প্রেমের সারাংশ কি হতে পারে? ।। অন্তর চন্দ্র

 


প্রেম নিয়ে অদ্যাবধি মানুষের গবেষণার শেষ নেই। সঞ্জীব চট্টপাধ্যায় বলেন,

“প্রেম কি যাচিলে মেলে/আপনি উদয় হয়, শুভযোগ পেলে”

—কথাটা মন্দ নয়! তবে শুভ ও অশুভ যোগের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে, কতজন প্রেমহীন বিরহের পদ্য লিখেছেন, স্মৃতিপটে। 

এক হিন্দি কবি বলেন...  ‘আমি সারাজীবন মেয়েদের পিছু পিছু ঘুরলাম কিন্তু কোনো কাজ হলো না, কোথাও ভালোবাসা পেলাম না। ভালোবাসা খুঁজতে খুঁজতে আমি ক্লান্ত কিন্তু যখনই কোনো মেয়ে প্রণয়ের সুরে হেসে আমার সাথে কথা বলল, তখ‌নই যেন আমার হৃদয় তার হয়ে গেল। —এটাই হচ্ছে ভালোবাসা।’

“হাম নে সিনে সে লাগায়া দিল না আপনা বন সাকা

মুসকুরা কর তুম নে দেখা দিল তুমহারা হো গ্যায়া”

বুকে জড়িয়ে রাখলাম তবু হৃদয় আমার আপন হলো না

হেসে তাকালে একবার আর হৃদয় তোমার হয়ে গেলো 

—জিগার মোরাদাবাদি

—ছেলেরা ভালোবাসার কাঙাল। এতটুকু ভালোবাসা পেলে, সে বিশ্বজিৎ হতে পারে কিন্তু প্রিয়, বিচ্ছেদের করুণ পরিহাসের সম্মুখীন হতে হয় কতজনের। ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘চিত্রাঙ্গদা’ সিনেমার কোন এক জায়গায় বলেছেন... ‘কদর তো সবাই করে, ভালোবাসে ক’জন বল!...’ সত্যিই তো! ভালোবাসা কি নির্মম, রক্ত, মাংস, অস্তিত্বের পঁচা ভিতের মধ্যে বড় হতে থাকে; হিংস্রতায় ছিঁড়ে নেয় বুকের পাঁজর। যেন কমল তুলতে কাঁটার আঘাতের মতো বিঁধে যায়।‌ বিরহের ভাষায় তাঁর ভালোবাসার মুগ্ধতা।

কেউ কেউ বলেন...

‘তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে নয়! বরং যে তোমাকে ভালোবেসে তাকেই বুকে টেনে নিও! গভীর শান্তনায়!’

কিন্তু বাস্তবতা জীবনকে পরিহাসে রূপান্তর করে; তখন জীবন নিয়ে অস্বাভাবিক প্রশ্ন ওঠে! অথচ ভালোবাসাই জীবনের মূলমন্ত্র। অস্তিত্বের স্বরূপ সন্ধান। 


মেয়েদের রূপচর্চা আমার ভালো লাগে কিন্তু বাস্তবতাকে অস্বীকার করে নয়! এই রূপই প্রত্যেক পুরুষের আরাধ্য। চণ্ডীদাস বলেন...

‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে’

—সেই রূপ মোহের মাধুরী মিশিয়ে জীবনকে উদ্ভাসিত করে। রূপের কারণেই একটি মেয়ে কিংবা পুরুষ একে অপরের সঙ্গ পেতে চায়! কিশোরগঞ্জের বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী জয়ানন্দের প্রেমে পড়েছিলেন, ভালোবাসায় ব্যর্থ জয়ানন্দ চন্দ্রাবতী’র জন্য শান্ত জলে ডুবে মরেছিলেন, —সেই লাশ দেখে শোকার্ত চন্দ্রাবতী বলেছিল,

‘পুকুরে যেন আস্ত একটা চাঁদ ভেসে বেড়াচ্ছে’

হ্যাঁ! রূপ ও রূপবতী’র বৈচিত্র্য আছে বলেই প্রেম আসে, মানুষ কাঁদে, হাসে, অভিমান করে চলে যায়।

‘আত্মা তু রাধিকা’ রাধার জন্য কৃষ্ণ এতো বিখ্যাত। সে ঐশ্বরিক প্রেম। অথচ সেই প্রেমেও বাঁধল জটিলতা, যে রাধা কৃষ্ণের জন্য পাগলিনী সেজে বৃন্দাবনের গোধূলিতে কিংবা কদম্বের তলে আসেন, সেই প্রেমও বিচ্ছেদের রূপান্তর হলো, কৃষ্ণ চলে এলেন হস্তিনাপুর। অভাগিনী রাধা হলেন, এক অনন্ত বিচ্ছেদী ঐশ্বরিক প্রেমর উপাখ্যান। সীতা রামের জন্য বার বছর বনবাস কাটিয়েছেন অথচ সেই রামই একদিন সীতাকে অবিশ্বাসের অযুহাতে বনবাসে পাঠিয়ে দেন। —এজন্যই বলি, ভালোবাসা কত নির্মম! সত্য! ধ্বংসাত্মক!

‘গীতগোবিন্দম্’ কাব্যে জয়দেব যে ঐশ্বরিক প্রেমের উপাখ্যান তুলে আনেন, সে প্রেমে কামনা নেই, আছে ভক্তি, আছে শক্তি, মান, অভিমান প্রতুল। কিন্তু বিরহ বেদনা হয়ে উঠেছে মধুর! এই মধুক্ষরণই প্রেম।‌ 

রাজস্থানের মীরাবাঈ —এর একটি কথা মনে পড়ে,

‘‘হে রীঁ তো প্রেম দিবানী মেরা দরদ ন জানে কোঁয়’

অর্থাৎ আমি প্রেম দিতে চাইলাম কিন্তু কেউ প্রেমের মর্ম বুঝলো না। সত্যি তো! ক’জন বোঝে প্রেমের মর্ম! সে প্রেম আক্ষরিক অর্থেই হোক অথবা ঐশ্বরিক! অনন্তের জন্য কখনো প্রেম সত্য হতে পারে না, বিচ্ছেদই একমাত্র প্রাপ্তি! 

অবধি ভাষার কবি তুলসীদাস যে বলেন,

‘নারী চরিত্র অতিশয় দুরাশয়’

অর্থাৎ নারীর চরিত্র বোঝা সবার পক্ষে সম্ভব নয়! —এই একই কথা কি পুরুষের জন্য প্রযোজ্য নয়! নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সংস্কৃতি যখন থেকে শুরু হয়েছে তার আগেও কি প্রেমের এত দ্যেদুল্যমান আবহ ছিল না! আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে বৈচিত্র্য আছে বলেই, প্রেম আছে, নারী ও পুরুষের বাধ্য ও অবাধ্যতা আছে; যেমন— ঝড় এলে গ্রীষ্ম বুঝি, বৃষ্টি এলে বর্ষা, কুয়াশা পড়লে শীত আর পাতা ঝরলে বসন্ত; ঠিক তেমনই ভালোবাসা এলে এর বৈচিত্র্যময় রূপরাশিও চোখে পড়ে।

‘একজন প্রেমিকার খোঁজে আবুল হাসান/ কি নিঃসঙ্গ ব্যাথায় কাঁপে রাত্রে’

—সেই নিঃসঙ্গতার ভয়াবহ আগুন কি ছুঁয়ে যায়নি আমাদের বৃষ্টি কবলিত হৃৎপিণ্ডের রক্তনালী। ‘আমি সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হবো’ হ্যাঁ! এ কথাই বলেছিলেন, আবুল হাসান। কেন তিনি এ কথা বলেছেন, তার উত্তর কি আদৌ দিতে পেরেছি কেউ; পারিনি তো! তাই সে সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চায়। কখনো কখনো আমি অথবা তুমিও প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চাও!  অথচ প্রেমই একমাত্র সত্য!

হেলাল হাফিজের নিঃসঙ্গতা কি পরিচয় করিয়ে দেয় না, বিচ্ছেদী সাইরেনের! আমি তাকে বলি, অনুপম বিচ্ছেদী পঙ্ক্তির কারিগর, তিনি তো বলেন,

“এতদিন নারী ও রমনীহীন ছিলাম বলেই ছিলো/দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ।”

যে নারীর জন্য লোকটির এত তিতিক্ষা সেই নারী হেলেন ঘর বেঁধেছিলেন, পর পুরুষের সঙ্গে। কিন্তু তাতে কার কি আসে যায়?... বিচ্ছেদী প্রকরণের নিয়মতান্ত্রিক স্বার্থই তো একসময় জীবনের অংশ হয়ে যায়। আমাদের চাওয়া-পাওয়ার নির্ভেজাল সমষ্টির ভেতরেও যে একটি অসমাপ্ত কাহিনীর অবকাশ থাকে তা স্বীকার করি। 

ছেলেরা সারাজীবন মেয়েদের পিছু পিছু ঘুরে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাটিয়ে দিলেন। অথচ কোন মেয়ে হাত বাড়িয়ে প্রণয়ের অনুভূতি টুকুও প্রকাশ করেন না। চোখে চোখ রাখার সাহস ক’জনের আছে বল!... পুরুষ কিংবা নারীর ওমন রূপের ছটা ক’জনের সহ্য হয়। পুরুষ অপেক্ষা করতে জানে কিন্তু দু'জন যদি না হাত বাড়িয়ে দেয়, ভালোবাসার মতো যদি ভালোবাসতে না পারে, অন্ততঃ সেটা প্রেম হতে পারে না। —এজন্য ভালোবাসার জন্য দুজনে হাত বাড়িয়ে সামনে আসতে হয়। বিশেষ করে, নিজের জীবনসঙ্গী নির্বাচনে মেয়েদের প্রাধান্য দেওয়াই শ্রেয় হয়ে উঠেছে। পারিবারিক অবকাঠামোর কোলাহলে ঘরবদ্ধ হতে কেউই চায় না। অন্ততঃ তাকেই বেছে নিতে দাও শুদ্ধ জীবনের অনুসঙ্গ।

জয় গোস্বামী যে সাহসের রূপরেখা নিয়ে ‘স্নান’ কবিতায় প্রশ্ন তুলেছেন,

“সংকোচে জানাই আজ: একবার মুগ্ধ হতে চাই/তাকিয়েছি দূর থেকে/এতদিন প্রকাশ্যে বলিনি/এতদিন সাহস ছিল না কোনো ঝর্ণাজলে লুণ্ঠিত হবার—/ আজ দেখি অবগাহনের কাল পেরিয়ে চলেছি দিনে দিনে…”

—সেই সাহস ছিল না, বোধহয়! প্রত্যেক প্রেমহীন মানুষের দলে আমাকেও ঠাঁই নিতে হয়েছিল। নিরলস পৃথিবীর কিছু কিছু মানুষের যাপন গুরুত্ব পায় অপূর্ণ প্রেমের কাছেই, ওখানেই তার রসবোধ, নয়তো বৈষ্ণব পদাবলী এত ভাব-গাম্ভীর্যপূর্ণ হবে কেন? 

রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ কাব্যনাট্যে নন্দিনীর জন্য সবাই পাগল, অধ্যাপক, যক্ষরাজ, কিশোর, বিশু সবাই কিন্তু নন্দিনী রঞ্জনকে ভালোবাসেন, রঞ্জন রাজার মারের মুখ হতে রোজ ফুল এনে দেন, সে ভালোবাসা সূর্যের মতো পূর্ণ! খানিকটা পাগলামী কিন্তু এখানে রোমান্টিকতার সংজ্ঞা একরৈখিক নয়! বহুরূপী। বহুবিধ প্রেমের সারাংশ পাঠে বলা যায়, কোথাও কোথাও বিরহের ভাষা অনুচ্চারিত। কিন্তু তীব্র! বহুবিধ প্রেমের জটিল উপাখ্যানে।

শেষে আরেক হিন্দি কবির স্মরণাগত হলাম,  তিনি বলেন, এতদিন প্রেম প্রেম করে ঘুরলাম কিছুই হলো না কিন্তু আমি যেদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লাম, মৃত্যু আমাকে কঠিন করে তুললো, ঠিক সেদিন আমাকে আমার প্রেমিকা দেখতে এলো —এটাই আমার একমাত্র সৌভাগ্য! তিনি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, প্রভু এভাবেই যদি সে আমাকে দেখতে আসে তাহলে মৃত্যু বারবার আসুক! প্রেমিকা আমাকে অনুভব করুক! আলিঙ্গন করুন! 

“ও আয়ে হামারি লাশ পর দিওয়ানাওয়ার আয়ি 

ইসি কো মওত ক্যাহতে হ্যায় তো য়া রব বার বার আয়ে”

সে এসেছে মৃত আমাকে দেখতে আকুল হয়ে

একেই মৃত্যু বলে? খোদা, মৃত্যু তাহলে বারবার আসুক 

—উস্তাদ কমর জালালভি 

কিন্তু সবশেষে মার্তা রিবেবো গাররিদো’র কথাগুলোকেই প্রাধান্য দিতে হয়েছে বারংবার কারণ তিনি বলেন, ‘প্রেম তোমাকে কাঁদাবেই, সে যে করেই হোক! তাই প্রেম থেকে দূরে থাক! অনূভুব কর।’ 

প্রেম বিষয়ক সবচেয়ে সত্য কথাটি হচ্ছে, বিচ্ছেদ। উকিল মুন্সীর ‘আষাঢ় মাইসা ভাসা পানি’ কিংবা ‘শোয়া চাঁন পাখি’ বিচ্ছেদী উপকরণগুলো কোনো কোনোভাবে প্রেমের সারাংশকেই ব্যক্ত করেছেন। প্রেম বলতে যে নির্মম, রক্ত, ক্লেদ বুঝি তার সবটাই বিচ্ছেদী প্রকরণের নিয়মতান্ত্রিক স্বার্থ‌কে লক্ষ্য করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতএব, বিচ্ছেদের সুখ‌-দুঃখই প্রেম। 

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post