বাড়ির‌ বাইরে নারীর অবকাঠামোগত ভঙ্গুরতা ।। মোঃ ফজলুল হক

 


বাংলাদেশে নারীর অধিকার প্রশ্নে দুইটা সম্প্রদায় বর্তমান। একটার ভাস্য নারী তার অধিকার পায়নি, তাই পাওয়া উচিত মর্মে আন্দোলন করছে এবং অপর গ্রুপের কথা নারী অধিকার পেয়েছে বা পাচ্ছে।কিছুক্ষণের জন্য যদি ধরে নেই যে নারী তার অধিকার যথাযথভাবে পাচ্ছে। তাহলে সেই পরিস্থিতিতে একটা প্রশ্ন, নারীর ঘরের বাইরের পরিবেশ আসলে কতটা নারীর পক্ষে রয়েছে? নারীর প্রতি অনৈতিক আচরণের ঝুঁকির কথা যদি বাদও দেই, ধরে নেই নারী (ধর্ষণ ও ইভটিজিং সমস্যা থেকে) শতভাগই নিরাপদ, তবুও নারীর ক্ষেত্রে তার বাড়ির বাইরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা কতটা নিশ্চিত করা গেছে? ঝুঁকির সম্ভাবনা আপেক্ষিক, ওটা দ্বিতীয় তালিকায়, কিন্তু মৌলিক স্থাপনায় আমাদের অগ্রগতি কতদূর?

এই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বলতে যানবাহনে লম্বা ভ্রমণের সময় অত্যাবশ্যকীয় তিনটা প্রয়োজন যেমন নারীদের ব্যবহার উপযোগী ওয়াশরুম, ব্রেস্ট ফিডিং রুম, এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করার ও বিশ্রামের উপযোগী পরিবেশ। এই তিনটার শতভাগ নিশ্চিত করা ছাড়া একটা দেশের পরিবেশ নারীবান্ধব এটা বলার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। নারীর অফিসের কথা ধরা হয়নি, যেহেতু সেটা তার পরিচিত জায়গা। কিন্তু সেখানেও তার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।

ঈদের সময় স্বপরিবারে এক নারী নবজাতক বাচ্ছা নিয়ে ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ে যাচ্ছেন ট্রেনে করে। সিরাজগঞ্জ আসার পর তার বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর দরকার পড়ল। তিনটা স্টেশন পর্যন্ত উপায় না পেয়ে ঐ মহিলা ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনে খোঁজ করল ব্রেস্ট ফিডিং রুম আছে কী না। যদিও বা ছিল কিন্তু ততক্ষণে ট্রেন তার জন্য অপেক্ষায় থাকবে? এই অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন পূরণ করা ছাড়াই একটা দেশের গণপরিবহন নারীবান্ধব এটা বলার ফুসরত কোথায়?

বাংলাদেশের অর্ধেকেরও বেশি জনগোষ্ঠী নারী। সেই হিসেবে অফিস-আদালত, গণপরিবহন, বাজার-রাস্তাঘাট এবং শিক্ষাঙ্গনে নারী এবং পুরুষের সমান সংখ্যা বজায় ছিল বা আছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে পিছিয়ে থাকা সেক্টরগুলোতেও নারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে নারীর সমান সংখ্যা ইতিমধ্যেই নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু গণপরিবহনে এখনো কি অর্ধেক জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলো নিশ্চিত করা গেছে? ট্রেনের ভিতরে ব্রেস্ট ফিডিং এর ব্যবস্থা আছে কি? একটা মহিলা যখন বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দূর পথে ভ্রমণের জন্য রওনা দেবে তখন তার রাস্তার মাঝে প্রকৃতির প্রয়োজন বা যে কোন বিপদে বা দৈনন্দিন প্রয়োজনেও যে সকল ব্যবস্থা তার জন্য থাকা প্রয়োজন সেগুলো আছে কি? এগুলো ছাড়া একটা দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর অধিকার কিভাবে আদায় হচ্ছে বলতে পারেন?

খুব বেশী না, শুধু টয়লেট ব্যবহারের কথাটা ধরলেও আমরা কি এটা নিশ্চিত করতে পারব যে নারী দূরপাল্লার যাত্রায় তার প্রয়োজনীয় টয়লেট ব্যবস্থা পেয়েছে? রংপুর থেকে বের হয়ে একটা নারী যদি ঢাকায় যেতে চায় মাঝপথে অবশ্যই তাকে একবারের জন্য হলেও টয়লেট ব্যবহার করতে হবে। প্রতিদিন ভ্রমণ করা নারীর সংখ্যা বাংলাদেশের দৈনন্দিন গণপরিবহনের মোট যাত্রীদের প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি। খুব কম করে ধরেও এক তৃতীয়াংশ যাত্রী হবে। এই মানুষগুলির জন্য টয়লেট ব্যবস্থাটাই কতটা নিশ্চিত করা গেছে? পুরুষেরা তো সড়কের পাশে একটা বস্তা টাঙিয়ে রাখলেও প্রয়োজন পূরণ করতে পারেন, কিন্তু নারী? এছাড়াও রয়েছে ব্রেস্ট ফিডিং রুম, রয়েছে নারীদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় আশ্রয়‌। 

বাসে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন নিয়ে রীতিমতো দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। কথা হচ্ছে শুধুমাত্র বাসে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন নারীর অধিকারকে আসলে কতটা নিশ্চয়তা দেয়? এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনের নারী এবং পুরুষের সমান দায়িত্বভার থাকার পরেও শুধুমাত্র বাসের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত আসন আসলে কতটা ফলপ্রসূ? গাজিপুরের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে অধিকাংশ নারী। তাদেরকেও সারাদিন অফিস করতে হয়। তো সারাদিন অফিসের সমান সংখ্যক কাজ করে শুধু বাসে কয়টা সংরক্ষিত আসনকে অধিকার বলবেন?

নারী অফিস করার সময় কতটা ব্যক্তিগত প্রয়োজনের ব্যবস্থা পাচ্ছে? ডে কেয়ার আছে কিনা? সন্তানদের রেখে কাজ করার ব্যবস্থা আছে কিনা? এগুলোর খোঁজ কোই নেওয়া হয়? সমান অধিকার বলতে শুধু সমান সংখ্যাই নিশ্চিত করা নয়, বরং সেই সংখ্যক নারী সাচ্ছন্দে অফিস বা তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই হচ্ছে সমান অধিকার। এই ব্যবস্থার ভেতরেই তার সব ধরনের প্রয়োজনের পুর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে। একটা নারী ঘর থেকেই লাফ দিয়ে বাসের সংরক্ষিত আসনে বসে আবার সেখান থেকে নেমেই ঘরে ঢোকে না। এই ঘর থেকে বেরিয়ে আবার ঢোকা পর্যন্ত তাকে যা যা করতে হয়, তার জন্য যা যা দরকার সবকিছু পূরণ করার নাম সমান অধিকার। এগুলোর বাস্তবায়ন যদি না হয়, তাহলে বুঝতে হবে সমান সংখ্যা নিশ্চিত করার কথাটা মিথ্যা। কারণ শুধু সেতুতেই একটা যোগাযোগ স্থাপন হয় না, সংযোগ সড়ক লাগে। নারীর সমান অধিকার হচ্ছে সেতু, এবং এই প্রয়োজন নিশ্চিত করতে আর যা যা দরকার সেগুলো সংযোগ সড়কের ভূমিকা রাখবে। সংযোগ সড়ক নামক প্রয়োজন পূরণ না করার অর্থ সেতু তথা সমান সংখ্যা বাস্তবায়ন করাও অসম্ভব।

এতগুলো বিষয়ের বাইরে থেকেই একটা গ্রুপ নারীর অধিকার চেয়ে যাচ্ছে। হতে পারে নারীর অধিকার চাওয়াটাকে তারা ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে। যদি ধরেও নেই যে প্রকৃতই তারা নারীর অধিকার চাচ্ছে তাহলে তারা এই মৌলিক প্রয়োজনগুলোর কথা বলছে না কেনো? পাশাপাশি যেই সমাজ বলছে নারীর অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, তাদের ঘরের মেয়েরাও কি রাস্তাঘাটে চলার সময় এই প্রয়োজনগুলো বোধ করেনা? অথবা এই জিনিসের শূন্যতাগুলো তারা অনুভব করে না? তারা কি এটা বলতে চায় যে এই প্রয়োজনগুলো পূরণ করা ছাড়াই তাদের ঘরের মেয়েরা নারীর হিসেবে তার অধিকার যথাযথভাবে বুঝে পেয়েছে? যদি না পেয়ে থাকে তাহলে এগুলো পূরণ করা ছাড়া নারী অধিকার পাচ্ছে বলা যাবে না।

পরিশেষে, নারীর দীর্ঘ ভ্রমণের পরিবেশ নিশ্চিত না করার অর্থ তাকে এখনো বন্দি রাখার চেষ্টা করা হয়! ডে কেরার না দেওয়ার অর্থ অন্তত সন্তান রাখতে না পেরে তারা অফিস থেকে পিছিয়ে যাবে। সুতরাং শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর অফিসে সমান সংখ্যা দেওয়াই যথেষ্ট নয় বরং এই সমান সংখ্যা সুষ্ঠুভাবে চলার পরিবেশ নিশ্চিত করাও জরুরি। এগুলো আমাদের মৌলিক প্রয়োজন। এগুলো শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরের সংগ্রাম হবে আপেক্ষিক ঝুঁকি নিরোধের (ধর্ষণ, ইভটিজিং, অ্যাবইউজ ইত্যাদি)। আমরা এখনো মৌলিক অধিকার পাইনি সেখানে ঝুঁকি নিয়ে কী কথা বলব? অনতিবিলম্বে নারীর অবকাঠামোগত মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন করার‌ প্রয়োজনবোধ করছি। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভেবে দেখুক। 

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post