এইসব সংহিতা পুনর্বার খুলতে হয়েছে আমাদের। ব্রহ্মপুত্রের শরীরের ভেতর ঢুকে দুগ্ধস্নানে মত্ত হতে কে না চায়! সবাই চায়! মোহভঙ্গের, মড়ক থেকে উদ্ধারের; যাপিত জীবন ও মানুষের সুখানুভূতির প্রয়াস। প্রতিটি পৃষ্ঠা জুড়ে সংগ্রাম আর হাপিত্যেশ। আহা! ব্রহ্মপুত্র। আহা! চিলমারি। এইসব জীবনের আরতি শুধুই কি মোহভঙ্গের নাকি মানবিক মানুষ হওয়ার?
একটি দিনের সংহিতা খুলে এমন উল্লাসে থাকতে কাউকে দেখিনি! তবু রাতভর তোমার শরীর সকেটে নিয়তির নিশানা তাক হয়ে আছে— আবেগ, অনূভুতি ও প্রাচীন মানুষের কল্পিত উপমায়। হৃদযাত্রা, স্নানযাত্রা, ব্রহ্মপুত্র যাত্রা —এই কি অনাদিকালের রেখা ধরে আমাদের পদচারণা।
প্রশ্ন জাগে, কল্পিত প্রশ্ন, ব্রহ্মপুত্রের দেহ হতে নেমে আসা মোহের মাধুরী নিয়ে প্রশ্ন, কে এই ব্রহ্মপুত্র? পুরাণকার কি বলেন? কেন বলেন?
ব্রহ্মের পুত্র ব্রহ্মপুত্র। কেন তিনি ব্রহ্মপুত্র? তিনি অমোঘা গর্ভসম্ভুত শান্তনু মুনির পুত্র। ভগবান ব্রহ্মার অংশজাত। তিনি ‘ব্রহ্মকুণ্ড’ থেকে বের হয়ে ছড়িয়ে গেলেন দিগ্বিদিক। মানুষের জন্য, কল্যাণের জন্য এই ছুটে যাওয়া। কামরূপের অন্তর্গত অনেকগুলো তীর্থ আছে তার মধ্যে ব্রহ্মপুত্র অন্যতম প্রসিদ্ধ তীর্থ। পুরাণকার বলেন, শান্তনু মুনির স্ত্রী অমোঘা ব্রহ্মার শক্তি বলে ব্রহ্মপুত্রকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন এবং গর্ভ প্রসূত সন্তান (গর্ভে কোনো সন্তান ছিল না, সেটি কেবলমাত্র জল ছিল) কৈলাস পর্বতের এক কুণ্ডে রাখেন, যার নাম ‘ব্রহ্মকুণ্ড’ অথবা ‘লৌহিত্যাখ্য ব্রহ্মপুত্র।’
মাতৃহন্তারক পরশুরাম পাপ থেকে মুক্তির জন্য এবং ভগবান ব্রহ্মার আদেশে জীবেরমঙ্গল হেতু ব্রহ্মকুণ্ডকে জনসম্মুখে নিয়ে আসেন, তিনি পরশু অর্থাৎ কুঠার দিয়ে ব্রহ্মপুত্র খনন করে নারায়ণগঞ্জের নিকটে লাঙ্গলবন্দে পাপমুক্ত হন। বলা হয়ে থাকে, কুড়িগ্রামের চিলমারিতে ভগবান পরশুরাম ব্রহ্মপুত্র খননকালে ক্লান্ত হয়ে কিছুক্ষণ এখানটায় বসেছিলেন, তাই অনাদিকালের এই স্নানযাত্রা।
তাছাড়া অষ্টমী তিথিতে স্নানযাত্রায় পুণ্যফলের কথা শাস্ত্রকারেরা বলেন। এই দিন বসন্তকালীন দুর্গা অষ্টমীর শুভ মুহূর্ত। দুর্গাপূজা। অন্নপূর্ণা পূজা। অশোকাষ্টমী কিংবা বুধাষ্টমী। পুনর্ব্বসু নক্ষত্রযোগে। চৈতি শুক্লপক্ষে তর্পন ও স্নানে বাজপেয় যজ্ঞের ফল বা সকলতীর্থের ফল লাভ হয়। কালিকাপুরাণে ব্রহ্মপুত্রকে তীর্থেশ্বর বলা হয়েছে কারণ সকল তীর্থ স্পর্শ করে— ব্রহ্মপুত্র তার বহমান ধারা অব্যাহত রেখেছেন।
পুরাণকার বলেন.. .
“ভারতের তীর্থ যত সবে মিশাইল
পরে এই ব্রহ্মপুত্রে তীর্থেশ্বর কৈল।।’’....
“বিশেষতঃ ধর্ম্মশীল শুন সর্ব্বজন,
চৈত্রাষ্টমী শুক্লা তিথি অতি শুভক্ষণ।
সে ক্ষণেতে মহাকুণ্ডে যে করে মজ্জন,
মোক্ষপদ লভে সেই শাস্ত্রের লিখন।”
ব্রহ্মপুত্র মাহাত্ম্য শাস্ত্র বলে, “পৃথিবীর যাবতীয় তীর্থ চৈত্রশুক্লাষ্টমী তিথিতে ব্রহ্মপুত্রে আগমন করেন, সুতরাং উক্ত দিবসে ঐ তীর্থস্থানে করিলে সর্ব তীর্থস্থান জন্য ফল-সম-ফল হইয়া থাকে।”
চিলমারি অষ্টমীর কথা শোনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল, উত্তরের সবচেয়ে জনবহুল মেলা, প্রায় ১০ লক্ষ পুন্যার্থীর সমাগম, ঢোল, করতাল, জুরি, কাশি, শঙ্খধ্বনিতে মূখর দেবভূমিতে এইসব মানুষের কোলাহল। জনসমুদ্রের উত্তাল আয়োজন চিলমারিকে নবযৌবনা, রূপসী, ষোড়শী করে তোলে। বালিয়াড়ি চড়ে পড়ে থাকে মানুষের পায়ের চিহ্ন। ক্লান্তিরা হেঁটে হেঁটে স্বস্তি-কুড়ায়। পৃথিবী ডুব দিয়ে ওঠে ব্রহ্মপুত্রের রূপসী গতির ধারা লক্ষ্য রেখে। অমৃতস্নানে যেন সকল পাপ ধুয়ে যাবে, মানুষ জগবে ফের, মানবিক আয়োজনে।
ভারত থেকে মানুষ আসছে, নেপাল থেকে মানুষ আসছে, ভুটান থেকে মানুষ আসছে, মানুষ আসছে কাতারে কাতারে। গত রাত্রি যাপনের লঘিমা-দ্রাঘিমা অতিক্রম করে, মাটিতে মাথা ঠেকে, শিশু , বৃদ্ধ ও যুবকের দল শুয়ে আছে; পূর্বদিন হতে ক্লান্তির অবসরে, তবু ক্লান্তি নয়! জার্নি নয়! মানুষের মোহ; কাঠ-খড়ি দিয়ে পেটের হৃদ্যতা মেপে মেপে পুরোটা সময় পার করে দেন এইসব মোহমানবের দল। সারারাত আকাশে তারাদের ঝলকানি, চারদিকে কোলাহল মাঝখানে অপরূপ সৌন্দর্যে মোহিনী ব্রহ্মপুত্র। বারবার দেখে মনে হয়, কে যেন এঁকে দিয়েছে ভ্যান গগের ঈশ্বরীয় পোট্রেট।
ভোর রাত্রিতে কতবার যে পদযাত্রায় বের হয়েছি পায়ে পায়ে চলে গেছি চিলমারি হাজার বছরের কৌতুহল নিয়ে। অথচ কোন ক্লান্তিই যেন আমাকে শ্রান্তি দিতে পারেনি। রাতভর জলসার আয়োজন তাই নিয়ে মেতে থাকি সারাক্ষণ। একদিকে উত্তরের বৈঠকি পুরাতনী গানের ঝংকার অন্যদিকে কীর্তন, ভাওয়াইয়া, পাঁচালী গান, গুরু-শিষ্য তরজা ও রবিদাসী সম্প্রদায়ের ভিন্নভাষী গানও প্রাণের আর্তিকে বারবার ফিরিয়ে আনে হৃদয়ের কাছে, হৃদয় মেলে দেখা যায়, স্বচ্ছ পূর্ণিমার ছলে দাঁড়িয়ে আছে আমার মতই কয়েককোটি হৃদয়। যেসব হৃদয় অন্য হৃদয়কে আকুল করে, ব্যাকুল করে, অনূভুতির সারমর্ম বুঝায় সেইসব হৃদয়ের ভজনাও আমাদের করতে হয়। মেলায় আর যাই হোক না কেন, আমার সবচেয়ে ভালো লাগে হরিজন বা রবিদাসী সম্প্রদায়ের গাওয়া পদগুলো, যদিও সেগুলো হিন্দিভাষী গোত্রের কোনো একটি ভাষা হবে হয়তো তবুও তাঁদের ভাব-প্রয়াস বহুজনের মতো আমাকেও মুগ্ধ করে। ওদের নিজস্ব একটা ভাষা আছে, সে ভাষায় তারা গান করে রাত্রিযাপন করে। সে ভাষা বুঝতে আমি অক্ষম। আর অন্যদিকে এ অঞ্চলের প্রচলিত পুরাতনী গানের আসর বসে “দেহের আয়না খুলে দেখলাম হয়/মনের মানুষ কোথায় পাওয়া যায়” “হরি জনমে জনমে করি যেন তব গুণগান” “এপাড় থাকি না যায় দেখা ঐ পাড়ের কিনার” “গুরুর পদে প্রেম-ভক্তি হইলো না মন হবার কালে” “ও মোর প্রাণ সুয়া একদিন যাবু দেহার আন্দার করিয়া” ইত্যাদি গানের মধ্য দিয়ে নিজেকে ফিরে পাওয়া যায়। মস্তিষ্ক জুড়ে বসে থাকে ভালোবাসার আদিম দেবতা। ব্রহ্মপুত্রের নিবিড় কলরবে আমাদের পায়চারি একটি দিনের জন্য মানুষের সংহিতা খুলে।
চিলমারি অষ্টমী মেলাকে কেন্দ্র করে সারা মাস জুড়ে মানুষের মিলন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। চিলমারি উপজেলার প্রতিটি বাজারে একেকদিন মেলা বসে। পরদিন নবমীর সন্ধিক্ষণে সিঁন্দুরমতির মেলা। অষ্টমীর আটদিন পর বসে মাদাইখালের কালীর মেলা, বৈশাখ মাসজুড়ে (শনি-মঙ্গলবার) ধামশ্রেণী ঠাকুরবাড়িতে সিদ্ধেশ্বরীর মেলা, তাছাড়া চ্যাঙড়ার মেলা, বালাবাড়ী, রাণীগঞ্জ, ফকিরেহাট, রমনাবাজার, ব্যাপারীরহাট, নয়াবাজার ইত্যাদি জায়গায় চিলমারি অষ্টমী উপলক্ষে মেলা বসে। মেলা আমাদের উৎফুল্ল মনে সুকুমার চিন্তা জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। সংস্কৃতির বাহক, সুন্দরের পূজারী ও আনন্দ। মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় কারুশিল্পের সমহার, খই, বাতাসা, মুড়ি, মুড়কি আরো কতো কি! এ যেন মোহাবিষ্ট সংস্কৃতির ঈশ্বরীয় প্রতাপ। চোখ ধাঁধানো ভালোবাসা। এইসব ভালোবাসা আমাদের সংস্কৃতিমনা করে তোলে। নাড়ির স্পন্দন জাগায়, শুনতে পাই, আদিম দেবশিল্পের মোহ থেকে নেমে আসা মানুষের জয়ঢাক।
‘ওকি গাড়িয়াল ভাই হাকাও গাড়ি তুই চিলমারির বন্দরে...’ সভ্যতার প্রাচীর ডিঙিয়ে এইসব দিন আজও কতো আধুনিক, মায়াবী, মোহের মাধুরী, সুকুমার ঐশ্বর্য্য! একটা উৎসব একটা সংস্কৃতি বৃহৎ হৃদয়ের আয়োজন। সমস্ত অতীত এনে জড়ো করে নিজের বিরাট দেহ পুষ্ট করে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নতুন কিছু কথা বলতে ছোট ছোট জীবনের অভাবনীয় গাঁথাগুলো চোখের সকেটে রেখে যাওয়া আর ইতিহাসের মুখোমুখি দুরন্ত চিলমারির শুভেচ্ছা বার্তা মুঠোফোনে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বিশ্বের দরবারে। যাতে করে, সময়ের গোটা গোটা জুম উঠে আসে পৃথিবীর ছোট ঘরে।
_________________
অন্তর চন্দ্র
চিলমারী, কুড়িগ্রাম।