মানুষে গিজগিজ করছে ফুটপাত। পা ফেলার জো নেই। বিকেল যত ঘনিযে আসছে, ভিড় তত বাড়ছে। ক্ষণে ক্ষণে হকাররা হাঁক ছাড়ছে। হকারদের গগনবিদারী কন্ঠে চলছে আহবান..লাগলে আইসেন.. দেড়শো.. দেড়শো.. খালি দেড়শো...। পথচারীর কর্ণ ঝালাপালা করে ফুটপাতে হকারদের ক্রেতা আকৃষ্টের এই অদ্ভুত পদ্ধতি গিলে সামনের মানুষটি কিছু কিনবে কিনা বুঝা যাচ্ছে না। দেখে মনে হচ্ছে, তাঁর বয়স পঞ্চাশ উদ্ধো। মাথার চুল উস্কোসুস্ক। মুখে দাড়ি আছে খোঁচা খোঁচা। চিন্তাগ্রস্থ। ক্ষানিকটা মাথা ঝুকে হাঁটছেন। মাঝে মাঝে থামছেন। এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছেন। হন্টনকøান্ত তবুও হাঁটছেন। হাঁটার সময় যখন আকাশের দিকে তাকান তখন বুঝা যায় না, তিনি উচু ভবন দেখছেন না আকাশ খুঁজছেন!
আমরা পান্থপথ থেকে ফার্মগেটের পথে যাচ্ছি। ওনি আমার সামনে, আমি পিছনে হাঁটছি। দুরুত্বের ব্যবধান খুব কাছাকাছি হলে হন্টনরত মানুষটাকে আমি চিনতে পারি। তিনি আমাদের গ্রামের বাল্যবন্ধু রাসেলের বাবা, আমরা তাকে ‘মনোয়ার চাচা’ বলে ডাকি।
‘মনোয়ার চাচা, মনোয়ার চাচা ’- বলে সামনে গিয়ে আমি তাকে জড়িয়ে ধরি।
মনোয়ার চাচা আমাকে সবকিছু খুলে বলেন। তিনি বলছেন, আমি শুনছি। দু’জনের চোখে জল ঝরছে। মনোয়ার চাচার একমাত্র ছেলে আমার বাল্য বন্ধু রাসেলের আটমাস ধরে খোঁজ নেই। সে ঢাকায় পড়াশুনার পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতো। গত বছর ঈদের ছুটি কাটিয়ে ঐ যে বাড়ি থেকে এসেছে, আর হদিস নাই। পরিবার সবখানে খুঁজেছে, কোথাও সন্ধান পায় নাই। এবার ছেলের খোঁজে মনোয়ার চাচা নিজেই ঢাকাতে এসেছেন। প্রতিনিয়ত ছেলেকে খুঁজতে ফুটপাত তালাশ করছেন।
ফুটপাত তালাশ নিয়ে আমাদের গ্রামে ‘অবিশ্বাস্য হলেও সত্য’- জাতীয় একটি ধারণা প্রচলিত আছে। কেউ যদি নিখোঁজ হয়, তাহলে তাঁকে শহরের ফুটপাত গুলোতে খুঁজতে হয়। ফুটপাতে নাকি সব পথহারা মানুষের বসত। বন্যায়, খরায়, শীতে এখানে মানুষ ছুটে আসে। মনোয়ার চাচাও সেরকম কল্পনা করেছেন। যতই হোক অভাবের সংসার, সে নিশ্চয়ই কিছু করছে বা খুঁজছে!
মনোয়ার চাচা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়েন। তারপর আবার বলতে শুরু করেন।
ছেলে ফিরে আসার আশা যখন প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন তিনি, এমন সময় রাসেলের ফোন আসে। অপর প্রান্ত থেকে শুধু এতটুকু শোনা যায়-‘আমি বেঁচে আছি বাবা’। মনোয়ার চাচা তড়িঘড়ি করে তুমি কোথায় কোথায় বলতেই লাইনটা কেটে যায়। কলের জন্য অপেক্ষা করেন, কল আসে না। কল ব্যাক করতে গিয়ে ভড়কে যায়। বিদেশি নম্বর। তাহলে কি রাসেলও? মানে পাচারের শিকার ? মনোয়ার চাচা আর বলতে পারেন না। তিনি বাচ্চা শিশুদের মতো অঝোরে কাঁদতে থাকেন।