মিলিটারি ক্যাম্পে গুপ্তচর
আব্দুল খালেক ফারুক
প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২১
বাবুই প্রকাশ
প্রচ্ছদ আল নোমান
মূল্য : ১৫০
আব্দুল খালেক ফারুক একজন প্রগতিশীল মানুষ। পেশায় কলেজের শিক্ষক। সাংবাদিকতায় জড়িত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। সংবাদের পিছনে ছুটতে গিয়ে পেয়ে যান গল্পের প্লট। বাস্তব অভিজ্ঞতা আর সত্য গল্প অবলম্বে কলমের কর্ষণের লিখেন গল্প। যা আমরা এর আগেই প্রমাণ পেয়েছি তার লেখা গল্প, উপন্যাস ও নাটকে। ‘মিলিটারি ক্যাম্পে গুপ্তচর’ বইটিও মুক্তিযুদ্ধকালীন ৫টি সত্য ঘটনা অবলম্বে রচিত। লেখক বইটি রচনা করেছেন কিশোরদের উপযোগী করে। কিন্তু কিশোরদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, হয়ে উঠেছে সকল বয়সী পাঠকদের জন্য সুখপাঠ্য একটি গ্রন্থ। এই গ্রন্থের চারটি গল্প কুড়িগ্রাম-গাইবান্ধা আর একটি গল্পের পটভূমি বগুড়া।
এটি শুধু গল্পগ্রন্থ বললে ভুল হবে। এটি পড়লে পাঠক মাত্র জানতে পারবেন ১৯৭১ সালের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ। যুদ্ধের অজানা বিবরণ। পাকিস্তানিদের অত্যাচার। রাজাকারদের দেশদ্রোহীতা। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনবাজী রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরা। পাকিস্তানিদের শোচনীয় পরাজয়। বীরসন্তানদের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া লাল সবুজের পতাকার উপখ্যান। একটি মানচিত্র পাওয়ার গল্প। যা পাঠককে মুক্তিযুদ্ধের মন্ত্রে দীক্ষিত করে দেশপ্রেমিক করতে সাহায্য করবে।
এই গ্রন্থের গল্পসমূহে লেখক আব্দুল খালেক ফারুক কখনো নিজেই বর্ণনা করেছেন রুদ্রশ্বাসে। কখনো জুড়ে দিয়েছেন অন্য কোন কথককে; যিনি টানটান উত্তেজনায় শেষ পর্যন্ত পাঠককে নিয়ে গেছেন গল্পের শেষ অবধি। পাঠক ঠিক তেমনি এক নি:শ্বাসে গল্পগুলো পড়ে যাবেন। বইটি পড়া শেষ করেও পাঠকের মনে হবে আরো কয়েকটি যদি গল্প জুড়ে দিতেন। এটাই আব্দুল খালেক ফারুকের কৃতিত্ব।
এই গ্রন্থের প্রতিটি গল্পে রয়েছে আলাদা আলাদা স্বাদ। পড়তে পড়তে পাঠককেই হারিয়ে যেতে হবে একাত্তরে সেই সময়ে।
‘দ্রুম। দ্রুম।’ শুরুর লাইনটিতেই পাঠক চমকে উঠবে। শুধুই কি পাঠক? ১৯৭১ সালে এই শব্দে কেঁপে উঠেছিল বাংলা মায়ের বুক। আর মায়ের হাজারো সন্তান। আব্দুল খালেক ফারুক রচিত ‘মিলিটারি ক্যাম্পে গুপ্তচর’ গল্পগ্রন্থের প্রথম ও নামগল্প শুরু হয় এই চেনা শব্দ দিয়ে। তারপর আলম ও তার চাচা মোসলেম মিয়ার কথপোকথন পাঠককে নিয়ে যাবে তাদের ছোট বেলায়। মনে করে দিবে তাদের সেই জানার আগ্রহকে। হাঁটতে হাঁটতে আলমের কৌতুহল মেশানো প্রশ্ন ও মোসলেম মিয়ার উত্তর চলতে থাকলে গল্পও হেঁটে যায় অনায়াশে। খুব কাছেই গুলির আওয়াজ হওয়ায় মোসলেম মিয়া আলমকে কাঁধে নিয়ে পাটক্ষেত দিয়ে দৌড় দেয়। হঠাৎ একটি গুলি আলমের পেটের চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে পাশে গিয়ে পড়ে। আলমকে গুলি লাগলে পাঠক হয়তো ধরে নিতেই পারে একটি মৃত্যু আর এর প্রতিশোধ। কিন্তু আসল ঘটনা অন্য। ১৫ দিনের কবিরাজি চিকিৎসাৎ আলম সুস্থ হয়ে হয়। একদিন দিনমজুর কাদের চাচার দুধ ও কলা গোসাইবাড়ির হাটে বেঁচতে যাওয়ার পথে আলম ডেকে নিয়ে যায় মিলিটারিরা। তারপর তাকে খেতে দেয় রুটি মাংস। বুঝিয়ে দেয় দুধ ও কলার টাকা। সেদিনের মতো আলম বাড়ি যায়। তার আসার খবর ছড়িয়ে পড়লে বাড়িতে পরে কান্নার রোল। আলম ফিরে আসলে সবাই চিন্তা মুক্ত হয়। আলমকে মানা করলেও খাওয়ার লোভে আলম চুপি চুপি ক্যাম্পে যেত।
যুদ্ধ ভয়াবহ হলে আলমদের থাকতে হয় বাঙ্কারে। এ জীবন ভালো লাগে না তার। একদিন মুক্তিযোদ্ধারা আলমকে পাঠাতে চায় মিলিটারি ক্যাম্পে গুপ্তচর হিসেবে। আলম রাজি হয় এক কথায়। সেখানে আলমের চোখে দেখা ঘটনাপ্রবাহ শিহরিত করে। পরের দিন আলমের দেওয়া তথ্যমতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি নরপশুদের খতম করে। আলমের গুপ্তচরবৃত্তিতে মুক্তিবাহিনীরা আনে বিরাট জয়।
দ্বিতীয় গল্প ‘নিমক শপথ’। লেখক গল্পটি শুরু করেন প্রচলিত শিশু-কিশোর গল্পের নমুনায়। নাতির আবদারে দাদু হোসায়েন আলীর জবানীতে লেখক গল্পটি বর্ণনা করেন। গল্পটি যে গল্প নয়, তা আগেই বলেছি। মহসিন নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তার রাজাকার বাবাকে গুলি করে হত্যা করেন। মহসিনের মতে সে তার বাবাকে হত্যা করেননি। হত্যা করেছেন এক রাজাকারকে। যে সকাল বেলা তাকে মিলিটারিদের হাতে ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল। মায়ের হাতের রান্না হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত না খেয়েই পালিয়ে বেঁচেছিল মহসিন। রাতে মাকে দেখার নাম করে বাড়ি গিয়ে তার বাবাকে হত্যা করে। লেখক বর্ণনা করেন,
“ওস্তাদ, ট্রেইনিং ক্যাম্পে আমরা মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী কামরুজ্জামান স্যারের কাছে নিমক শপথ করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘বাবা যদি শত্রু হয়, তাহলেও ছাড় পাবেন না।’ আপনি কী সেই নিমক শপথের কথা ভুলে গেছেন? আমার বাবা একজন সন্তানকে নয়, এক মুক্তিযোদ্ধাকে পাকসেনার হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। তাই উচিত শিক্ষা দিয়েছি তাঁকে।”
এর চেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্য আর কি হতে পারে! মহসিনের রক্তে যখন যমুনার জল রঞ্জিত হয় তখন ভাবতে বাধ্য করে মহসিনের মায়ের কি হলো?
তৃতীয় গল্প ‘দাদুর দেওয়া ঘড়ি’। এই গল্পটিতে আজিজার নামে এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধার দাদুর দেওয়া ঘড়ির প্রতি ভালোবাসা আর যুদ্ধের ঘটনা সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখক। এই গল্পে বৃহত্তম স্থলবন্দর সোনাহাট অপারেশন সম্পর্কে জানা যায়। কিভাবে আজিজার ও হোসায়েনসহ মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি সোনাহাট ব্রিজ মাইন বিস্ফোরণ করে পাকিস্তানিদের গাড়ি উড়ে দেয় এবং ব্রিজ ভেঙে পাকিস্তানিদের গতিরোধ করে তা সম্পর্কে জানা যাবে। বিস্ফোরণের পর তুমুল যুদ্ধ চলে। আজিজারদের রসদ ফুরিয়ে আসায় জীবন বাজি রেখে নদীতে ঝাঁপ দেন। সেই সময় পাকসেনাদের গুলি খেয়ে দুধকুমার নদে ডুবে যান আজিজার। পরে পুটিমারি চরে সন্ধানে মেলে আজিজারের কবর। আর তা সনাক্ত করা হয় সেই ঘড়ি দেখে। পরে দাদুর দেওয়া সেই ঘড়িটি আজিজারের মাকে দিলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন আজিজারের মা। একজন বীরযোদ্ধার মা।
কুড়িগ্রামের বীরপ্রতিক আব্দুল হাই এর বীরত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে সাজানো ‘ক্ষুদে কমান্ডার’। এগল্প যেন গল্প থাকে না। চোখের সামনে ভাসে সিনেমায় দেখা কোন ছায়াছবি। যেখানে দেখা যায় হারান ভাটিয়ার তেজি ঘোড়া। তার পিঠে যাওয়া একজন কোম্পানি কমান্ডার। যাত্রাপুর হাট। ব্রহ্মপুত্র নদী। ৭ মার্চের ভাষণ। এক ১৬ বছরের তরুণ কীভাবে কমান্ডার হয়ে উঠলেন। ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে বাহাদুরবাদ ঘাট। সেখান থেকে নৌকায় করে কুড়িগ্রাম। মায়ের সাথে সেই তরুণের দেখা। মায়ের কাথা সেলাই করা দেড় টাকা মিলে ২ টাকা নিয়ে ট্রেনিং এ যাওয়া। বয়স কম ও সাইজে খাটো হওয়ার পরেও বীর সন্তান আব্দুল হাই এর সাহস, পাকসেনাদের আক্রমণ, অতঃপর বিজয়। সব যেন চোখের সামনে সেলুলয়েডের মতো ভেসে ওঠে।
মিলিটারি ক্যাম্পে গুপ্তচর গল্পগ্রন্থের শেষ গল্প ‘গাড়িয়াল’। যারা গরুর গাড়ি চালায় তাদের গাড়িয়াল বলা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা রাজাকারদের সাহায্য নিয়ে যে হত্যা, ধর্ষণ, লুট ইত্যাদি করে তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। এর থেকে সবাই তাদের পরিবার পরিজনকে বাঁচাতে ব্যস্ত হয়। তেমনি গরুর গাড়িতে করে গাড়িয়াল আফজাল জলিলের পরিবারের মহিলাদের নিরাপদ যায়গায় নিয়ে যেতে থাকলে পাকসেনাদের গুলির আওয়াজ শুনে পথ পরিবর্তন করতে চাইলে জলিল আফজালকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই চালাতে থাকেন গরুর গাড়ি। কারো বাঁধা না শুনে সামনে যেতে থাকলে হঠাৎ গুলি এসে লাগে গাড়িয়াল জলিলকে। জলিল চলে যায় ওপারে।
গল্পগুলো যত সাদামাটা ভাবে আলোচনা করা হলো- আসলে তা এত সাদামাটা নয়। গল্পের ভিতরে আছে আরেক গল্প। ‘মিলিটারি ক্যাম্পে গুপ্তচর’ কিশোরেরা পড়লে জানতে পারবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ যা তাদের মনে সৃষ্টি করবে দেশপ্রেম। দেশের প্রতি বাড়িয়ে তুলবে ভালোবাসা। তাদের গড়ে তুলবে সাহসী। বইটি শুধু কিশোর নয় সকল বয়সী পাঠককে পড়ার আমন্ত্রণ।