সম্পাদকের প্রধান কাজ হল, নিরপেক্ষ ভাবে লেখা বিচার করা। লেখকের নাম দেখে নয়, লেখার মান দেখে তা বিচার করা।
অবশ্য নিরপেক্ষতা মানে এই নয় যে তার ব্যক্তি ও সম্পাদক সত্তার আলাদা কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। অবশ্যই তা থাকবে। তার নিজস্ব রুচিবোধ, বিচারবোধ থাকবে। যেহেতু তিনি সাহিত্য সম্পাদক, বলা বাহুল্য তার সাহিত্য সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে। জমা পড়া অনেক লেখার মধ্য থেকে তাকে জহুরির মতো সাহিত্যগুণ সম্পন্ন হীরকখন্ডটি (লেখাটি) বাছাই করে নিতে হবে।
(এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে , 'কবিতা' পত্রিকার সম্পাদক কবি বুদ্ধদেব বসুর কথা। তিনিই প্রথম কবি হিসেবে আবিষ্কার করেছিলেন জীবনানন্দ দাশকে। তার আগে কেউ জীবনানন্দ দাশকে 'কবি জীবনানন্দ' হিসেবে তেমন ভাবে চিনতেন না। আর যারা চিনতেন, তারাও তাকে কবি হিসাবে মেনে নিতে পারতেন না। সত্যি কথা বলতে গেলে, তার লেখাগুলো যে কবিতা তা অনেকেই সেই সময় স্বীকার করতে চাননি এবং তা সমসাময়িক কবিদের চেয়ে তিনি যে শুধু ভিন্ন নন, সময়ের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে, এককথায় সমকালের কবিদের মন ও মানসিকতার তুলনায় ভিন্ন ধারার, এ'কথা ওই সমসাময়িক কবিরা অনেকেই বুঝতেই পারেননি। তাই তখন তার লেখা সমালোচকদের হাত থেকে নিস্তার পায়নি। সজনীকান্ত দাস তাঁর কবিতা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন বহুবার। উপহাস করেছেন তার কবিতা নিয়ে । সভা-সমিতিতে তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা মস্করা করেছেন। রবীন্দ্রনাথও তার কবিতার আধুনিকা বুঝতে না পেরে, তাকে শুধুমাত্র 'চিত্রকাব্য' আখ্যা দিয়েম এড়িয়ে গেছেন।)
আমার দেখা সম্পাদক হিসাবে সাগরময় ঘোষের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি সমরেশ বসু, বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী, সুনীল গাঙ্গুলী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী প্রমুখ প্রতিধাধর লেখদের বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় তুলে এনেছেন।
যথার্থ একজন সম্পাদক এক নজর দেখেই বুঝে নেন কোন লেখাটির মধ্যে সাহিত্যগুণ আছে, কোনটিতে নেই । কিন্তু সমস্যা হলো,
— সাহিত্য বিষয়টি এমন একটি ভাবের বিষয়-বস্তু যে, একজন সম্পাদকের কোন লেখা ভাল না লাগলেও অন্য কোন সম্পাদকের তা সহজেই ভাল লেগে যেতে পারে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই । একই লেখা নিয়ে বিভিন্ন সম্পাদকের মধ্যে তাই ভিন্ন ভিন্ন মতামত থাকতে পারে, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তবে, একজন কবি বা লেখকের জীবনে সম্পাদকের ভূমিকা অসীম, এ কথা অনস্বীকার্য। লেখক ও সম্পাদকের সম্পর্ক একে অন্যের পরিপূরক। কোন হীরকখন্ডের যেমন বাইরে থেকে ঔজ্জ্বল্য ধার নিতে হয় না, তবে সুপরিকল্পিতভাবে হীরকখন্ডটি কাটিং করলে শুধু ঔজ্জ্বল্যই বাড়ে না, সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে ওঠে তার সৌন্দর্যের দ্যুতি । তেমনি একজন সম্পাদক জহুরির মতো নতুন প্রতিভাবানদের নিজেরই তাগিদে তুলে নিয়ে এসে তাদের দ্যুতি বাড়িয়ে তুলতে পারেন। তিনি সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে (পাঠকের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে) অপূর্ব এক মধুর স্বাদ অনুভব করেন হৃদয়ে, একথা অনস্বীকার্য। অজ্ঞাতপ্রায় হারিয়ে থাকা লেখকদের পাঠকদের সামনে এনে হাজির করেন তিনি।
এখন প্রশ্ন —সাহিত্য সম্পাদকের করণীয় কাজটা কি?
এক কথায় বলতে গেলে, নিরপেক্ষভাবে লেখা বিচার করা। লেখকের নাম দেখে নয়, লেখার মান দেখে লেখা বিচার করা উচিৎ তার। সাহিত্যের মান বিচার করতে গেলে নিজের অনুভূতি দিয়ে তা বিচার করতে হয়। নিজের জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে তা পরীক্ষা করতে হয়। তাই, যথেষ্ট পরিমাণে তার সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান বুদ্ধি থাকতে হয়। ক'জন সম্পাদক আর সেই পরিশ্রমটুকু করতে রাজী হন? নামী লেখদের লেখা প্রকাশ করতেই তারা বেশি আগ্রহ বোধ করেন। কারণ, নামী লেখকরা কি লিখছেন তা অনেকে না জানলেও, তিনি যে একজন নামী লেখক তা অনেকেই জানেন। তাই তাদের লেখা প্রকাশ করায় অনেক ঝুঁকি কম। তাছাড়া মানসিক ভাবে সাহিত্যের মান বিচার করার পরিশ্রমটুকু করার প্রয়োজন হয় না। তবে সম্পাদকের দায়িত্ব অনেক কমে যায়। সম্পাদক এ রকম ফাঁকিবাজ হলে, সেই পত্রিকার মান আর কত ভাল হতে পারে, তা তো সহজেই বোঝাই যায়।
লেখক যেভাবে লেখা পাঠান, লেখা হুবহু সেভাবেই প্রকাশ করা উচিত সম্পাদকের। তবে এটা মনে রাখতে হবে, সম্পাদকের মতো লেখকও একজন সাধারণ মানুষ। তাই কোনও সময় বানান বা বাক্যগত কোনও ত্রুটি থেকে যেতেই পারে, সে ক্ষেত্রে সম্পাদক নিজের প্রয়োজন মতো ত্রুটি সংশোধন করে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করবেন। এবার কথা হলো — তিনি লেখকের সঙ্গে আলোচনা করে সেটা করবেন, নাকি তার অনুমতি ছাড়াই করবেন?
লেখকের সঙ্গে আলোচনা করে কাজটি করতে পারলেই ভাল হয়। লেখকের অনুমতি ছাড়া সম্পাদক নিজের মতো করে লেখকের লেখায় কলম চালালে, তার লেখার মৌলিকতা যেমন নষ্ট হতে পারে , তারচেয়েও বেশি কষ্টদায়ক হয় , অনেক সময় লেখকের পক্ষে এই পরিবর্তন মেনে নেওয়া। হয়তো তিনি বিষয়টি নিয়ে অন্যরকম কিছু ভেবে লিখেছিলেন লেখাট তার। সে ক্ষেত্রে সম্পাদকে কোনও লেখায় কলম চালানোর আগে লেখকের সঙ্গে একবার আলোচনা করে নিতে পারলে ভাল হয়। সেটাই হওয়া বঞ্ছনীয় মনেহয়।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায়, ভিক্টর গোলাঞ্জ বলেছেন, ‘সম্পাদনা তুলনামূলক নতুন একটা বিষয় আর এটা শুধু গদ্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।’ এরপর তিনি আরও লিখেছেন, ‘একজন গীতি-পরিচালক যেমন সম্পাদিত গীতির কথা চিন্তা করে গীতিকারকে দিয়ে গান লিখিয়ে নেন, কিংবা এমন একজন চিত্রব্যবসায়ী যিনি সম্পাদনা করে চিত্রকর দিয়ে আঁকিয়ে নিলেন, তিন চিত্রকরের কথা ভাবেন না ! ... আমি যদি লেখক হতাম, আমি আমার লেখায় অন্যকে হাত দিতে দেওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া শ্রেয় মনে করতাম।’ ভিক্টর গোলাঞ্জ একেবারে ভুল বলেননি। তিনি সম্পাদনার বিপক্ষে না, তবে অতিসম্পাদনার পক্ষেও নন। তিনি সুন্দরভাবে সম্পাদনা করার সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, সম্পাদনা কখনও কখনও শিল্পকর্মের শৈল্পিক গুণকে নষ্ট করে দেয়।'
তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিখ্যাত ইংরেজ কবি টি এস এলিয়ট তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’ লেখার পর সম্পাদনার জন্য অগ্রজ কবি, সমালোচক ও সম্পাদক এজরা পাউন্ডের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এজরা পাউন্ড কবিতাটির একটা বড় অংশ ফেলে দিয়েছিলেন। পরে এলিয়ট মনঃক্ষুণ্ন হলেও এই সম্পাদিত কবিতাটি বিশ্বপাঠক ও নোবেল প্রাইজ কমিটির নজর কেড়েছিল, এমনকি ১৯৪৮ সালে এই কবিতা রচনার জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান এবং এখনও এটি আধুনিককালের অন্যতম কবিতা হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই কবিতা থেকে শুরু করে সব ধরনের লেখাই সম্পাদিত হলে সেটা বস্তুনিষ্ঠ হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে পাঠযোগ্য (কামরুল হাসান শায়ক)।
প্রকৃত সাহিত্য সম্পাদকের উচিৎ নবীনদের লেখকদের প্রকাশের আলোয় নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করা। প্রকৃত প্রতিভাকে প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়া তার প্রথমিক কর্তব্য।
স্বল্প সাহিত্যে-জ্ঞানের সঙ্গে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি সম্পন্ন সম্পাদকরা সাহিত্যচর্চার নামে নিজস্ব দল গঠন করেন। জোর গলায় চিৎকার করে বলেন, 'নতুনদের সাহিত্যের আঙ্গিনায় তুলে এনে নতুন ভাবনার ঝড় বইয়ে দেবেন'। সাহিত্যে নতুন জোয়ার আনবেন বলে দাবিও করেন। প্রথাগতঃ পদ্ধতির বাইরে গিয়ে নবীনদের নতুন ভাবনাকে জায়গা করে দেবেন। কিন্তু সূচিপত্র দেখে বোঝা যায় (সূচিপত্র জানিয়ে দেয়) পর্দার ভেতরে থাকা গোপন রহস্য। নতুনদের সুযোগ নয়, বরং তাদের সুযোগ দেওয়ার নাম করে, নিজের স্বার্থসিদ্ধি করাই এই শ্রেণীর সাহিত্য সম্পাদকের গোপন উদ্দেশ্য। তারা নতুন লেখকদের মাথা মুড়িয়ে, তাদের ব্যবসাটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলেন। নতুন লেখকদের আখরে কিছুই লাভ হয় না। শেষপর্যন্ত তারা প্রতারিত হন, এইসব সম্পাদকের পাল্লায় পড়ে। সব খারাপের মধ্যেও কিছু ভালো থাকে। নতুন কিছু মুখের সঙ্গে নতুন ধ্যানধারণা আর একইসঙ্গে উঠে আসে বর্তমান প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি, নতুনদের সৃষ্টিতে।
আবার নিজেকে কবি-লেখক নামে পরিচিত করার জন্য অনেকেই সাহিত্য পত্রিকা শুরু করেন। প্রথম সারিতে বড় বড় নামিদামী কবি-লেখকের লেখা রেখে বাকিটা নিজেদের লেখা প্রকাশ করেন। অনেক সম্পাদক আবার সম্পাদনার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশকও হয়ে ওঠেন। যাদের কবিতা তার পত্রিকায় ছাপেন, তাদের ভুল বুঝিয়ে ঘোল খাইয়ে বই বের করিয়ে নেন বাজারের তুলনায় দ্বিগুণ মূল্যে। এই ধরনের ব্যক্তিরা সম্পাদক নামের কলঙ্ক।
এদের সম্পাদক নামে অভিহিত করলে, প্রকৃত সম্পাদকদের অপমান করা হয়, যারা আজও নিজেদের পকেট মানি বাঁচিয়ে, তা খরচ করে পত্রিকা বের করে থাকন একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। নিজেদের অমূল্য সময় ব্যয় করেন পত্রিকা প্রকাশ করার কাজে। এমন সাহিত্যগুণসম্পন্ন যোগ্য ব্যক্তির অভাব নেই। আর এরা আছে বলেই এখনও বাংলা সাহিত্য সংকীর্ণ পরিধিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েও, শেষ হয়ে যায়নি। আশার আলো দেখাবে সেই সব সম্পাদকেরাই ভবিষ্যতে। তারাই সাহিত্যের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলে।
লেখক পরিচিতি
শংকর ব্রহ্ম - ১৯৫১ সালের ২রা মার্চ, কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন ।
১৯৭০ সাল থেকে লেখা-লেখি শুরু। প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা শ'পাঁচেক-এর বেশী। প্রায় শতাধিক পত্রিকায় লেখেন। যেমন “দৈনিক বাংলা স্টেটসম্যান”, “পুরশ্রী”, “প্রসাদ”, “ঘরোয়া”, “বিকল্প বার্তা” (শারদীয়া সংখ্যা - ১৪২৮ এবং ১৪২৯), শব্দ সাঁকো, সয়ংসিদ্ধা, অমেয়, দৈনিক দেশজগত, বঙ্গীয় সাহিত্য দর্পণ, শব্দনগর, উদ্ভাস, শব্দ লেখা, নীলকমল, বোধগম্য, অচিন পাখি, স্বরধ্বনি পত্রিকা, সৃজাম্যহম্ , খেয়ালী খাম, কাব্যতরী, কাব্যপট, ইলশে গুঁড়ি, সাময়িকি (নরওয়ে থেকে প্রকাশিত),আশ্রম (অটোয়া থেকে প্রকাশিত) প্রভৃতি।
এ'ছাড়াও লিখেছেন সমরেশ বসু সম্পাদিত “মহানগর”, “শিবনারায়ণ রায়” সম্পাদিত “জ্ঞিসাসা”, কিরণ শংকর সেনগুপ্ত সম্পাদিত “সাহিত্য চিন্তা”, পবিত্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “কবিপত্র” দীপেন রায় সম্পাদিত "সীমান্ত সাহিত্য" প্রভৃতি পত্রিকায়। তিনি বহু পুরস্কার পেয়েছেন।
তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - “তোমাকে যে দুঃখ দেয়”, “স্মৃতি তুমি আমাকে ফেরাও”, “যাব বলে এখানে আসিনি”, “আবার বছর কুড়ি পরে”।
এ'ছাড়াও কবির আরও দশটি “ই-বুক” প্রকাশিত হয়েছে।