সর্বোপরি উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মান্ধতা কি করে এই ধরনের একটি অমানবিক সমস্যাকে সৃষ্টি ও বিকশিত করেছিল তা আবুল মনসুর আহমদের রূপায়ন দক্ষতায় প্রকাশিত হয়েছে।
পীরবাদ এবং মৌলবিবাদ যে ধর্ম-ব্যবসা এবং সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা আর অবিশ্বাসকে পুঁজি করে কিভাবে তাদের শোষণ করা হয় তার’ই এক উপাখ্যান “আবেহায়ত”।
সৈয়দ মুজতবা আলী-এর বিখ্যাত গ্রন্থ “দেশে-বিদেশে” পাওয়া যায়, ধর্ম-ব্যবসায়ীরা তার ভক্তদের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার জন্য তিন বছর সময় নিয়ে বলবে-তোমার বিপদ আছে। তিন বছর দীর্ঘ সময় এর মধ্যে কিছু না কিছু একটা ঘটবেই। তখন তিনি বাড়ি ভয়ে এসে ভক্তের জানুতে হাত রেখে বসবেন, মুখে ওই এক কথা ‘বলিনি, তখন বলিনি’?
“আবেহায়াত” উপন্যাসে পাওয়া যায়, ‘ফতেহপুরের পীর সাহেব পীরলি করিয়া তার নিজের জীবনেই একশ একরের উপর খামার জমি, দুইখানি তালুকের-ষোল আনা ও একটি জমিদারির এক আনা অংশ খরিদ করিয়াছেন, শহরে পাঁচখানা ইমারত করিয়াছেন। বাপের আমলের পুকুরটি বাড়াইয়া-খুদাইয়া বিশাল দিঘি করিয়াছেন। টিন-ছনের ঘর-দরজার জায়গায় তিনি বিশাল ইমারৎ করিয়াছেন আবার ছেলে সন্তানের আশায় নূতন বিয়ে করার জন্য মনে মনে নিজের বড় বিবির মৃত্যু কামনা করতে দ্বিধাবোধ করেন না।
“সত্যমিথ্যা” উপন্যাসে দেখা যায়, মাতব্বর শ্রেণির লোক ওসমান সাহেবের ছেলে সত্য কথা প্রকাশ করতে চাওয়াই তিনি ‘মনে মনে বলিলেন ঃ হা খোদা এমন কুপুত্র আমারে কেন দিয়াছিলে? বড় ছেলেকে তুমি তুলিয়া নিয়াছ। এ ছেলেকে তুমি চোখে দেখ নাই?
‘নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করে, মোরগি-পোলাও খাওয়ার লোভে মোটা অংকের টাকার লোভে মওলানা মুসা সাহেব সত্য কথা জেনেও তা গোপন করে রেখেছেন।’।
অন্যের সম্পদ কিভাবে হাত করা যায় এই কৌশল শাহ সাহেব ছাড়াও পীর শ্রেণির সকলের’ই জানা আছে। মরিয়মের অসুখের ব্যাপারে শাহ সাহেব গরু হাতাইবার জন্য বলেন ঃ ‘অমাবস্যায় দুপুর রাত্রে আপনেরা গরু লৈয়া বটগাছ তলায় যাবেন’। গ্রামের মানুষ সন্ধ্যা রাতেই ঘর থেকে বের হতে চায় না, একেত অমাবস্যা তারপর আবার আবার দুপুর রাত। গরু হাতাইবার এই উপযুক্ত সময়।
পীর সাহেব নিজের ব্যবসা চালিয়ে রাখার জন্য পুত্র হামিদকে বলেন, ‘তুমি পীরের ছেলে। সত্তুর লাখ মুরিদের হৈবা তুমি পীর। ধর্ম-পথে থাইকা তুমি রুজি করবা বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকা’। হামিদ তার বাপের ভন্ডমি বুঝতে পেরে বাড়ি থেকে চলে যাওয়া’ই পীর সাহেবের ব্যবসায় যেন কোন প্রকার ক্ষতি না হয় সে জন্য ফতোয়া দিলেন, ‘আল্লাহপাক পীর সাহেবের ঈমান পরখ করিবার জন্য’ই তার’ই একমাত্র পুত্রকে দিয়া এ বিদ্রোহ করাইয়াছেন। হযরত নূহ ও হযরত ইব্রাহিম নবীকেও আল্লাহ ঠিক এমনি পরীক্ষার সামনে ফেলিয়াছিলেন’।
‘এক শ্রেণির মুসলমানের পীর ভক্ত এক সময় এমন চরম সীমায় উঠিয়া ছিল যে, উহা স্পষ্টতঃই ইসলামের মৌলিক শিক্ষার বিরোধী। এই শ্রেণির মুসলমানের কথাবার্তায়, কাজে-কর্মে আল্লাহর পানা না চাহিয়া পীর সাহেবের পানা চাহিতেন। ঝড়ে বক মরার সুযোগ লইয়া অনেক শাহ ফকির কেরামতি বাড়াইয়াছেন এবং প্রচুর রোজগার করিতেছেন।
‘হামিদ দেখিয়াছে বুড়া মেয়েদের চেয়ে যুবতীদের মধ্যে’ই পর্দার কড়াকড়িটা বেশি। হামিদ জানতে পেরেছে যেসব মেয়েরা পর্দা করে না তারা হয় হিন্দু না হয় গরিব মুসলমান’। ‘এই পর্দা-প্রথা মুসলমান সমাজকে পঙ্গু, অথর্ব, অসভ্য ও কৃষ্টিহীন করিয়া রাখিয়াছে। নারী জাতির পর্দার কড়াকড়ি সমর্থনে দিন-রাত শত হাদীস-কোরান আওড়ান হইতেছে। যেন একমাত্র পর্দা-প্রথার উপরেই ইসলামের অস্তিত্ব নির্ভর করিতেছে। মুসলমান মেয়েরা রাস্তার বাহির হইয়া ভিক্ষা করিলেও ইসলামরে মর্যাদা নষ্ট হইবে না; কিন্তু দু-দশ জন মেয়ে স্কুল-কলেজে গেলেই ইসলাম ধ্বংস হইবে। এই ইসলামী পর্দা উচ্চ ও মধ্য শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ হইয়াছে’। ইসলামের নামে যে শিক্ষা পদ্ধতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তার নজির “গালিভরের সফর নামা” গ্রন্থে পাওয়া যায়। কাজী নজরুল ইসলামরে ভাষায় বলা যায়, ‘পর্দা ও নারী সম্পর্কে যেসব শাস্ত্রীয় দোহাই দেওয়া হয়, সেসব কেতাব ও আইন কানূনের রচয়িতা পুরুষ’।
আবুল মনসুর আহমদ যখন প্রথাগত কুসংস্কারের বিদ্রোহ করেন তখন সমাজ তাকে নাস্তিক জ্ঞানে নাকচ করেছিল। যেমন ইউরোপ বহুদিন স্পিনোজাকে নাস্তিক জ্ঞানে নাকচ করেছিল। কিন্তু খ্রিস্টিয় আঠারো শতকের শেষে আবার তাঁর কদর ফিরে আসে। জার্মান মহাত্মা গ্যাটে ও ইংরেজ কবি ওয়াডর্সওয়াথ প্রসুখ মনীষী স্পিনোজার কদর করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক মনীষী আবুল মনসুর আহমদের কদর করছেন।
মানুষের ভাষা বিশেষ বিশেষ নিয়ম বেঁধে অর্থ প্রকাশ করে থাকে। এক নিয়মের না হচ্ছে রূপক। রূপকের অর্থ কোন এক শব্দের প্রথাগত অর্থ ছেড়ে অন্য অর্থে এর সদ্ব্যবহার। এই ব্যবহারেরও আবার নানান প্রকার আছে। এর মধ্যে এক প্রকার রূপক আছে লক্ষণা। লক্ষণার বৈশিষ্ট্য আছে এমন দু’টি শব্দের মধ্যে একটিকে অন্যটির অর্থ বুঝাতে যদি আরা ব্যবহার করি তাহলে অন্যায় হবে না। নতুন নতুন অর্থ সৃষ্টির এই পথ পূর্বসূরি লেখরা শুধু নয়। ভাষায় যারা বাক্য গঠন করেন তাঁরা সকলেই ধরে থাকেন। আবুল মনসুর আহমদও রূপকের সদ্ব্যবহার করেছেন বিশেষ করে তাঁর ব্যঙ্গ রচনাগুলোতে বেশি করেছেন।
“ফুড কনফারেন্স”-গল্পে পাওয়া যায়, ‘ইন্দুরে বাংলা বলল, রাত অনেক হয়েছে। রাতের বেলায় আমাদের অনেক লোকের কাঁথা-বালিশ কাটতে হবে। নইলে তো আর আমাদের খোরাকি জুটবে না’। এখানে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, উচু শ্রেণির ক্ষমতাবান লোকেরা নিম্ন শ্রেণির লোকেদের শোষণের কথা বলেছেন। এই গল্পের শেষে দেখা যায়, ‘দেশের জনসাধারণ সবাই খাদ্যের অভাবে মারা গিয়াছে। আইন সভা ও ফুড কমিটির মেম্বার ভদ্রলোক ছাড়া দেশে আর কেউ বেঁচে নেই’।
“লঙ্গরখানা” গল্পে প্রতিয়মান হয়েছে যে, উচু শ্রেণির মানুষেরা কিভাবে ক্ষমতার দাপটে নিম্ন শ্রেণির মানুষদের শোষণ করছে। ‘নির্দিষ্ট দিনে শমশেরজী কোম্পানীয় দানশীলতা ও দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা সম্বরন্ধ প্রাণস্পর্শী বক্তৃতা হল। সেখানে ছিল উচু শ্রেণির বড় কর্ম-কর্তারা। পুলিশের কড়া পাহাড়া থাকায় ছিল না কেবল নিম্ন শ্রেণির ভুখা-ভিখারীরা’।
‘শমশেরের দোকানের দরজা আর সামনের দিকে ওপেন হল না। তার বদলে পেছনের দরজা ওপেন হয়ে গেল। সেখানে রোজ হাজার হাজার মণ চাউল চল্লিশ টাকা দরে বিক্রি হতে লাগল’। খাবারের অভাবে দেশের নিম্ন শ্রেণির সাধারণ লোকগুলো আর বাঁচল না। এতে আকবর সাহেবের যুক্তি ছিল, ‘তাদের হায়াত ছিল না। দুনিয়াটা মুসাফির খানা বই’ত নয়’।
“রিলিফ ওয়ার্ক” গল্পে দেখা যায়, ‘রিলিফ ফান্ডের টাকায় চৌদ্দআনা কর্মীদের ভরণ-পোষণে ব্যয় হইতেছে। বাকী দুই আনায় মাত্র সেবাকর্ম চলিতেছে’। কেন্দ্রীয় কর্ম-কর্তারা গরিব কৃষক-শ্রমিকদের চাল-ডাল নিজেরা নিয়ে যাচ্ছেন আর কর্মের বেলায় শুধু নামটি নিয়েছেন।
‘গ্রো-মোর-ফুড” গল্পে প্রতিয়মান হয়েছে, মিম্ন শ্রেণির কৃষকদের ধান চাষ করতে বাধা দেয় উচুশ্রেণির বড় কর্ম-কর্তারা। এদের সাথে ছিল ইংরেজ সদস্য। এই “গ্রো-মোর-ফুড” আন্দোলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ঃ ইংরেজ-মার্কিনদের জন্য মদ, ভারতীয়দের ভদ্রলোকদের জন্য গাঁজা এবং ভারতীয় সাধারণের জন্য হাওয়া চাষ করা হবে।
“জমিদার উচ্ছেদ” গল্পে জনসাধারণ যাকে ভোট দিয়ে প্রতিনিধি বানিয়েছেন, তিনি এই সুযোগে জনসাধারণকে শোষণ করতে আরম্ব করেন।
“জনসেবা য়ুনিভার্সিটি” গল্পে ইয়াকুব জনসেবার নাম করে জনগনকে শোষণ করতে থাকেন। ইয়াকুবের মত অনেকেই এদেশে মানুষের সেবার নামে বড় বড় বুলি আওড়িয়ে নেতার আসন গ্রহণ করেন। তারা সাধারণ নিম্ন শ্রেণির মানুষদের সহানুভূতি কুঁড়িয়ে বিরুদ্ধ শক্তিকে খর্ব করে নিজেরা একদিন জাতির পুরোভাগে বসেন। সেদিন তার রূপ বদলে যায়। ধন-সম্পদ ও প্রভুত্ত্বের অধিকারী হয়ে তারাও ভুলে যায় অতীতের সকল প্রতিশ্রুতি। এই গল্পটি সাহিত্যিক আকবর হেসেন-এর “ঢেউ জগে” উপন্যাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আবুল মনসুর আহমদ সমাজ বাস্তবতা সম্পর্কে যেসব গ্রন্থ লিখেছেন তা লেখতে গেলে হাতের মধ্যে জাদু চাই আর পড়তে গেলে দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বচ্ছ অন্তর্দৃষ্টি চাই। মনসুর সাহেবের গল্প শুধুমাত্র গল্প নয় এর পেছনে বর্তমান সমাজের বাস্তব চিত্রও রয়েছে। মন খুলে পাঠ করলে তবেই এইসব গ্রন্থ ধরা দেবে পাঠকের কাছে।