মারামারি করে প্রতিপক্ষের ভয়ে বাহাদুরাবাদ ঢাকা রেলপথে ঢাকায় যাওয়া নিরাপদ বোধ হল না।গোয়েন্দা তথ্যে জানতে পারি প্রবল প্রতিপক্ষ বাহাদুরাবাদ থেকে সিংহজানি পর্যন্ত প্রত্যেক রেল স্টেশনে সতর্ক পাহারা বসিয়েছে। এও জানতে পারি যে, আমাকে ধরতে পারলে দেহের মানচিত্র পাল্টে দেবে। এমনকি পটল তুলতেও বাধ্য করতে পারে।
তাই প্রতিপক্ষের পাহারার পরিমণ্ডলে যাওয়া ঝুঁকি মনে করে আমিও পথ পাল্টালাম। নৌকা ভাড়া করে যমুনা নদী পার হয়ে ফুলছড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। দুপুরের খানিকটা পরে ফুলছড়ি পৌঁছে লোকাল ট্রেনে বোনার পাড়া। সেখান থেকে হেঁটে সোনাতলা যাওয়াই আমার উদ্দেশ্য। মনে মনে ভেবে রেখেছি পরদিন বিআরটিসির বাসে নগর বাড়ি আরিচা হয়ে ঢাকায় পৌঁছব।
তখন কার্তিক মাসের মাঝামাঝি সময়। বোনার পাড়া থেকে জুম্মার বাড়ি অভিমুখে যাত্রা করতেই সন্ধ্যা নেমে এলো। ধানক্ষেতের আলপথে হাঁটছি।আমার সাথে বন্ধু মিরু ডাক্তার। ব্যাগটা ওর কাঁধেই ঝুলিয়ে দিয়েছি।
আমরা দুবন্ধু যখন বোনার পাড়া রেল স্টেশনে নামি তখন থেকেই লক্ষ্য করছিলাম তিনজন লোক আমাদের পেছনে পেছনে আসছে।
তাদের একজন বামন আর দুজন তালপাতার সেপাই।
হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা হয়ে এলো।পেছনের লোক তিনজনের থেকে একজন বললো, ও বারে দেখেশুনে যাবেন।রাতের বেলা কত রকম সাপখোপ থাকতে পারে।
লোকগুলো একই দূরত্বে হেঁটে চলেছে। আমরা জোরে হাঁটলে ওরাও জোরে হাঁটে আর আমরা আস্তে হাঁটলে ওরাও আস্তে হাঁটে। ওদের রহস্যময় সতর্কতা জ্ঞাপন এবং ভাবগতিক দেখে সুবিধার মনে হচ্ছিল না। অবশ্য গুরুত্ব দিচ্ছি না একারণে যে ওই তিন মর্দকে কুপোকাত করতে মিরু ডাক্তারই যথেষ্ট।
ওদের ফিসফিস করে আলাপে সন্দেহ আরও গাঢ়তর হচ্ছিল।আমাদের সর্বস্ব ছিনতাই করার জন্য ওরা একটা কায়দা মত জায়গা খুঁজছিল বলে আমার মনে হল। আমি মিরু ডাক্তারকে বললাম, মিরু,তুই কি কিছু বুঝতে পাচ্ছিস? মিরু বলল, পাচ্ছি তবে পাত্তা দিচ্ছি না।
কতেকদূর যেতেই লোকগুলো তাদের অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনিয়ে আমাদের সাহস পরীক্ষা করছিল।
আমি মিরুকে বললাম, তোর ব্যাগে স্ট্যাপলারটা আছে না? সে বলল,আছে।
আমি একটু কেশে নিয়ে ওদের শুনিয়ে মিরুকে খানিকটা জোরের সাথেই ডাক দিলাম।
মিরু,তোর ব্যাগ থেকে মালটা দে তো।গুলি গুলো তো আমার পকেটে আছে।বলা যায় না রাতকাল।শুনলাম রাস্তাঘাট ভাল নয়। মালটাতে গুলি ভরিয়ে রেডি করে রাখি। মিরু স্ট্যাপলারটা আমার হাতে দিল।পেছন থেকে ওরাও সম্ভবত ব্যাগের চেইন খোলার শব্দ শুনতে পেল।
আমি স্ট্যাপলারটা দুতিন বার খটখট করে নাড়াচাড়া করলাম। তারপর বললাম, ছয়টা ভরালাম। এবার চল।
কিছুদূর এগিয়ে পেছন দিকে চেয়ে দেখি লোকগুলো নেই।হয়তো বা বাঘের উপর টাঘের ভয়ে কেটে পড়েছে।
সেই সাত সকালে বাড়ি থেকে খেয়ে বেরিয়েছি।মিরু তবু একটার পর একটা বিড়ি টেনে খিদে ভুলে থাকে। আমি তো বিড়িও টানি না। মিরুকে বললাম, দোস্ত, আমি তো আর হাটতে পাচ্ছি না। খিদেয় তো পেট হাভিয়া দোযখ হয়ে গেল।
মিরু বলল, ভাবিস না। সামনে জুম্মার বাড়ি বাজার।ওখানে গিয়ে কিছু একটা খেয়ে নেব।এই আর মাইল খানেক। গ্রামের মাইল তো ক্রোশের চেয়েও লম্বা। তবু আর কী করা। সেই লম্বা মাইল মাড়িয়ে বাজারে যখন পৌঁছলাম তখন বাজারের ঝাড়ুদারদের কাজ শুরু করার পালা।একটি মাত্র দোকানে টিমটিম করে বাতি জ্বলছে। নিতান্ত দুতিনজন অলস অথবা স্ত্রীর তাড়া খাওয়া লোক দোকানের টোলে বসে নিরুত্তাপ আড্ডা দিচ্ছে।
আমরা দোকানদারকে বললাম, ভাই,খাবার কিছু আছে।দেকানদার একটি মাটির বাটিতে আমাদের সামনে লম্বা লম্বা খোরমা এনে দিল। কামড় দিয়ে বিস্বাদে মুখ ভ্যাচিয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়লাম।
মিরুকে বললাম, তোর কাকার শ্বশুরবাড়ি আর কতদূর? পাছে আমি ভয় পেয়ে যাই বা দীর্ঘশ্বাস ফেলি এজন্য বলল, সামনে ছোট্ট একটা খাল আছে। খালটা পেরিয়ে সামান্য হাঁটলেই দারোগা বাড়ি। তুই ভাবিস না চল তো।
কী আর করব। মিরুর পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। এখন মনে হচ্ছে পা দুটো বিদ্রোহ ঘোষণা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আমার হুকুমত পা দুটোর উপর শিথিল হয়ে যাচ্ছে।
খালের উপর বাঁশের সাঁকো। দিনের বেলা হলে কথা ছিল না।একে তো রাতের বেলা তার উপর এক বাঁশের সাঁকো। মিরুকে বললাম, ভাই, এর চেয়ে পুলসিরাত পার হওয়াও বোধ হয় সহজ হবে।সে হেসে হেসে বলে, ধুর পাগল! এটা না হয় পুলসিরাত পার হওয়ার ট্রেনিং মনে কর। আমি বললাম, তাই হোক।
সাঁকোতে উঠার আগে মিরু আমাকে স্যান্ডেল খুলে নিতে বলল।আমি বললাম, লাগবে না। মিরু তড়তড়িয়ে পার হয়ে গেল।আমি সাঁকোর দুই তৃতীয়াংশ অতিক্রম করতেই সাঁকোর খুঁটির গিঁঠের সাথে স্যান্ডেল আটকে মুহুর্তে নিচে পড়ে গেলাম। আল্লাহর কাজ ভাল। নিচে অল্প পানি ছিল কিন্তু উচ্চতা একটু বেশি থাকায় কোমরে এক ধরণের চিনচিন ব্যথা অনুভব করলাম।এক ঝাপটায় ডাঙায় এসে মিরুকে বললাম, চল। এখন আর খিদের কথা মনে নেই।বিষে বিষ ক্ষয়।
রাত ঠিক এগারোটায় মিরুর কাকার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে পৌঁছলাম।
গ্রামে সন্ধ্যে বেলায়ই অনেক রাত নেমে আসে।রাত এগারোটা তো একেবারে গভীর রাত।এত রাতে অতিথি এসেছে শুনে তারা মনে করল নিশ্চয়ই কোন দুঃসংবাদ।
পরে যখন তারা জানতে পারল তেমন কিছু নয় তখন আশ্বস্ত হল। এবার শুরু হল তাদের অতিথি সৎকার।
প্রথমেই পানি ভরা কাঁসার বদনা, একজোড়া খড়ম দিয়ে কাকার শ্বশুর বললেন, তোমরা হাতমুখ ধোয়ে আরাম কর।
আমরা গ্রামের ছেলে। এ ধরণের অতিথি সৎকারে অভ্যস্ত। তাই হাতমুখ ধোয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আগেই বলেছি আমার জঠরাগ্নি দমকলের পাঁচটি ইউনিট একসাথে কাজ করেও নেভাতে পারবে না। ভাবলাম তাড়াতাড়িই বোধকরি খাবার দেবে।
অনেকক্ষণ যাবৎ বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করছি। ভাবছি এই বুঝি খাবার এলো কিন্তু না অপেক্ষাই সারা।
প্রায় পৌণে এক ঘন্টা পর কাকার শ্বশুর একটি অল্পবয়সী মুরগির বাচ্চা একহাতে,অন্যহাতে দা আর একবদনা পানি নিয়ে ঘরে ঢুকল। মুরগির বাচ্চাটির পাখাদুটো একত্রে মোড়ানো। ব্যথায় সে ক্যার্ ক্যার শব্দ করছে। হাতে ধারালো দা দেখে আসন্ন বিপদ আঁচ করতে পেরে মুরগির বাচ্চাটির অসহায় দুটো চোখ টলমল করছে।
মিরু, বাচ্চাটা একটু ফেস দিয়ে দাও তো। একেবারে নুনভাত তো পাতে দিতে পারি না।
কাকার শ্বশুরের মুখে এই ফেস দেয়া শব্দটি শুনে আমি আৎকে উঠলাম। ছোটবেলায় শিশ্নাগ্রের অগ্রভাগ কর্তন করাকে ফেস দেয়া বলতে শুনেছি। এতদিন মুরগির বাচ্চার গলা কাটাকে যে ফেস দেয়া বলে সেটা জানলাম।
আমার ভিতরে একটা ক্ষুধাজনিত অস্থিরতা কাজ করছে। বহুব্যঞ্জনে অতিথি সৎকার করতে করতে তো অতিথির পরমায়ুই শেষ হয়ে যাবে। তাই আমি বললাম, দাদু, রাতে আর ঝামেলা না করে যা আছে তাই দিয়ে চাট্টি ভাত দেন খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
দাদু বললেন, না না না। তা কি করে হয়। আমার দামান্দ্ বেটা যদি জানতে পারে তার ভাতিজাদের হুদামুদা ভাত খাওয়াইছি তাহলে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবে।
আমি রাগে মনে মনে বলি, আরে বেটা, তোমার রাগের গুষ্ঠী মারি।আমার পেটে হাভিয়া দোজখ জ্বলছে আর বেটা আছে লজ্জা নিয়ে।
আবার বলে কী না বড়জোর ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। তোমরা গড়াগড়ি করতে করতেই রান্না হয়ে যাবে।
রাত বারোটা বেজে গেল।আমি দু গ্লাস পানি উদরসাৎ করে শুয়ে পড়লাম। খিদে এবং পেশাবের চাপ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উৎপাৎ করে। তারপর শান্ত হয়ে যায়। আমারও খিদে বিগড়ে গেছে। তাই শুয়ে পড়ামাত্র দুচোখে অন্ধকার নেমে আসলো।
যখন আমাকে খাওয়ার জন্য ডাক দেয়া হল তখন সময়টা বোধ করি সেহরির কাছাকাছি। একান্ত অনিচ্ছায় বিরক্তি নিয়ে উঠলাম। চোখে মুখে একটু পানি দিয়ে খেতে বসলাম। মিরু আমার অবস্থা দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। এখানে মিরুর একটি আলাদা উপাখ্যান আছে সেটা না বলাই ভাল।
দাদু এসে খাওয়ানো শুরু করলেন। তার ধারণা আমার পেট ছোটখাট একটা সমুদ্দুর। যতই মানা করি ততই তার খাওয়ানোর ইচ্ছে তীব্র হয়। আমি এই সমাদরকে অত্যাচার মনে করছি। আচারের সীমা অতিক্রম করলে সেটা অত্যাচারে পর্যবসিত হয়। ব্যাকরণঅলারা কি এমনি এমনি লিখেছেন অতি আচার অত্যাচার?
খেতে খেতে পেটে আর জায়গা নেই। এবার দাদু দশাসই সবরী কলা এনে বললেন, দুধকলা দিয়ে চাট্টি ভাত তো খেতেই হবে। আমি বললাম, দাদু,এতরাতে আর দুধকলা দিয়ে সাপ না পুষলেই কি নয়?
অনিচ্ছার শেষ সীমানায় পৌঁছে খাওয়ার পালা সমাপ্ত হল।
বলব আর কি? জগতে কত বিচিত্র যে আছে তা কে বলে শেষ করতে পারে। মানুষের মনের মাঝে অতিথি সৎকারের এমন ভয়াবহ ইচ্ছেও যে লুকিয়ে থাকতে পারে তা এই সমাদর দৈত্য কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার আগে জানা ছিল না।
মিরু আমাকে বলল, তুই ঘুমিয়ে পড় আমি খালাদের সাথে এত কথা বলে আসি।
আমি বললাম, এতরাতে আবার খালাদের সাথে কী আলাপ থাকতে পারে?
সে মুচকি হাসি হেসে বলল,পারে রে পারে। তুই বুঝবি না।
আমার আর বুঝে কাজ নেই। আমি শুয়ে পড়লাম। ঝিরঝিরে বাতাসে একটু শীত অনুভূত হচ্ছিল। আমি কাঁথা মু্ড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। চারিদিক শুনশান। খুব তাড়াতাড়িই আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন হলাম।
এমন সময় দাদু এসে আমার মুখ থেকে কাঁথা সরিয়ে বলল, দাদু, আমার সৌভাগ্য যে,তোমরা আমার মত গরীবের ঘরে পদধূলি দিয়েছ। ঠিকমত যত্ন করতে পারছি না। তোমার তো কোন কষ্ট হচ্ছে না দাদু?
আমি বললাম, সে কী বলছেন দাদু। আমার আবার কষ্ট কীসের। আমি চৌদ্দ আরামে আছি।
দাদু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম।
একবার তন্দ্রা ঘুচে গেলে আবার সহজে চোখে ঘুম নামে না। তবুও অনেক চেষ্টা করে কেবল ঘুমঘুম ভাবটা চলে এসেছে। ঠিক তখনই আমার মাথার উপর থেকে কে যেন কাঁথাটা সরালো। আমি বললাম, কে?
আমি দাদু। আমার খুব খারাপ লাগছে।কোনোদিন আসো না। আমার ভাগ্যগুণে কেমনে জানি আসলে। তোমাকে খাতির যত্ন করতে পারছি না। নিশ্চয়ই তোমার কোন কষ্ট হচ্ছে। এটা ভেবে আমিও মনে মনে কষ্ট পাচ্ছি।
আমি বললাম, কী বলছেন দাদু। মানুষ এর চেয়ে বেশি কী আর খাতির করতে পারে? আপনি গিয়ে ঘুমান। আমার কোন কষ্ট হচ্ছে না। আমাকে নিয়ে আপনি অযথা ই ভাবছেন। দাদু আমার গায়ের কাঁথাটা টেনেটুনে ঠিক করে দিয়ে চলে গেলেন। আমিও কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। আর মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম। হে আল্লাহ এই দাদু যেন বাকি রাতটুকু আমার কষ্ট হচ্ছে কী না সেটা জানতে না আসে। তার মন থেকে সমাদরের ভয়াবহ ইচ্ছেটা তুলে নাও।
বোধকরি আমি আল্লাহ পাকের তেমন পছন্দের বান্দা নই। সে জন্য আমার দোয়া কবুল হয় নি। তাই আবার ঘুমে পড়ব পড়ব করছি এমন সময় আবার দাদু এসে হাজির। এবার মুখ থেকে কাঁথা না সরিয়েই বললেন, দাদু, কোন রকম কষ্ট হচ্ছে না তো?
আমি বললাম, হ্যা দাদু কষ্ট হচ্ছে।
দাদু ত্রস্তে আমার শিয়রে বসে বললেন, কী কষ্ট হচ্ছে দাদু?
বললাম, আপনিই আমার কষ্ট। এই যে বার বার কাঁচা ঘুম নষ্ট করে যত্ন আত্তি করতে আসেন তাতেই আমার কষ্ট হচ্ছে।
দাদু হো হো করে হেসে বললেন, আরে বোকা। সেটা আগে বলবে তো।
দাদু চলে গেলেন।
সমাদরের অত্যাচারটার কষ্টদায়ক ক্ষতটি আমার মনে রয়েই গেল।
বৈশাখ, ০৬, ১৪৩০
ময়মনসিংহ।