মনির হোসেন'র অসময়ের গল্প ।। বর্ণপ্রপাত


রাত ১২টা। নীরব নিঃস্তব্ধ ঢাকা শহর। যতদূর চোখ যায় মনে হয় জনমানবহীন ধূ-ধূ মরুভূমি। এইতো কিছুদিন আগেও এই শহর এরকম ছিলো না। তখন মনে হতো এই শহর জন্ম থেকেই নির্ঘুম। যানবাহনের হুইসেল শুনে শুনে কর্মক্লান্ত শহরবাসী ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমাতো। কী এক অসুখ এসে এই শহরটাকে উলটপালট করে দিয়েছে। নিদ্রাহীন শহরের চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছে। এখন সন্ধ্যা হলেই থেমে যায় শহরের যত কোলাহল। 

হিমাদ্রির কাছে শহরটাকে এখন নিস্তেজ মনে হয়। কোথাও কোন প্রাণ নেই। নিষ্প্রাণ শহরের বুকে হিমাদ্রির নিজেকে বড্ড নিষ্প্রাণ মনে হয়। কোথাও কোন প্রাণের ছোঁয়া নেই। সব যেনো থেমে গেছে। সব যেনো মরে গেছে। 

বেলকনিতে পায়চারি করছে হিমাদ্রি। পুরো শহর ঘুমিয়ে আছে। তার চোখে ঘুম নেই। আজ সারারাত জেগে থাকবে সে। শেষ কবে সারারাত জেগে ছিলো তা তার মনে নেই। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সে আজ মৃতপ্রায় এই শহরটাকে দেখবে। এ এক অন্য শহর।
এ এক অন্য জগৎ। এখানে আপন বলতে তার কেউ নেই। যারা ছিলো তারাও আপনজনদের সাথে ঈদ করতে গ্রামের পানে পাড়ি জমিয়েছে।

রাত পোহালেই ঈদ। পরিচিত সবাই গ্রামে চলে গেছে। হিমাদ্রি যায়নি। যায়নি বললে ভুল হবে। বলতে গেলে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। সারাদেশে লকডাউন চলছে। সারাদেশে আজ অদৃশ্য শত্রুর সাথে যুদ্ধ চলছে। নোভেল করোনা থেকে বাঁচতে আন্তঃজেলা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। যদিও জরুরি সেবা সমূহ এর আওতা মুক্ত। হিমাদ্রি তো আর এমন জরুরি কেউ নয় যে সে এসবের আওতা মুক্ত থাকবে!

যানবাহন না চলায় হিমাদ্রি বাড়ি যেতে পারেনি। তার বন্ধুদের কেউ মাইক্রোবাসে করে আবার কেউ ট্রাকে চেপে রাতের অন্ধকারে নাড়ীর টানে বাড়ির পানে ছুটেছে। যদিও হিমাদ্রিকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় সে যায়নি। এটাও সমাধান অযোগ্য সমস্যা ছিলো না। বন্ধুদের মধ্যে কেউকেউ টাকা ধার দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু সে নেয়নি। কারণ তার ধারণা সে যদি এভাবে বাড়ি যায় এবং কোন কারণে যদি কোন করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসে তবে তার জন্য পরিবারের অন্যরা বিপদে পড়বে। বাড়িতে অসুস্থ মা আছে। তার জন্য যদি মায়ের কিছু হয়ে যায়?

প্রথম যখন দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয় তার আগেই হিমাদ্রি বাড়ি চলে যেতে চেয়েছিলো। মার্চের ১৮ তারিখ। মাস শেষ না হওয়ায় টিউশনির বেতন হয়নি। অবশ্য সে দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে যে কয়দিন টিউশনি করেছিলো সে কয়দিনের বেতন চেয়েছিলো। কিন্তু তাকে জানিয়ে দেওয়া হলো মাস শেষ না হলে বেতন পাবেনা। এসব শুনে হিমাদ্রির মন একটুও খারাপ হয়নি। এসবে সে অভ্যস্ত। তা নাহলে ২১টি ভাইভা দিয়েও কেন সে চাকরি পাবেনা। শিক্ষা জীবন শেষ করার ৬ বছর পরেও কেন টিউশনি করে খেতে হবে?

হিমাদ্রির চাকরির বয়স শেষ হতে চলেছে। আসছে জানুয়ারিতে ৩০ বছরে পা দিবে সে। ভেবেছিলো এই বছরেই একটা চাকরি হয়ে যাবে। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে-বালি। এক অদৃশ্য জীবাণু সব কিছু থমকে দিয়েছে। জনশূন্য করে দিয়েছে এই জনবহুল শহর। সাথে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে তার স্বপ্ন। 

হিমাদ্রি সব বুঝে গেছে। নিয়তি তার পক্ষে নাই। কোনদিন ছিলোও না। মিছেমিছি তাসের ঘর বেঁধেছে সে। হিমাদ্রির বুঝে আসেনা কেন সবকিছুই তার বিপক্ষে থাকতে হবে? 
পছন্দের মিলিকেও সে বলতে পারেনি ভালোবাসার কথা। ভেবেছিলো চাকরিটা পেলেই মিলিকে সব বলে দেবে। কিন্তু সে সময় আর পায়নি। মিলি এখন অন্যের ঘরণী। সুখেই আছে। সবাই সুখে থাকে। সুখে নেই কেবল হিমাদ্রি।

ভোর ৪ টা। চারপাশের মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের সুমধুর কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে হিমাদ্রি। তার দু'চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। জীবনে এই প্রথম কোন ঈদে সে বাড়িতে নেই। অনাত্মীয় এই শহরের ইট-কংক্রিটের তৈরি বদ্ধ প্রকোষ্ঠের ভিতর একা সে ঈদ উৎযাপন করবে।

মাকে তার বড্ড মনে পড়ছে। ছোট ভাই আর ছোটবোনকে এবার আর নতুন জামা কিনে দেওয়া হয়নি। ফোন বিক্রির টাকাও শেষ হয়ে গেছে। কোন সুহৃদয়বান ব্যক্তি যদি খাবার দিয়ে যায় তবে পেটপুরে খাওয়া হবে, নচেৎ অনাহারেই উৎযাপিত হবে হিমাদ্রির ঈদ। এভাবেই কেটে যাচ্ছে অসময়।

অসময়গুলো হিমাদ্রির কাছে বড্ড দীর্ঘ মনে হয়।

আপনার লেখা ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস, সাহিত্যিকের জীবনী, সাক্ষাৎকার, সাহিত্যের খবর বর্ণপ্রপাতে প্রকাশ করতে চাইলে ইমেইল করুন ju94.bd@gmail.com।


Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।