১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস। অকালবন্যায় সারামুল্লুক পানিতে থৈ থৈ। আমাদের এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। তখনকার দিনে পাড়াগেঁয়ে কোন ছোকরা এসএসসি পরীক্ষায় বসবে সেটা একটা খবর বটে। মা চাচীরা চিড়া মুড়ি,গুড়মুড়কির আয়োোজন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন কিন্তু আমার তামাটে কপাল বন্যার বাড়াবাড়ি বেয়াদবির জন্য ওসবের কোন আয়োজন আর হল না।
আমি যে ছনের ঘরটিতে পড়াশোনা করি সেটা বাড়ির বাইরে। আঙিনার একেবারে উত্তর পার্শ্বে। ঘরের ভেতরে উরু পানি। চৌকি উঁচু করতে করতে পানির দৌড়ানিতে একেবারে ধর্ণার উপর উঠে গেছে। মই লাগিয়ে চৌকিতে উঠানামা করি। একপাশে বইপুস্তক খাতা পেন্সিল। অন্যপাশে শুয়ে থাকার ব্যবস্থা।
সারাদিন শুয়ে শুয়ে বিমল মিত্রের কড়ি দিয়ে কিনলাম উপন্যাসে ডুবে থাকা। সতীর প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া। ঘোষাল বাবুকে কাল্পনিক লাত্থি মারা আর রাতের বেলায় কোথাকার কোন সক্রেটিসের বৃত্তান্ত মুখস্থ করা।
বৃহস্পতিবার আমাদের এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। আমরা পরীক্ষার্থী বন্ধুরা মিলে বাজিতুল্যা ভাইয়ের নৌকা ঠিক করেছি। সোমবারে আমরা নৌকায় চেপে পরীক্ষা দিতে চলে যাবো।
সোমবার দুপুরে রায়েরপাড়া থেকে মিরু নৌকা নিয়ে এলো। আমাদের সকল আয়োজন মিরুই করে থাকে। এ বিষয়ে ওর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। নৌকায় আরও এগারো জন বন্ধু এসেছে। বাড়ির উঠান দিয়ে নৌকা ঢুকে গেল আমার ঘরে। আমি উপর থেকে বিছানা পত্র বই পুস্তক নৌকায় নামিয়ে দিলাম। বড় ডিঙি নৌকা। বসার ভাল ব্যবস্থা আছে। দেখে মনটায় এক রকম ফাজিল সুখ উথলে উঠতে লাগল।
তখনকার দিনে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে মুরুব্বিআদি,আত্মীয় স্বজনকে সালাম করে দোয়া নেয়ার রেওয়াজ ছিল। তারাও মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করতেন। যারা রাত জেগে বই মুখস্থ করত তাদের জন্য সেই আশীর্বাদ মন্ত্র শক্তির মত কাজ করত। যারা সারাদিন ফাড্ডি খেলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াতো এবং বই পুস্তক কে ইয়াজুজ-মাজুজের দেয়াল মনে করতো তাদের জন্য মুরুব্বিগণের আশীর্বাদ তেমন একটা কাজে লাগতো না। যা হোক, এই ভয়াবহ বন্যার কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কারো আশীর্বাদ নেয়াটা একেবারে কল্পনাতীত।
নৌকার গলুই ঘর থেকে আঙিনায়। পূর্ব দিকে উজান স্রোতবেয়ে যেতে হবে আমাদের আরেক সহপাঠী রাজ্জাক কাকাকে নেয়ার জন্য।
নৌকার মাঝি বাজিতুল্যাহ ভাই গপ্পোবাজ লোক। পুরো বর্ষাকাল তার নৌকায় করেই আমরা আড্ডা দিয়ে কাটাই। সেও আমাদের মত আড্ডাবাজ ছেলে ছোকরাদের সাহচর্য পরম আনন্দে উপভোগ করে।
পশ্চিমা বাতাসে পাল তুলে দেয়া হল। বাজিতুল্যা ভাই নৌকার হাল ধরে রইল। মিরু পালের রশি ধরে পাল নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল। অল্প সময়েই আমরা রাজ্জাক চাচার বাড়ির ভিতরে নৌকা নিয়ে প্রবেশ করলাম।
রাজ্জাক চাচা আমাদের চাচা এবং ক্লাসমেট। প্রাইমারি স্কুলে আমরা যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখন রাজ্জাক চাচা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। তার অস্বাভাবিক শানিত মেধার কারণে তাকে এক ধাক্কায় তৃতীয় শ্রেনিতে নামিয়ে দেয়া হয়। তার এই মাইনাস শানিত মেধার কারণে আমরা তার ক্লাসমেট হওয়ার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করি।
রাজ্জাক চাচার পরীক্ষা দিতে যাবার আয়োজন অনেকটা আবুল মনসুর আহমদের হুজুর কেবলা গল্পের পীর সাহেবের মত। পীর সাহেব মুরীদদের এলাকায় হিজরত করার জন্য যে এলাহি কাণ্ড ঘটিয়েছিল রাজ্জাক চাচার আয়োজনটাও তেমনি।
তাদের বাড়িতে পচাবহলা গ্রামের মফিজ মুন্সি জায়গীর থাকত। সে চিনাডুলী মাদ্রাসায় দাখেলী শশমে পড়াশোনা করতো। রাজ্জাক চাচার বাবা মফিজ মুন্সিকে সাথে দিলেন। পাছে তার আদরের ছেলেটির খাবারের কষ্ট হয় সেই আশঙ্কায় । বলা আবশ্যক যে, রাজ্জাক চাচার বাড়ি থেকে যে পরিমাণ মাল সামানা নৌকায় তুলে দেয়া হয়েছিল তা দিয়ে আমাদের সবারই খরচা পুষিয়ে গিয়েছিল।
বাজিতুল্যাহ ভাই নৌকা ছেড়ে দিল। এই ভরা বন্যায় নদীনালা দিয়ে যেতে হয় না। সারা জনপদ যেন এক সমুদ্র। যেদিকে তাকানো যায় থৈথৈ করে পানি আর পানি। তাই সোজা রাস্তায় পালের নৌকা দ্রুতই ইসলামপুর গিয়ে পৌঁছলো। আমরা নেকজাহান হাই স্কুলের হোস্টেলে গিয়ে উঠলাম।
বিভিন্ন স্কুল থেকে ছাত্ররা এসেছে। তাদের সাথে পরিচয়,গপগুজব করতে করতে রাত হয়ে এলো। আমরা যার যার হ্যারিকেনের চিমনি সাফ করে সলতেয় আগুন দিলাম। মফিজ মুন্সি আমাদের উপর আদেশ জারি করলো যে, তোমরা তাড়াতাড়ি খেয়ে সবাই পড়তে বসো।
এখানে বলে রাখা ভাল যে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২,৭৩ সালে পরীক্ষার হাল এমন হয়ে যায় যে হলের চেয়ার টেবিলগুলোও এসএসসি এইচএসসি পাশ করতে থাকে। পরীক্ষার হল তো নয় যেন সাবরেজিস্টার অফিসের দলিল লেখার মুক্ত আঙিনা। যে যেখানে ইচ্ছে বসছে। যা ইচ্ছে লিখছে। মাস্টাররাও এমনটি বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, বই না দেখলে নিরীহ ছাত্র ছাত্রীরা বিশুদ্ধ উত্তর লিখবে কী করে।
এমনও দেখা গেছে পরীক্ষার হলের বাইরে পরীক্ষার্থীর জসনালার কাছে হেল্পার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হা়টুতে রস নেমে হাঁটু ফুলে গেছে। অবশেষে পরীক্ষার্থী বন্ধুটি যখন বলছে তার হেল্প লাগবে না তখন হেল্পারের বাঁদরী আচরণের প্রকাশ ঘটেছে। নিষ্ঠীবনের বৃষ্টির কথা আর না ই বা বললাম।
পূর্ববর্তী বছরগুলোর অভিজ্ঞতায় সবাই ফুরফুরে মেজাজে আছে। পরীক্ষা তো নয় যেন সবাই বনভোজন করতে এসেছে। "আম বাগিচার তলায় যেন তারা হেসেছে।"
মফিজ মুন্সি রাধুনি হিসেবে কেমন ছিল সেটা বলা যাবে না। কেননা, যে সকল ব্যঞ্জন রান্না করলে তার স্বাদ রাঁধুনির মান নির্ণায়ক হয় সে কখনো তা রান্না করে নি।
আজ প্রথম দিন। সে সরপুঁটি মাছ ভেজে সবারই খাবার থালা সাজিয়ে দিয়েছে। আমরা বারান্দায় বসে গুলতানি করছিলাম। মফিজ মুন্সিও গুলতানিতে গুলমারায় অংশ নিয়েছিল। ঘর ফাঁকা পেয়ে এক দশাসই মর্দা বিড়াল এসে কোন এক থালা থেকে মাছভাজা তুলে নিয়ে চম্পট দেয়। ফলে সবাই মনক্ষুন্ন হয়। কেবল আমিই মার্জারের এমন অনধিকার প্রবেশ এবং মৎস্যাপহরণ ইসরায়েলি জবরদস্তি এবং দখলদারিত্বের সাথে তুলনা করি। হামাসের মত প্রতিজ্ঞা করি যে বিড়ালের উপযুক্ত সাজা না দিয়ে আমি পরীক্ষায় বসব না। আমার এমন প্রতিজ্ঞার আরও একটি কারণ হলো যে, মফিজ মুন্সি বললো, যে থালাটি থেকে বিড়াল মাছ অপহরণ করেছে সেটা আমার জন্য নির্ধারিত ছিল।
আমার এমন মাটিখাওয়া প্রতিজ্ঞা করতে দেখে মফিজ মুন্সি আমাকে সংক্ষিপ্ত কিছু নছিহত করলো। যেমন, বিড়াল অতিশয় শিষ্ট এবং পবিত্র প্রাণী।আমাদের দ্বীনের নবী রসুলে মকবুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিড়ালকে খুব ভালবাসতেন। তাই বিড়ালকে মারা শরীয়তের খেলাফ।তা ছাড়া বিড়ালের অভিশাপে মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়।
যা হোক আমি মনে মনে তক্কে তক্কে রইলাম। কীভাবে মার্জার মহাশয়ের অভিশাপ অর্জন করতে পারি।
পরদিন পরীক্ষা শুরু। প্রথমদিন সকাল বেলা বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষা। সকালে নেয়ে খেয়ে অনেকটা সময় নিয়ে পরীক্ষা হলে গেলাম।
যথারীতি পরীক্ষা শুরু হল। প্রত্যেকেই প্রয়োজনীয় কেতাব আদি নিয়েই হলে ঢুকেছে।এবার সবাই তাদের কেতাব শরীরের বিভিন্ন গোপন এলাকা থেকে মুক্ত করে বেঞ্চের উপর রেখে লিখতে শুরু করলো। মনে হলো পরীক্ষা তো নয় একেবারে নকলের মচ্ছব।
কোথাও কোথাও মাস্টাররা দয়াপরবশ হয়ে ব্যাখ্যাগুলো কোত্থেকে এসেছে, কোন গল্পে কার উক্তি ইত্যাদি সহযোগিতা করে ছাত্রদের পেরেশানি লাঘব করছে।
অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে পরীক্ষানুষ্ঠান সমাপ্ত হলো।
আমরা যারা বোকার মত সারা বছর হ্যারিকেনে কেরোসিন পুড়ে বই মুখস্থ করেছিলাম তারা আফসোস করতে শুরু করলাম।
একঘন্টা পর বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা শুরু হবে। হোস্টেলে আসতেই মফিজ মুন্সি আমাদের খাবার দিল। আমরা নাকেমুখে খাবার গুঁজে আবার পরীক্ষার হলে রওনা হলাম। খাবার সময় লক্ষ করলাম সেই দুর্বৃত্ত বিড়াল মফিজ মুন্সির আস্কারা পেয়ে বঙ্গবিজয়ী বখতিয়ার খিলজির মত লেজ নাড়িয়ে আমাকে ভাব দেখাচ্ছে। পরীক্ষার তাড়ায় ধৈর্যধারণ করে আক্রমনাত্মক অন্তরক্রোধ সংবরণ করলাম।
পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। আবার সেই উৎসবের সূচনা। তবে কী যে ছিল বিধাতার মনে। হঠাৎ করেই একজন।ম্যাজিস্ট্রেট এবং আটদশজন সশস্ত্র রক্ষীবাহিনীর সদস্য পরীক্ষার হলে যমদূতের মত এসে ঢুকলো। উৎসবের পুষ্টিকর উপাদান সেই সব বই লুকোনোর মত সময় কেউ পাচ্ছে না। রক্ষীবাহিনী এক এক জনের নিকট থেকে বই কেড়ে নিচ্ছে এবং পিঠে আর পাছায় সজোরে ঘুষি, লাত্থ্যাঘাত দিয়ে বের করে দিচ্ছে। সাথে বোনাস হিসেবে দিচ্ছে চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করার মত অশ্রাব্য বচনামৃত।
ব্যক্তিগতভাবে আমি আকস্মিক এই সুনামিতে ভীত কম্পিত হলেও যেহেতু কেতাবাদি বহন করিনি সেহেতু এক রকম সৎ সাহস পিলসুজের মিটিমিটি বাতির মত মনের গভীরে জ্বলছিল।
আমরা সাতান্ন জন ছিলাম। ভয়াবহ সুনামিতে টিকে রইলাম চৌদ্দ জন। পরীক্ষার হলে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত মনে হচ্ছিল আমাদের অবস্থান। তবে পরিবেশ অপ্রত্যাশিতভাবে নিরব হওয়ায় আমার হ্যারিকেনে কেরোসিন পুড়িয়ে রাত জেগে পড়াটা বেশ কাজে লাগলো।
বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা শেষ হল। হোস্টেলে ফিরে দেখলাম আমার পাঁচবন্ধু রক্ষীবাহিনীর লাঠ্যযত্নের শিকার হয়ে শয্যাগ্রহণ করেছে।
এতকিছুর পরও আমি বিড়ালের উপর প্রতিশোধ নেয়ার বিষয়টি ক্ষণিকের জন্যেও বিস্মৃত হইনি।
দস্যুবনহুরে নিশিদিন মাথাগুজে বহু রোমহর্ষক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি কিন্তু জীবনের প্রথম বিড়াল বধ করা সমস্ত কল্পকাহিনিকে হার মানিয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, বিড়ালের জল্লাদ নামে আমার কুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমিও সামান্যতম বিব্রত না হয়ে হাল আমলের পলিটিশিয়ানদের মত গর্ববোধ করতাম। আমার কথা হলো নাম তো নামই। সুনামে সুখ্যাতি কুনামে কুখ্যাতি। খ্যাতি তো আছে।
হোস্টেলের পরিবেশটা থমথমে ছিল। কেননা,অনেকগুলো নকল বিশারদের পতন ঘটেছে। তারা বিষন্নমনে গাঁটকিবুচকা বাঁধতে শুরু করেছে। আমার রুমে চারজনের মধ্যে দুজনেরই হিজরতের টিকিট কনফার্ম হয়েছে।রাজ্জাক চাচা কেতাব সাথে নেয়ার কৌশল
জানতেন না। তাই পরীক্ষার হলে প্রবল মরুঝড় শুরু হলে
কলম দাঁতের ফাঁকে চেপে ধরে বসে ছিলেন যদিও তা কম্পন এবং দাঁতকপাটি থেকে বাঁচার জন্য। রক্ষীবাহিনী তাকে অত্যন্ত সৎ পরীক্ষার্থী ভেবে তার কাছেও ঘেঁষেনি। এখন আমরা দুই চাচা ভাতিজা কেবল ঝড়ের কবল থেকে বেঁচে আছি।
গতকাল পরীক্ষার হলে যে তাণ্ডব ঘটে গেছে তা কারোরই কল্পনায় ছিল না। কেননা, এর আগের দুবছর পিতাপুত্র, দাদা নাতি একসাথে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষা উৎসবের আনন্দে কেটেছে। বাড়ির কাছের ছাতিম গাছটাও পাশ করে ডিগ্রি লাভ করেছে। এবার সরকার বাহাদুর কেন যে এমন নিষ্ঠুর হলেন বোঝা মুশকিল। সবাই ঝড়ের পর নেতিয়ে পড়া ডালপালার মত নিথর হয়ে পড়ে
রয়েছে। কেবল আমাদের বাবুর্চি মফিজ মুন্সিরই কোন বিকার নেই। সে নিয়মিত রান্না করে চলেছে। তার পরীক্ষার্থী বহিষ্কার হয় নি এটা নিয়ে সে গর্ব করছে। পাঁচজনকে নকলবিরোধী নছিহত শোনাতেও ছাড়ছে না।
শুক্রবার সবাই টুপি পাঞ্জাবিশোভিত হয়ে দলবেঁধে জুম্মার নামাজে গিয়েছে। আমার মনমেজাজ তেমন ভাল নেই। কারণ আমার পেছনে যে বন্ধুটি পরীক্ষা দিত তার সাথে আমার অলিখিত চুক্তি ছিল। সে আমাকে পাটীগণিত, বীজগণিতে সহযোগিতা করবে তার বিনিময়ে আমি তাকে এরাবিক গ্রামার ট্রান্সলেশন এবংকম্পোজিশনে উৎরিয়ে দেবো। কালকের ভয়াবহ অভিযানে সে রক্ষীবাহিনীর
প্যাদানি খেয়ে পরীক্ষা থেকে ছিটকে পড়েছে।আমি ভাবছি এখন আমার অংকের কী হবে।
শুয়ে শুয়ে এমনি সাতপাঁচ ভাবছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম সেই মৎস্যাপহারী হুলো বিড়াল ঘরে ঢুকলো। আমি মার্জার মহোদয়কে দেখে নির্বিকার। এমন ভাব করে রইলাম যে,তার আগমন যেন আমি টেরই পাই নি। আমি সুযোগের অপক্ষায় রইলাম কখন সে আমার নিকটবর্তী হয়। সে হাড়ি পাতিলের খোঁজ খবর নিতে লাগল। এক সময় দেখলাম একটা পাতিলের মধ্যে মুখ ঢুকালো। পাতিলের প্রতি মনোযোগ নিবেশ করার সাথে সাথে আমি দ্রুত গিয়ে মহোদয়ের লেজ ধরে ঘুরাতে লাগলাম। এমন ঘটনার জন্য হয়তো সে প্রস্তুত ছিল না। সে কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই আমি দেয়ালের সাথে মাথা আছড়াতে লাগলাম। দেয়ালে দুতিন বার মাথা আছড়াতেই এক অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা ঘটে গেল। মারের চোটেই হোক আর ভয় তরাসেই হোক মার্জারের মার্গদিয়ে তার উদরে জমাকৃত মলরাশি ছিটকে আমার শরীরে এসে পড়ল। অল্পের জন্য মুখে প্রবেশ করেনি। পাশেই মফিজ মুন্সির বিছানা মার্জারমলে রঞ্জিত হয়ে গেল।
যখন সেটাকে লেজ ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে শোয়ালাম তখন সে পৃথিবীর সকল পাতিলের মৎস্যরাশিকে নিরাপদ করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। আমি পেরেশান হয়েছিলাম তবে স্বস্তি পাচ্ছিলাম এই ভেবে যে, জীবদ্দশায় এমন কঠিন প্রতিশোধ নিতে পেরেছি।
সবাই নামাজ শেষে ফিরে আসছে। মফিজ মুন্সি প্রথম ঘরে ঢুকে বিড়ালের মরদেহ দেখতে পেলো। সে বুঝতে পাচ্ছিল না যে ঘটনাটি কী ঘটেছে। আমি মার্জারমল ধৌত করার জন্য ইঁদারার ধারে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে ঘরে ঢুকতেই মুন্সি বললো, এইটার কি হইছে?
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনা রটনা হয়ে গেল।
সমবেত সহপাঠীদের মধ্যে একদল আমার এই নির্মম বীরত্বের প্রসংশা করতে লাগলো অন্যদল আমার এহেন অমানবিক আচরণের নিন্দায় মুখর হয়ে উঠলো। আমি যতই তাদের বুঝাতে চেষ্টা করি যে, মানবের প্রতি নির্মম আচরণই কেবল অমানবিক। পশু তো মানব নয় তাকে লেজ ধরে দেয়ালে আছড়ে মারলে অমানবিক বলা যায় না বড়জোর অপাশবিক বলা যেতে পারে। তবু সে আচরণ কোন পশু যদি পশুর উপর করে থাকে। আমার এহেন আত্মপক্ষ সমর্থনের যুক্তি তাদের রোষের স্রোতে খড়কুটোর মত ভেসে গেল।
মফিজ মুন্সি বিছানায় বসা মাত্র তার পশ্চাদ্দেশে মার্জারমলের তারল্য অনুভব করতে পেয়েছে। বিড়ালের অভিশাপে পরীক্ষা পাশ করা তো দূরের কথা আমার বিদ্যের নৌকো চরায় গিয়ে ঠেকবে এবিষয়ে সে নিশ্চিত। এ রকম পাশবিক নির্মমতার একুশটি উদাহরণ সে নিমেষে উপস্থাপন করল।
কিছুক্ষণ মার্জারবধ কাব্যের পক্ষে বিপক্ষে তুমুল আলোচনা সমালোচনার পর বিষয়টি এক সময় মিইয়ে গেল।আমিও মফিজ মুন্সির কথামত লাইফবয় সাবান দিয়ে গোসল সেরে এলাম।তবে তার ইচ্ছেমত তওবা পড়তে সম্মত হলাম না। সে পীড়াপীড়ি করায় বললাম, জীবনে হয়তো আরও অনেক বিড়ালবধ করব তাই এখনই তওবা পড়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আল্লাহ পাক আমাকে যে, কী অদ্ভুত ধাতুতে এমন নালয়েক বান্দাহ করে সৃষ্টি করছেন এই চিন্তাতেই তার মাথায় ঘাম ছুটতে লাগলো।
পরদিন শনিবার। সকালে ইংরেজি ফার্স্ট পেপার পরীক্ষা। খেতে বসেছি। ভাবলাম ডাল দিয়েই শুরু করি। বাটি থেকে ডাল ঢালতেই হাতে এসে পড়লো চিৎপটাং তেলাপোকার মৃতদেহ।রাতে ডালের পাতিলের ঢাকনা হয়তো ভাল করে দেয়া ছিল না।সেই ফাঁকে তেলাপোকা ডালসমুদ্রে সাঁতার কাটার ব্যর্থ চেষ্টা করে অক্কা পেয়েছে। বাবুর্চি মফিজ মুন্সি তার অসতর্কতা স্বীকার করতে মোটেই রাজি নয়। তার কথায় বিড়ালের অভিশাপে আমার রিজিকের পথ বন্ধ হওয়ার এটা প্রথম ধাপ।
আমি তড়িঘড়ি একটা ডিম ভেজে নাকেমুখে খেয়ে বের হবার উদ্যোগ করছি এমন সময় মফিজ মুন্সি বললো, ভাই, তুমি তো শুধু হ্যাগরামি করো কিচ্ছু মানো না। কথায় বলে ঠাকে ঠিকেই দুনিয়া। ডিম হলো কুসাইত্তে জিনিস। ওটা খেয়ে গেলে পরীক্ষা ভাল হয় না। তার উপর তোমার উপর বিড়ালের অভিশাপ।
যা হোক, এমনি নানা ঘটন অঘটন, দুর্ঘটন কুঘটনার মধ্যে দিয়ে পরীক্ষা শেষ হলো আমরাও বাড়ি ফিরে গিয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াতে লাগলাম।
তিনমাস পর পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। আমরা সাকুল্যে তেরোজন পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। তার মধ্যে সাতজন নকলের দায়ে বহিষ্কার হয়েছিল। চারজন সগৌরবে ফেল করেছিল।আমি আর আমার এক বন্ধু দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম।
মফিজ মুন্সির সাথে দেখা করে বললাম, ডিম পুষ্টিকর খাদ্য আর জনস্বার্থে বিড়ালবধ জাতীয় আশীর্বাদের কর্ম।
মুন্সি আমাকে শ্লেষভরে বললো, এই দিন দিন নয় আরও দিন আছে।
মুন্সির কল্পিত দিনের দেখা জীবনে কখনো পাই নি।
২০/১২/২০২৩
ময়মনসিংহ।