ভবঘুরে ।। লুৎফুন নীরা

 


ভাষার মাস।শিল্পকলার দেয়ালগুলিতে ফুটে উঠছে নান্দনিক চিত্রবহর।বঙ্গবন্ধু সহ আছে অন্যান্য চিত্রকথা। আমি বসে আছি শিল্পকলার সিঁড়িতে।যেন আমার কোনো ব্যস্ততা নেই এমনিই বসে আছি।অনেক কাজ পড়ে আছে অথচ  স্বভাবে  কোনো আভাস প্রচার হয়না।মাঝে মাঝে এমনও হয় খুব জরুরি  কাজগুলো ফেলে চুপ হয়ে বসে থাকি।এখন বসে বসে গাড়ীগুলোর আসা যাওয়া দেখছি আর বিচিত্র রকমের হর্ণের  আওয়াজ মুগ্ধ হয়ে শুনছি।রিকশা, টমটম,মোটর সাইকেল এদের আনাগোনাই বেশি।দুয়েকটা কার,এম্বিউলেম্স ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না।ব্যস্ততম এলাকা হলেও  সেই ছোটবেলা থেকে যেমন দেখেছি দু একটা এদিক সেদিক ছাড়া এই শহরটার আর তেমন কোনো  পরিবর্তন হয়নি।জেলাশহর হলেও মফস্বলের ছোঁয়া এখনও লেগে আছে গায়ে।জটলা পাকানো চার পাঁচজন তরুণ আমার দিকে তাকিয়ে কী যেন বলে চলল এবং সবাই একসাথে হো হো করে  হেসে উঠল। আগে একসময় এমন ঘটনায় অস্বস্তি হতো এখন  আর হয়না।বরং ইচ্ছে হয় তাদের পাশে গিয়ে সামিল হই।তবে আপাতত সামিল না হয়ে অন্যদিকে গিয়ে বসলাম।কারণ তারা আমার ভাবনার মনোযোগ নষ্ট করছে। ভাবনার এই জগতটা আমার খুব প্রিয়।এখানে আমি একান্তই আমার,আর কারো স্থান নেই।তবে আমার সরে আসায় তাদের হাসি  যেন আরও উচ্চস্বরে কানে বাজতে লাগল।খারাপ লাগার বদলে একটু হেসে নিলাম।যাই হোক এখান থেকে তাদের কথা শোনা যাচ্ছেনা তবে মনে হলো  উচ্চ হাসিটা  তারা ইছে করেই করছে।আবার  মনোজগতে প্রবেশ করলাম।কিন্তু  আমার ঠিক দশকদম দূরেই দুজন নারী পুরুষের দীর্ঘ আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে একটা সাত আট বছরের বাচ্চা ছেলে থেমে থেমে চিৎকার করছে 'খিদা লাগছে, বাসায় যাব মা '।প্রথমে ভাবলাম তারা এক পরিবার পরে ভুল ভাঙল। তাদের তুমুল আলোচনার ঝড়ে  ছেলেটির খিদের কথা শুনে হাসি পাচ্ছে,  এরা যতো উচ্চস্বরে কথা বলে ততোই জোড়ে ছেলেটিও খিদা লাগছে বলে চিৎকার করে ।শেষে মা তার ছেলেকে নিয়ে চলে গেলেন আর পুরুষটি সম্ভবত তার বাচ্চার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।প্রতিদিন বিকেলে বাচ্চাদের বাবা মা তাদের শিশুদের নিয়ে আসেন গান,আবৃত্তি, নাচের প্রশিক্ষণ ক্লাসে।
আর আমার মতো কিছু ভবঘুরেও আসে।কেন আসে? 

স্মতির পাতা থেকে -ঈদুল ফিতর!
মুহাম্মদ রাইস উদ্দিন -

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ। /
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্ আসমানী তাগিদ।----

জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের  এই কালজয়ী গানটি সেই ছোট্ট সময় থেকেই রোজার শেষের দিকে- 
রেডিও টেলিভিশনে বাজাতো। কিশোর মন তখন ঈদের আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠতো।
আমার শৈশব-কৈশোরের সোনালী-রুপালি স্মৃতিতে আজও সেই আনন্দঘন দিনগুলির ভেসে উঠে বার বার। 
আমার জন্ম মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার চান্দহর ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রামে।গ্রামের নাম সিরাজ পুর — সেখানেই আমার বেড়ে উঠা। সেই গ্রামীণ পরিবেশেই আমার শৈশব, বাল্য ও কৈশোর। সেই স্মৃতিময় স্বপ্নিল পরিবেশেই আমি আমার বাল্য ও কৈশোর  স্কুলজীবন অতিবাহিত করেছি।
 সে সময়ের অনেক স্মৃতিই আমাকে এখনো হাতছানি দিয়ে ডাকে। জীবনের গোধূলিলগ্নে এসে আজ মনে পড়ে, বাল্যকালের অনেক ঘটনা, অনেক মধুর স্মৃতি। এই স্মৃতিচারণে কত না পরিচিত মুখ বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠে। মধুর স্মৃতিতে চিরভাস্বর হয়ে আছে আমার শৈশব-বাল্য-কৈশোরকালের রমজানের ঈদ উদযাপন।
“ঈদ মানেই অনাবিল আনন্দ, ঈদ মানেই খুশি। ঈদ মানেই সকল বেদনা দুঃখ কষ্ট ভুলে এক চিলতে হাসি। ঈদ মানেই যেন আলোর ঝর্ণাধারা, ঈদ মানেই সকলকে একসাথে কাছে পাওয়া।
“ বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান দেশ।তার প্রত্যেকটি গ্রাম যেন প্রকৃতির এক অপূর্ব রঙ্গশালা। যেদিকে চোখ যায়-অবারিত সবুজ মাঠ, ফুলেফলে ভরা গাছপালা, তৃন গুল্মশোভিত বন-বনানী ও শ্যামল শস্যেক্ষত- এই অনুপম রূপসুধা পান করে সকলের হৃদয়ে এক অভিনব আনন্দের শিহরন জাগে।
ঈদের আগের রাত (চাঁদ রাত) কতই না মধুময় ছিলো! 
পালা করে হাতে মেহেদী লাগানো!
ফুপুরা মেহেদি পাতা পিষে হাতের তালুতে আর নখে লাগিয়ে দিতো। হাতে দীর্ঘক্ষন মেহেদি রাখতে হতো। অনেক সময় মেহেদি হাতে নিয়েই শুয়ে পড়তাম। বিছানার চাদরে, কাপড়ে কিংবা বালিশে হাতের মেহেদি লেপ্টে লালচে রং হয়ে যেতো। আম্মার বকুনি খেতাম। ওইদিন রাতে ঘুম আসতো না।
নানান স্বপ্নে মন আন্দোলিত হতো। খুব ভোরে সজাগ হয়ে দেখতাম মা-চাচী আর আপুরা উঠুন ঝাড়ু দিচ্ছে। বাড়ির দক্ষিণ মিয়া বাড়ির পুকুরে গিয়ে- ছাই হাতে দাত মেজে পুকুর পাড়ে বন্ধুদের সাথে গোসল করতাম মা এসে বকুনি দিয়ে গায় সাবান লাগিয়ে দিতেন।
চোখে সাবানের ফেনা যেতো। কান্না করতাম। এদিকে ঘনিয়ে আসছে ঈদের নামাজের সময়। দাদী, মা/চাচীরা রাতেই পিঠা প্রস্তুত করে রাখতেন। পিঠা খেয়ে নতুন জামা গায়ে হাতে আতর মাখিয়ে নিতাম। শীতল পাটি হাতে করে হাজির হতাম মসজিদের আঙিনায় সিরাজ পুর ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহে।
 মসজিদের হুজুরের মুখে আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর ধ্বনি যেন ঈদের দিনের বিশেষ তাৎপর্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দিতো। আমরাও সুর মিলাতাম। নামাজ শেষ। এখনো খুতবা শেষ হচ্ছেনা! 
দীর্ঘ মুনাজাত। বিরক্তির উদ্রেক হতো। অতঃপর ঈদের নামাজ শেষে বড়দের কুলা কুলি চলাকালিন আমরা বাড়ি ফিরতাম।
সকালে ঈদের সালামি যা উঠতো তা নিয়ে বন্ধুর সাথে সিনেমা দেখতে যাওয়া আরও কত কি। 
সেসব না হয় অন্য সময় আাবার লিখবো।
জীবনের গোধূলি লগ্নে এসে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলছি-
আজ সমাজ ভাগ হয়ে গেল।এক সময় আটিপাড়া ইসলাম পুরের একটা অংশ অর্থাৎ তিন গ্রামের সিংহভাগ মানুষ আমাদের সিরাজপুর ঈদগায় নামাজ পড়তো।তারা অনেক আগেই আমাদের সান্নিধ্যে ছেড়েছে।
ছোট থেকে সুখে-দুঃখে যারা একসাথে বেড়ে উঠেছি তাদের দুদিকে নামাজ পড়তে যাওয়া বড়ই পরিতাপের বিষয়। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় মনে পিড়া দেয় কিন্তু কে বুঝবে অন্তরের কষ্টের আকুলিবিকুলি? 
কাকে দোষ দিব? 
কেউই ছাড় দিতে রাজীনয়।ইগো মানষকে প্রতিহিংসা পরায়ন করে তুলে।আল্লাহর কাছে প্রার্থনা-
মানুষকে তুমি উদার করো!
বিচ্ছিন্নতা নয় ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্যে কর!
হিংসে বিদ্বেষ নয় মানুষের মধ্যে ভালো বাসার সেতুবন্ধন তৈরি হোক।
ঈদ হোক আনন্দময়! দুঃখ কষ্ট আর খুশি যেন আমরা ভাগকরে নিতে পারি সেই যোগ্যতা আমদের দাও হে প্রভূ।
দেশ ও বিদেশে সকল বন্ধু শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতি ঈদের অগ্রীম শুভেচ্ছা। ঈদুল ফিতর সকলের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ ও খুশী। 

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।