পাঠাগার আন্দোলনের অন্যতম যুগপুরুষ জয়নাল আবেদীনের সাক্ষাৎকারটি অর্ন্তজালের মাধ্যমে কবি অন্তর চন্দ্র নিয়েছেন ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪। জয়নাল আবেদীকে বিস্তারিত জানতে ঘুরে আসুন "জয়নাল আবেদীন: পাঠাগার আন্দোলনের অন্যতম যুগপুরুষ || অন্তর চন্দ্র "
অন্তর চন্দ্র: শুভ বিকেল। ভালো আছেন তো?
জয়নাল আবেদীন: শুভ বিকেল । জ্বি ভালো আছি।
অন্তর চন্দ্র: আমি আপনার ‘সাতভিটা গ্রন্থনীড়’ সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক।
জয়নাল আবেদীন: জ্বি বলুন, কি জানতে চান!
অন্তর চন্দ্র: আপনার বই পড়ার শুরুটা কখন?
জয়নাল আবেদীন: আমার বই পড়ার শুরুটা শখের বসে। আপনারা জানেন যে আমি জীবন জীবিকার তাগিদে দেশের বিভিন্ন জেলায় কাজ করতাম আমি সবচেয়ে বেশি কাজ করতাম ইটভাটায়। এই কাজটি চলতো মধ্য রাত থেকে দুপুর পর্যন্ত দুপুরের পর আমাদের লম্বা একটা সময় বেচে যেত। এই সময়টিতে আমার যারা সহকর্মী ছিল তারা বাজারে চা খাওয়া টিভি দেখা বিভিন্ন খোশগল্প করে কাটালেও আমি নিরুৎসাহিত ছিলাম এ ব্যাপারে। মানে বিকালের সময়টা কাটতো বেশ আনমনে।
একদিন বাজারে ঘুরতে গিয়ে ফুটপাতের দোকানে সস্তা কিছু বইয়ের দেখা পেলাম। এবং সেটি দিয়েই আমার পড়া শুরু। তারপর যেখানে বইয়ের দোকান দেখেছি বই সংগ্রহ করেছি নিজে পড়ার জন্য। টাকার কথা চিন্তা করে পুরাতন বই আমার সবচেয়ে বেশি কেনা হয়েছে।
অন্তর চন্দ্র: কেন বই পড়বেন? —এর পেছনে নিজস্ব কোন কারণ আছে কি?
জয়নাল আবেদীন: প্রথমে কিন্তু আমি বলেছি যে আমি শখের বসে বই পড়েছি। আমার মনে হয় আমরা যারা নবীন পাঠক তাদেরকে শখের বসেই বই পড়া শুরু করা দরকার।
রবীন্দ্রনাথ তার ‘সাহিত্যের পথে’ বইটিতে বলেছেন... “যা কিছু আনন্দ দেয় মন তাকেই সুন্দর বলে আর এই সুন্দরই হচ্ছে সাহিত্যের সামগ্রী।” তার মানে শখের বসে আমি সুন্দরকে খুঁজবো সুন্দরের সাথে থাকতে থাকতে সুন্দরের ছোঁয়া পেতে পেতে আমি সুন্দর হয়ে উঠবো।
আর নিজস্ব কারণ বলতে তেমন কিছু নাই আমার মনে হয় এক জীবনে অনেকগুলো সুন্দর জীবন-যাপনের উপায় হতে পারে বই পড়া। সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে ভালোবাসাবাসিতে গুরুত্ব বহন করে। রমাপদ চৌধুরীর খারিজ বইটির পেছনে লেখা আছে "সাহিত্যের সাথে জীবনের ভালোবাসাবাসির এক নিবিড় আলেখ্য। " সত্যি তাই।
অন্তর চন্দ্র: আপনাদের পাঠাগার কোথায় অবস্থিত? আমাদের সবার জন্য যদি আরেকবার বলতেন?
জয়নাল আবেদীন: কুড়িগ্রাম শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার এবং উলিপুর থেকে ১৬ কিলোমিটার। গ্রাম : সাতভিটা, ডাকঘর : হিঞ্জুলী, ইউনিয়ন :বুড়াবুড়ী, উপজেলা :উলিপুর, জেলা :কুড়িগ্রাম।
অন্তর চন্দ্র: আপনার পাঠাগার করার ভাবনা কোত্থেকে এলো?
জয়নাল আবেদীন: প্রথমে আমি কখনোই ভাবিনি যে পাঠাগার করবো। কেননা আমার বই পড়া শুরু হয়েছে সস্তা বই দিয়ে। তারপর যখন পড়লাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ কি দারুণ প্রেম অমিত-লাবণ্যর।
যখন শ্রীকান্ত পড়লাম কৈশোরের দূরন্তপনা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। আবার যখন সুনীলের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ পড়লাম তখন চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল প্যারিসের লুভর মিউজিয়াম। এই যে নানা দেশ ও জাতির বৈচিত্র্যময় জীবন সম্পর্কে জানা বিভিন্ন মনীষীদের জীবনী পাঠের মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করা এটি কেবল বইয়ের মাধ্যমে হতে পারে।
আর আমরা হলাম পাঠক বিমুখ জাতি। তাই পাঠাগার হলে, এই বইগুলো হয়তো খুব সহজে হাতের কাছেই পাবে। এতে করে যদি শিক্ষার্থীরা কেউ না কেউ বই নিয়ে পড়ে সামান্যতম উপকৃত হয়। এ চিন্তা থেকে পাঠাগার করা।
অন্তর চন্দ্র: আপনি তো নিজের পেটের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন তাহলে পাঠাগারের চাহিদা পূরণ করেন কিভাবে?
জয়নাল আবেদীন: আমি জানি এভাবে চলতে থাকলে কখনোই আমার অর্থাভাব দূর হবে না। তবুও মনকে শান্ত রাখি সন্তুষ্ট থাকার অভয় দেই। নিজের সামান্য অর্জিত বোধবুদ্ধি থেকে। পাঠাগার চালিয়ে যাওয়া এ বিষয়টি আসলে বলা যায় আমার সাথে মিশে গেছে।
অন্তর চন্দ্র: আপনার পাঠাগার সম্বন্ধে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কথাটা কি?
জয়নাল আবেদীন: যে স্বপ্ন নিয়ে চলছি একটি পাঠক সমাজ গড়তে আপাতত এটি জরুরি।
অন্তর চন্দ্র: প্রথম যখন পাঠাগার প্রতিষ্ঠা হয় ২০১১ সালের ১৫ নভেম্বর এবং তার চার বছর পর অর্থাৎ ২০১৪ সালে সংহত কারণে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আবারো ২০১৮ সালে পাঠাগারের কার্যক্রম পুনরায় চালু হয়। এর মাঝামাঝি ৫ বছর কি আপনার মাথায় পাঠাগারের চিন্তা আসেনি?
জয়নাল আবেদীন: এসেছে কিন্তু সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না।
১.নিজে বাড়ীতে থাকতে পারতাম না বলে পাঠাগার দেখা শোনার কাজ করার লোক ছিল না।
২. পাঠাগারের ঘর করার মত জায়গাও ছিল না আমার। তারপর চ্যালেঞ্জ গ্রহন করি জায়গা কিনে ঘর করবো। দীর্ঘ সময় ও রক্ত ঘামে ভেজানো টাকায় জায়গা ও ঘর হয়।
অন্তর চন্দ্র : এখন পর্যন্ত কতজন পাঠক প্রতিনিয়ত পাঠাগারে আসেন?
জয়নাল আবেদীন: আমাদের এখন পর্যন্ত নিয়মিত অনিয়মিত (যে একটি হলেও বই নিয়েছে) মিলে মোট পাঠক ৬০০+ প্রতিনিয়ত পাঠাগারে আসেন ১৮/২২ জন।
অন্তর চন্দ্র: এখন পর্যন্ত বই সংগ্রহের সংখ্যা কত?
জয়নাল আবেদীন: ৪১৭০ টি বই ইতিমধ্যে সংগ্রহ করেছি। আশাকরি, ভবিষ্যতে সংখ্যাটা আরও বাড়বে।
অন্তর চন্দ্র: আমরা জানি আপনি পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন এবং পাঠাগার আন্দোলনের জন্য ইতিমধ্যেই সারাদেশে আলোচিত হয়েছে তাতে করে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন কি?
জয়নাল আবেদীন: না, আসলে আমি নিজের সুযোগ-সুবিধার জন্য পাঠাগার করি নাই। আলোচিত হওয়াতে যে সুযোগ সুবিধা পেয়েছি তা হলো, —এ কাজের সমমনা অনেকগুলো মানুষ পেয়েছি যারা প্রতিমুহুর্তে আমাকে উৎসাহ উদ্দীপনা দেন।
অন্তর চন্দ্র: ভবিষ্যতে পাঠাগার নিয়ে আপনার ভাবনা কি?
জয়নাল আবেদীন: বইকে পাঠকের আরও কাছাকাছি নেওয়ার জন্য বর্তমান আমি একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভ্রাম্যমান হিসাবে প্রতি রবিবার দুপুর ০১টা থেকে ০২টা পর্যন্ত বই নিয়ে বসি। আমাদের ইউনিয়নে এরকম চারটি উচ্চ বিদ্যালয় আছে সেখানে বসা হয়। এবং আরো অনেক পরিকল্পনা আছে যা আস্তে আস্তে বাস্তবায়ন করবো।
অন্তর চন্দ্র: আপনাকে মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
জয়নাল আবেদীন: আপনাকেও ধন্যবাদ।