রাউফুন বসুনিয়া: আমরা কি মনে রেখেছি তারে?

রাউফুন বসুনিয়া


জরীফ উদ্দীন

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ, সুকৌশলে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় বসেন জেনারেল এরশাদ। ক্ষমতার চাদরটা গায়ে জড়িয়ে জনগণকে শোনাতে লাগলেন মিথ্যে আশা, আর দেখাতে লাগলেন অসম্ভব সব স্বপ্ন। এর আড়ালে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে ব্যস্ত তিনি, গড়ে তুলতে লাগলেন শক্ত স্তম্ভ। এভাবেই কেটে যায় দিন। ত্রিশ লাখ বাঙালির রক্ত ও দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের দামে অর্জিত স্বাধীনতার অমীয় ফসল গণতন্ত্র হতে লাগল ভুলুণ্ঠিত। জেগে উঠা শুরু করল আলোর অভিযাত্রীরা।

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন প্রথম দানা বেঁধে উঠে। যা মধ্য ফেব্রুয়ারির আন্দোলন নামে পরিচিত। এই আন্দোলন থেকে শুরু হয় স্বৈরাচারবিরোধী এক রক্তঝরার ইতিহাস। ঐদিন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন কাষ্ণন, জাফর, জয়নাল, আইয়ুব, দিপালী ও ফারুক। ক্রমেই আন্দোলন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। লাশের সাড়িতে যোগ হয় আরো নতুন নতুন মুখ। 
১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। গাছে গাছে শোভা পাচ্ছিল বসন্তের ফুল। লাল কৃষ্ণচুড়া আবারও রক্ত পেল রাউফুন বসুনিয়ার। সেদিন চলছিল স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস পালনের প্রস্তুতি, রাত পোহালেই ………..।
কিন্তু সেই রাত আর পোহালো না রাউফুন বসুনিয়ার। ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্ররা মিছিল নিয়ে মহসিন হল পার হয়ে মূল রাস্তায় উঠতেই নতুন ছাত্র সমাজ গুলি করা শুরু করে। এতে মাঠিতে লুটিয়ে পরে জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র রাউফুন বসুনিয়া। রক্তে ভেসে যেতে লাগল কালো রাজপথ। রাউফুন বসুনিয়া হয়তো অনেকটা আত্ম অভিমানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামে তাঁদের পারিবারিক কবরস্থানে।

রাউফুন বসুনিয়া স্থানীয় পাঙ্গারাণী লক্ষ্মীপ্রিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, পরে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করে সেখানেই ভর্তি হন মাস্টার্সে। বাবা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নজরুল ইসলাম আর মা ফিরোজা বেগমের স্বপ্ন যখন সত্যি হতে চলছিল ঠিক তখনই সংগ্রামী তাজা প্রাণটিকে কেড়ে নিল এরশাদের ঘাতকের বুলেট। 
আমরা কি মনে রেখেছি তারে? খোঁজ কি নিয়েছে কেউ বসুনিয়ার পরিবারের। কিংবা গণতন্ত্রের হালবাহী দাবিকারক মাঝিরা কী দিয়েছেন তাঁর মূল্য? ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি আজও নীরবে চলে যায়। আজও প্রশ্ন থেকে যায় অমীমাংসিত!
শহীদ রাউফুন বসুনিয়ার আবক্ষ মূর্তি থাকে সারা বছর ধুলা বালিতে পরিপূর্ণ কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকার দখলে। অনেকেই সেই আবক্ষ মূর্তির সামনে থমকে দাঁড়ালেও জানে না এর সঠিক ইতিহাস। যে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য তাঁরা দিয়েছিল তাদের রক্ত সেই গণতন্ত্র ভোগ করছে সেদিনের দখলবাজরাই বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। শুধু ভালোবাসা নয় আসুন আমরা এই দিনটাকে পালন করি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে। প্রজন্মকে জানাই আমাদের গৌরবের ইতিহাস। যে গণতন্ত্র উদ্ধার করতে খালি হয়েছে অগণিত মায়ের বুক, সেই গণতন্ত্র আজও মুক্তি পায়নি। তবে কি গণতন্ত্র এভাবে রক্ত চায়? গণতন্ত্রের প্রশ্নে কোনো আপস নয়।

জরীফ উদ্দীন: সহ-সম্পাদক, উলিপুর ডট কম

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।