“তুর গতর টোয় আর আগের মত মজ নাই রে, দিখলে খিদা লাগেক লাই বটে|”
ডগরের দড়ি পাকানো, বিবস্ত্র দেহ টাকে, বিছানায় একপাশে ফেলে, গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পরে “দেবু সারেন”| তাঁর বলিষ্ঠ সুঠাম দেহে, কাষ্ঠল পেশীগুলো ক্রমশঃ ফুটে উঠতে থাকে, যেন মদন মোহন মন্দিরের গায়ে, বিষ্ণুপুরী টেরাকোটা ভাস্কর্য| ডগর তখনও পরে থাকে একে বেঁকে, যেন আস্ত একটা কালাচ সাপ, ঘন শীতের, অপাংক্তেয় সূর্য্যের আলো থেকে সরে গিয়ে, কুন্ডলী পাকিয়ে চলে গেছে, মোক্ষম এক শীত ঘুমে| দেবু সম্পর্কে ডগরের ভাসুর হয়| ওর মরদটা পাগল হয়ে ঘর ছেড়েছে বছর দশেক হলো| শেষবার পাড়ার লোকে জঙ্গলে যেতে দেখেছিল| সময়টা দিন আর সন্ধ্যের মাঝামাঝি| সমস্ত জঙ্গল জুড়ে তখন রং লেগেছে| মেরুদন্ড বেয়ে, শব্দ তোলা চরম শ্বাসে, বড় বড় পলাশ গাছগুলোতে, আকাশ কুসুম দোল দিচ্ছে| ঠিক যেরকম একদিন, দোলায় চেপে, মরদের হাত ধরে, দুলতে দুলতে, ডগর শ্বশুর বাড়ি এসেছিল, দলমা র শরীরের, যাযাবরী মজ্জার পার্বত্যপথ পেরিয়ে| সেও ছিল, কোন এক জন্মান্তরের সময়, শীতের শেষ, বসন্তের শুরু| মরদ টা ছেড়ে যাবার পর থেকেই, ডগর দেবুর সাথে শোয়, দেবুই ওকে ডেকেছিল একদিন| লোভী পায়ে এগিয়ে গিয়ে, প্রায় লোহা হয়ে যাওয়া শরীরের, বিবর বেয়ে চুঁয়ে পরা, মসৃণ স্বেদ চেটে নিয়েছিল ডগর, তার শ্রীহীন জিভ টা দিয়ে| যৌবনের অমেধ্য কাঁটা তারে, কৃষ্ণবেনী এক সাঁওতাল তরুণীর, অনতিক্রম্য মেয়েলী লাবণ্য, পিষে গিয়েছিল, দেবুর ভীমসম, উষ্ণ মর্দনে| অথচ প্রথমে, দেবু ডগরকে, নিজের ছোট ভাইয়ের বৌয়ের চোখেই দেখত| এ যেন এক নির্বাণী অজাচার|
জঙ্গলে পূর্ণিমা হলে, যেমন রাতের শেষ টুকু, ডুব দেয় গর্ভবতী কাঁসাইয়ের কোলে, সেইরকম বাসি শরীরের, এঁটো অতৃপ্তি নিয়ে, দেবুর বিছানা ছেড়ে উঠে পরে ডগর| এবেলা জঙ্গলে যেতে হবে, মহুয়া ফুল কুড়োতে| এইসব করেই, দুবেলা খাবার জোটে ওদের, এই অবাধ, দুয়ারে সরকারি সুবিধার, নশ্বর দুনিয়াতেও| “ডগর সারেন” ঠিক কবে, এই আপাদমস্তক সাঁওতালী লাল পেরে, শাড়ী জড়ানো, শুশুনিয়ার কোলে, দাঁত বের করে হাসতে থাকা, কালো কুচকুচে শিউলিবনায় এসেছিল, তা আর তার মনে পরে না| তখন সে বছর ষোলোর “ছুড়ি”| বিয়ের পর, মরদের সাথে সে জঙ্গলে যেত, পাতা কুড়োতে, সাথে কুড়াত “মহুল” ফুল| বাড়িতে এনে, হাঁড়ির জলে খেঁজুর পাতা দিয়ে ভিজিয়ে, তাতে পচ ধরলে, কুড়োনো শুকনো পাতা আর ডাল জ্বালিয়ে, গনগনে আঁচে জ্বাল দিত, যতক্ষন না অবধি মারটা গাঢ় হয়| এই গন্ধটায় নেশা ধরে যায়| আশে পাশের জঙ্গল থেকে ভাল্লুক বেরিয়ে আসে কখনো| গন্ধটার সাথে ডগরের ভালোবাসা হয়ে গেছিল| এরকম ভালোবাসা হয়ত তার মরদের সাথেও ছিল না| মরদটা তার চিরকালই একটু বেখেয়ালে| হাঁড়িয়া বানাত কখনো কখনো, কখনো দিশি মদ| তারপর সেই মহুয়া-হাড়িয়া-চোলাই, বড় হাড়ি করে চালান দিত, আশেপাশের গ্রামে| বসন্তের শেষ রোদ তখন, তেরছা হয়ে পরে, মিলিয়ে যেতে চাইছে, শাল সেগুনের ছায়াটার সাথে| গোল করে ছড়িয়ে পড়া রোদটা, যেন ডগরেরই মত, সিঁদুরে রঙের আঁকিবুকি আঁকত, ওদের বাড়ির দেওয়ালে,উঠোন জুড়ে, যেমনটা ডগর দিত “বাঁদনা” পরবের দিন| কার্তিকের অমাবস্যায়, জঙ্গলটার যেন রূপ খোলে| যেন জঙ্গলেতে আরেক ডগর, অনেক ডগর, ওরা সবাই কালো| পলাশের দিনে, ডগর ঝুমুর নাচত| ওর মরদ মাদল বাজাত| দেবু আর বাকি মুরুব্বিরা, দূরে বসে দেখত আর হাসি তামাশা করত| ওর পেলব শরীরের বর্গক্ষেত্রের ভাঁজে, যেন লুকিয়ে ছিল সাক্ষাৎ মরণ, ওর মরদের মরণ| জঙ্গলে গিয়ে “ভুলাকন্যা” মাড়িয়েছিল নির্ঘাৎ| সে গাছ মাড়ালে, আর কেউ ফেরে না| যমের মতো টেনে নিয়ে যায়, জংলী রাস্তার বাঁকে| ঘন জঙ্গলে, উঁচু উঁচু গাছের শরীর বেয়ে, গড়িয়ে আসা রোদ আর হিমেল কুয়াশার সর, তাকে ডাকে, পথ হারিয়ে মাথা কুরে মরে সারা জীবন| তারপর একদিন যখন, শরীরে আর জোর থাকে না,বাঘ কিংবা হায়নায় ছিড়ে খায়| হয়তো ওর মরদেরও এই হাল হয়েছিল| ডগর খোঁজ করেছিল কিনতু বেশী তদ্বির করতে পারেনি| লুকিয়ে চোলাই হাড়িয়া সাপ্লাই করে যারা,তারা হঠাৎ একদিন, জঙ্গলের চৌরাস্তায় মিশে গেলে, বেশী দৌড়ঝাঁপ করতে নেই|
দেবুর পাশ থেকে উঠে, আজ আবার জঙ্গলে গেল ডগর সারেন| হয়ত বা আজ তার হারিয়ে যাবার পালা| জঙ্গল কি তাকে নেবে? সতী হবার কোন সাধ, আর তার নেই| বরং তার দেহের এই, স্বার্থপর যৌনলিপ্সা মেটানোর, আক্ষরিক চেষ্টার সাক্ষী থাকে, এই গোলার্ধের, নৈসর্গিক অন্ধকারের প্রতি অমনোযোগী, সূর্য্যশোক| জঙ্গলে ঢোকার মুখে তার সাথে দেখা হয়ে যায় “মাগলা” খুড়ার| বুড়া তখন, ক্ষেতের আলে ধুনি জ্বালিয়ে, ধেড়ে ইঁদুর ধরছে| পিছনে তার মস্ত ঝুড়িটা হাওয়ায় দোল খায়| ডগরের বিগত যৌবনা শরীরের, সমস্ত আকাঙ্খা, ক্রোধ, সমবেদনা, সব জাগতিক অনুভূতিগুলো থেকে, পিছলে আসা রোদের, অতিবেগুনী রশ্মি টাকে, বুড়া যেন চাপা দিয়ে রেখেছে, ওর এই ঝুড়িটা দিয়ে| ফাঁক থেকে উঁকি মেরে, ডগরের সাথে অহরহ, “কানা মাছি” খেলে চলেছে ওরা| বুড়া আগে ভালো “ছৌ” নাচত| নাচতে নাচতে, শূন্যে উঠে, লাফ দিয়ে ঘুরপাক খেত| সে সময়ে পৃথিবীর গতি, স্তব্ধ হয়ে যেতে দেখেছে ডগর| একদিন পরে গিয়ে বুড়ার ঠ্যাং ভাঙলো, নাচ ছেড়ে বুড়াও এখন হাড়িয়া বেঁচে|
জঙ্গলের শুরুতে গাছপালা অল্প| যুবতীর শরীর হাতড়ালে, সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে, জঙ্গলও তাই| ঘন থেকে গাঢ় হয় ক্রমশঃ| শেষ আলোটার মুখে, লেগে থাকে অন্ধকারের এঁটো| ছোট ছোঁড়া দুটোও আজ সঙ্গে এলো| ভুলিয়ে ঘরে রেখে আসা গেলো না কিছুতেই| মায়ের সাথে হাত লাগিয়ে, শুকনো পাতা মুঠো করে কুড়িয়ে, চুপড়িতে ভরতে লাগলো| কিছুদূর গেলেই মহুয়া গাছ| ছোট ছোট ঝড়িয়া ঘাসের পথরেখা, গায়ের রোমকূপ ঢেকেছে, লাল পলাশের কাঁচুলিতে| ছেলেগুলো নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে থাকে, "বেশী দাঁত টো বিগলাইস না, মারিকে তুর দাঁত গুলা ঝরিং দিব|"
আধখানা কাস্তের মতো পিছনে বেঁকে, ধমক দিয়ে ওঠে ডগর, "এই ছোড়া, ঝামেলাটো পাকাইনছিস কেনে রে? চোপার বারি দিয়া কান টো কাটাইন ফিলে দিব|"
ছেলেদুটো আবার চুপ করে যায়| বাইরে থেকে নিদ্রাবিলাসী জঙ্গলের বুক চিরে "ঝুমুর" গান ভেসে আসে|
"ঝুমুর নাচে ডুমুর গাছে ঘুঙুর বেঁধে গায় (লো)|
নাচন দুজন মাদল, বাঁশি, নুপুর নিয়ে আয় (লো)|"
গাছপালা-মাঠ-প্রান্তর ছাড়িয়ে, একটা অদ্ভুৎ গন্ধ ভেসে এসে, ডগরের নাক দিয়ে ঢুকে, উরোজে সজোরে টোকা মারে| গন্ধটা ওর বিয়ের দিনের গন্ধ| দূরের বনবীথি আর গন্ধটার মাঝে, এখন শুধু ও আর ওর আত্মজ| পাশের গাছটা দিয়ে, একটা কাঠবেড়ালি, একটা মহুয়া ফল মুখে করে নিয়ে দৌড়ে যায়, একটু থেমে ভেংচি কাটে| জটিল অববাহিকা বেয়ে, দূরে একটা “বৌ কথা কও” ডেকে ওঠে| ধোঁয়ায় কুন্ডলি পাকিয়ে, হাতির ডাক ভেসে আসে| এ দিকটায় এখন, দলমা থেকে, হাতির পাল নেমে আসে| ক্ষেতে ঢুকে যায়, ফসল নষ্ট করে, বাড়ি ঘর দোর ভেঙে দেয়| ছেলেগুলো ভয়ে ডগরকে ঘেঁষে দাঁড়ায়| অল্প এগিয়ে থমকে যায় ডগরও| সামনের জমিতে স্তুপ করে কিছু ওষুধ পরে| সাথে বেলুন, সাদা রঙের| এরকমটা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে দেয়, ডগর চিনতে পারে| সামনে বেশ কিছু সিরিঞ্জ পরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে| এগুলোও ডগর চেনে| অজানা বিপদের আশংকায় বুক কাঁপে ওর| দু পা পিছিয়ে আসে| হঠাৎ পেছন থেকে দুটো ছায়ামূর্তি, ঝাঁপিয়ে পরে ওর ওপর| ওর কয়েকদিনের ঠিক করে না খেতে পাওয়া শরীর টা নিয়ে, ডগর আছড়ে পরে মাটির ওপর| ওর ওপরে লোক দুটো, টেনে হিঁচড়ে ওর কাপড় খুলতে চায়| ওরা যেন এখন জংলী চিতার থেকেও হিংস্র| একটা লোক ডহরের হাতদুটো চেপে ধরে| অন্য লোকটা ওর ওপর শুয়ে পরে, ওর কান গলা বরাবর দাঁত ঘষতে থাকে| ডগরের ছেলেগুলো, দূরের শালগাছটার আড়ালে লুকিয়েছে তখন| হঠাৎই ওর নিজের ছেলেদের কথা মনে পরে| সারা শরীর জুড়ে ওর, এক নিদারুন ত্রিভঙ্গী ভোল্টেজ খেলে যায়| এক ঝটকায় ওর ওপরের লোকটাকে সরিয়ে, কোমরে লুকানো হাঁসুলী টা বার করে ডগর, মাথার উপর তুলে ঘোরাতে থাকে| দাঁত মুখ খিচিয়ে, সমাপনী তীব্রতায় ছুটে যায়, লোকগুলোর দিকে| দীক্ষিত পৃথিবীর বুকে, শ্লথ গতিতে জমা, পাপ স্খলনের লক্ষ্যে বৃষ্টি নামে| সোঁদা মাটির, জংলী বাসন্তিক আঘ্রাণে, উলঙ্গ গাছেরা নৃত্য শুরু করে| লোকদুটো পালাতে, ছেলেদুটো ছুটে এসে ডগরকে জড়িয়ে ধরে| ডগর তার পরনের ছিন্ন বস্ত্র খন্ডের “আঁচল”, মেলে ধরে ওদের মাথায়| অসময়ের বৃষ্টিতে, ওর ছোড়া গুলোর অসুখ করতে পারে|
জঙ্গল ছিড়ে বেরিয়ে আসে, একটা মাঝারি হাতির পাল| এতক্ষন ভাবা গেছিল, নিদাঘ ধরিত্রীর বুকে, দুধ এনে দেবে, আপোষহীন বৃষ্টিটা| কিন্তু এবার সেটা ওদেরও, একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় খুঁজে পাবার, তাগিদ হয়ে দাঁড়িয়েছে| ওদের দলের সব থেকে ছোট বাচ্চাটা, ওর মায়ের পেটের তলায় ঢুকে হাটছে| ওদের সবার এখন একটা আঁচল দরকার| দলবদ্ধভাবে একটা নিষ্কাম আচ্ছাদন আজ বড় প্রয়োজন|