আলোকিত মানুষ জয়নাল আবেদীন কুড়িগ্রাম শহরে থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে উলিপুরের বুড়াবুড়ী ইউনিয়নের এক প্রত্যন্ত গ্রামের নামে গড়ে তুলেছেন ‘সাতভিটা গ্রন্থনীড়’ পাঠাগার। পেশায়, কৃষির সাথে যুক্ত। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা। গড়ে তুলেছেন চার হাজারেরও বেশি গ্রন্থের পাঠাগার।
শহর থেকে অনেক দূরে নদী সংলগ্ন এলাকায় এমন একটা জায়গায় জয়নালের পাঠাগার যেখানে যেতে হলে আপনাকে অনেকটা দুর্ভোগ পোহাতে হবে। কারণ ঐ জায়গাটার দেড় থেকে দুই কিলোমিটার এলাকায় গাড়ি চলাচল করার মতো যোগাযোগ ব্যবস্থা একদম নাই বললেই চলে। সেখানটায় বসে তাঁর যে উর্বর ভাবনা সেটা লক্ষ্যনীয়!
ইতিমধ্যে, সারা বাংলাদেশে সাড়া জাগানো পাঠাগার উদ্যোক্তা জয়নাল আবেদীন। পাঠাগার আন্দোলনের আলোচিত নাম জয়নাল আবেদীন। পত্রপত্রিকা কিংবা টেলিভিশনের মাধ্যমে নিশ্চয়ই আপনারা এই লোককে দেখেছেন। ২০২০ সালের দিকে উনার সাথে আমার পরিচয়। খুব সাদামাটা এবং শান্ত স্বভাবের। বইপ্রেমী হিসেবে আমাদের প্রেরণা দিচ্ছেন। পাশাপাশি এলাকায় থাকার কারণে উনার সাহচর্য পাচ্ছি। প্রথম যেদিন খবরের পাতায় জয়নাল আবেদিন নামটা দেখেছিলাম, অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। একজন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে তুলে আনলেন এক ঝাঁক পত্রিকা।
কৃষিকাজের রুজি দিয়ে একজন মানুষ একদম অখ্যাত এলাকায় পাঠাগার দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিন্তা করেন! যে রোজগারের টাকায় নিজের পেট বাঁচানো বড় দায় পড়ে যায়, সেই টাকায় একজন মানুষ কি করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে নিজেকে সংযত রাখেন আলোহীন জাতির উন্নতির জন্যে; এটা আমাদের জয়নাল আবেদীনের মত লোকদের থেকে শেখা উচিত। সমাজে উচ্চ আসনে বসে থেকে বড় হওয়া যায় না, বুদ্ধি এবং স্বশিক্ষার মাধ্যমে নিজেকে আলোকিত করে অভাব অনটনের মধ্যে থেকেও কিভাবে সারা বাংলাদেশের রোল মডেল হয়ে দাঁড়ানো যায় তার একমাত্র উদাহরণ জয়নাল আবেদীন। তিনি নিজেই আবুহেনা মুস্তফা সম্পাদিত ষান্মাসিক ‘ছোটনদী’ পত্রিকার সপ্তম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ২০২১—এ ‘আমার পাঠাগার আন্দোলন: গ্রাম থেকে শুরু’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন....
“....ছোট এই জীবনে মানুষ তো কতো কিছু নিয়ে স্বপ্ন দেখে! আমিও একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম —আমার এই স্বপ্ন দরিদ্র থেকে ধর্নাঢ্য হবার স্বপ্ন নয়, তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় নেতা হবার স্বপ্ন নয়, এই স্বপ্ন হলো গ্রামে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে আলোয় নিয়ে আসার স্বপ্ন, শিক্ষার্থীদের জানার পরিধিকে বৃদ্ধি করার স্বপ্ন, শিক্ষা থেকে দূরে সরে থাকা মানুষগুলোকে আবার টেনে আনার স্বপ্ন।” এই স্বপ্ন কোনো সাধারণ কেন্দ্রে সংহত হতে পারে না, তিনি সত্যিই একজন অসাধারণ বইপাগল মানুষ। যিনি সুন্দর পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে অন্ধকার দূর করার চিন্তা করেন।
‘আপনি তো নিজের পেটের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন তাহলে পাঠাগারের চাহিদা পূরণ করেন কিভাবে?’ —এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন... ‘আমি জানি এভাবে চলতে থাকলে কখনোই আমার অর্থাভাব দূর হবে না। তবুও মনকে শান্ত রাখি সন্তুষ্ট থাকার অভয় দেই। নিজের সামান্য অর্জিত বোধবুদ্ধি থেকে। পাঠাগার চালিয়ে যাওয়া এ বিষয়টি আসলে বলা যায় আমার সাথে মিশে গেছে।’
কর্মসূত্রে তিনি গাজীপুর ছাড়াও অন্যান্য জেলায় ইটভাটায় বেশ কয়েক বছর কাজ করেছেন। কিন্তু বইয়ের প্রতি টান তাকে রুদ্ধ করতে পারেনি। অবসর সময়ে চায়ের দোকানে চা-পান না খেয়ে, সেই সময়টা বই পড়ার কাজে লাগাতেন। ঠিক সেই সময়টায় বইয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়েন এবং পুরাতন লাইব্রেরি থেকে বই সংগ্রহ করে অবসর সময়ে পড়তেন। যে টাকা রোজগার হয় তাতে নতুন বই কিনে পড়ার মতো অবস্থা ছিল না, তাই পুরাতন বই দিয়ে বই পড়ার চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করেছেন। পরবর্তীতে নিজ গ্রাম সাতভিটায় ফিরে, বই পড়ায় মানুষকে উৎসাহিত করতে শুরু করলেন এবং শেষমেষ সফল হলেন। দৃঢ় চিন্তা এবং চেতনা জয়নাল আবেদিনকে নিয়ে গিয়েছিল উন্নতির শিখরে। শুধু নিজের জন্য নয়, পুরো একটা জাতির রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে জয়নাল আবেদীন। অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রার সুব্যবস্থা হিসেবে, ‘সাতভিটা গ্রন্থনীড়' প্রতিষ্ঠা হয়।
২০১১ সালের নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখ ‘সাতভিটা গণপাঠাগার’ নামে এর কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৪ সালে সংগত কারণে বন্ধ হয়ে যায় এবং মাঝামাঝি ৫টা বছর জয়নাল আবেদীনকে ক্রমে ক্রমে তাড়না করতে থাকে। বাড়ি বাড়ি পাঠকের কাছে বই পৌঁছে দিতেন। এভাবেই বইয়ের আদান-প্রদান ঘটতে থাকে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে ‘সাতভিটা গ্রন্থনীড়' পুনরায় নতুনত্বের দিশা খুঁজে পায়। ‘সাতভিটা গণপাঠাগার’ থেকে হয়ে ওঠে ‘সাতভিটা গ্রন্থনীড়।’ পাঠাগার উদ্যোক্তা জয়নাল আবেদীন তাঁর চিন্তা-চেতনায় একদল বইপ্রেমী মানুষ গড়তে পেরেছেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘একদল আমাকে উৎসাহ দেয়, সমর্থন জুগিয়ে বলে এসব কাজ করা দরকার আর একদল লোক আমাকে বলে ‘ছিটেরু’ বা প্রমিত বাংলায় পাগল।’’ এই বইপ্রেমী পাগল লোকটিই আজ আমাদের পথের দিশা খুঁজে দিয়েছেন।
তিনি ‘ছোটনদী’তে স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন... “মানুষের জীবন তো স্রোতের মতো, তার গতিপথ মাঝে মাঝে বদলায়। গাজীপুরের ইট ভাটার কষ্টকর দিনগুলো থেকে মুক্তি পেতে ভাবলাম নিজের গ্রামে গিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এই বোধ কাজ করার পর আমি মাঝে মাঝে গ্রামে আসা-যাওয়া করতে লাগলাম। পারিবারিক চাপও কিছুটা ছিলো, আমার মনেরও চাপ কিছুটা ছিল বিধায় ২০১৬ সালে আমার নিজ গ্রামে সাতভিটায় ফিরে আসি। স্থায়ীভাবে ফিরে আসার আগেই, আসা-যাওয়ার মাঝেই সাতভিটায় আমি বইপড়া আন্দোলন শুরু করেছিলাম।” বই পড়তে মানুষকে উৎসাহ এবং একত্রিত করা খুব জটিল ব্যাপার। মানুষ বই পড়তে চায় না। সারাক্ষণ বইয়ের নামে তালবাহানা দিয়ে পালিয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু জয়নাল আবেদীন সবাইকে একটি জায়গায় ধরে এনে উর্বর মস্তিষ্ক গড়ার সাধনায় ব্রতী হয়েছেন। তাঁর সাথে কথা বলে জানা যায়, এখন পর্যন্ত নিয়মিত অনিয়মিত মিলে মোট পাঠক ৬০০+ প্রতিনিয়ত পাঠাগারে আসেন ১৮/২২ জন। ভ্রাম্যমান হিসেবে নিজ ইউনিয়নের ৪টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্কুল চলাকালীন সময়ে বই নিয়ে বসেন। লোকে বলে, ইচ্ছে থাকলে সবই পারা যায়, তিনি পেরেছেন। যখন দেখি বিমানবন্দর থেকে শুরু করে ঢাকার বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সামনে বড় বড় ব্যানারে টাঙানো জয়নাল আবেদীনের ছবি তখন গর্ব করে বলতে হয়, আমরাও পারবো।
বর্তমান সময়ে পাঠাগার আন্দোলনের সাথে যারা জড়িত তাদের মধ্যে জয়নাল আবেদীন একদমই অন্যরকম। সাদামাটা মনের মানুষটিকে দেখে কখনই আপনার মনে হবে না যে তার ভিতরে জাগরণের এতটা উচ্ছাস। পোশাক দেখে বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল লোকটি আসলে অসম্ভব রকম জ্ঞানী। যেখানে কিছু কিছু মানুষ নিজের প্রয়োজনে পাঠাগারকে আলোকিত তকমা লাগিয়ে স্বার্থের পিছে পিছে ছুটছেন, সেখানে তিনি খেটে খাওয়া টাকা দিয়ে অন্যের প্রয়োজনে ব্যায় করছেন। এই পাঠাগার না করলেও জয়নাল আবেদীনের তেমন কোন ক্ষতি হতো না কিন্তু আমাদের মতো অর্বাচীন জাতি আলোর পথ থেকে বঞ্চিত হতো। আমরা পাঠক বিমুখ জাতি কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও প্রথাগত কারণে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছি। আমাদের বিশ্বাসে সত্যের সাথে সাথে বিশ্বাসের যে ভাইরাস উৎপন্ন হয় তা থেকে আমরা সহজে নিস্তার পাই না, এর জন্য বই একান্ত জরুরি একটা মাধ্যম যার মাধ্যমে সত্যের উপলব্ধি খানিকটা কার্যকর প্রাপ্ত হয়।