সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ ও শ্রেণী চেতনা ।। এস. এম. আব্রাহাম লিংকন

সৈয়দ শামসুল হক কবরে শায়িত কয়েক বছর। তিনি কবরবাসী হলেও স্বাধীনতা বিরোধীদের আক্রমণ থেকে এখনো মুক্তি পাননি। এর কারণ মূলত তাঁর মুক্তিযুদ্ধ ও শ্রেণীভিত্তিক সাহিত্য সংগ্রাম।

বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হকের অবদান ও নানামুখীন সৃজনশীল কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। অনেক রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় পুরস্কার তাঁর থলিতে উঠেছে। সেগুলোও তাঁর কর্মের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ছিল। প্রফেসর ইমেরিটাস সদ্যপ্রয়াত আনিসুজ্জামানসহ অনেকেই বলছেন, রবীন্দ্রনাথের পর তিনিই একমাত্র মহাপুরুষ, যিনি সফলভাবে সাহিত্যের সব শাখায় স্বীয় অবদানের কারণে প্রবলভাবে আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছেন।

সৈয়দ শামসুল হকের লেখায় মুক্তিযুদ্ধ প্রবলভাবে উঠে এলেও ইতিহাস, শোষণ-নির্যাতন, প্রেম-বিরহ সবই আছে তাঁর সাহিত্যে। তাঁর নাম শৈশব থেকে জানা থাকলেও আমি মূলত তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হই ১৯৮১ সালে তাঁর দুটো উপন্যাস পড়ার পর, যার একটি নিষিদ্ধ লোবান, অন্যটি নীলদংশন। উপন্যাস দুটো একই মোড়কে আবদ্ধ গ্রন্থে ছিল। উপন্যাস দুটি অসাধারণভাবে মুক্তিযুদ্ধকে এবং মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বর্বরতার নিপুণ উপস্থাপন ছিল, যা শুধু আমাকে নয়, আমাদের সময়ে সামরিক শাসনে পিষ্ট ছাত্র-যুবকদের নতজানু না হতে উজ্জীবিত করেছিল।

 

মুক্তিযুদ্ধের হারিয়ে যাওয়া চেতনা ও মূল্যবোধের সমালোচনায় প্রণীত উপন্যাস স্মৃতিমেধ তাঁর অনন্য সৃষ্টি। যেখানে একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী জিনাত মহল চরিত্রটি দিয়ে সৈয়দ শামসুল হক নোংরা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের সমালোচনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আপসকামিতার বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শহীদ অধ্যাপক কলিমুল্লাহর স্ত্রী জিনাত মহল যখন তার স্বামীর হত্যাকারী রাজাকার সবুরকে বিয়ে করার চিন্তা করছেন, তখন তার দেবর সেলিম ক্ষুব্ধ হয়ে যে প্রশ্ন করেছিলেন, তার উত্তরে জিনাত মহল বলেছিলেন, রাজাকারকে তোরা ক্ষমা করতে পারস, আমি পারি না? রাজাকারকে তোরা মন্ত্রী বানাতে পারিস, আমি স্বামী করতে পারি না? একাত্তরের দালালকে স্বাধীনতা পুরস্কার দিতে পারিস, একাত্তরের দালালদের গলায় আমি মালা দিতে পারি না? এসব কথার উত্তরে সেলিম যখন বলে, এ তুমি জেদ করছ, রাগ করে করছ, তুমি আত্মহত্যা করছ, কেন তুমি এটা করছ? উত্তরে অশ্রুসিক্ত জিনাত মহল বলেছিলেন, এই আমার যুদ্ধ, আমার ব্যক্তিগত যুদ্ধ, আমার একার যুদ্ধ, তোরা যে ভুলে গেছিস, তোদের আবার সব মনে করিয়ে দেবার যুদ্ধ, তোরা শিউরে উঠবি, তোরা চমকে উঠবি, অপমানে তোরা জ্বলে উঠবি, তাই আমার যুদ্ধ। আমি যে মেয়ে, আমি যে মায়ের জাত, মায়ের মুখে কালি না পড়লে ছেলে কেঁদে উঠবে কেন? জিনাত মহলের উচ্চারিত পঙিক্তগুলো বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রচণ্ড প্রতিবাদ ও তিরস্কার ছিল।

একদা আমরা যারা বেইলি রোডের ভাঙা নাট্যমঞ্চে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় দেখেছি, তারা প্রত্যেকেই বারবার শানিত হয়েছি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের সেরা নাটক।

এ নাটকটি বৈরী সময়ে শুধু মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করেনি; এ নাটকে রংপুর তথা উত্তরাঞ্চলের ভাষাকে ব্যবহারের মাধ্যমে একটি নতুন মাত্রা সংযোজন করা হয়েছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী নিষিদ্ধ সময়ে নগরবাসীর কাছে উপস্থাপিত নাটকটি মোটেই ভাষার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়নি, বরং আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার নাটকটিকে আরো গ্রহণীয় ও আকর্ষণীয় করেছিল। এছাড়া তাঁর অন্য আরেকটি নাটক যুদ্ধ এবং যুদ্ধ মূল্যমানে অসাধারণ।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সংবিধানের মৌল নীতিমালাই শুধু বিকৃতি করা হয়নি, সংবিধানে সাম্প্রদায়িকতার সন্নিবেশন ঘটানো হয়েছে। পরবর্তীতে যে পথে জেনারেল এরশাদ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের সব আইনি ভিত্তি রচনা করেন; যা আমরা হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট করেও আর অতিক্রম করতে পারছি না।

সামরিক বর্বরতার বিরুদ্ধে সূচনা পর্বে রাজনীতিকরা বেশ কোণঠাসা ছিলেন। মাঠ শূন্য, কারাগার বোঝাইএ রকম অন্ধকার অমানিশায় সাহসী সৃষ্টি ছিল পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় ও নূরলদীনের সারা জীবন। নূরলদিনের সারা জীবন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ঘটনাসংশ্লিষ্ট না হলেও অপশাসন, শোষণ ও বঞ্চনা থেকে সামগ্রিক মুক্তির কথা সেখানে প্রবলভাবে বারবার উচ্চারিত হয়েছে। সেখানে শোষণ প্রসঙ্গে সৈয়দ হক বলেছেন

কালা ধলায় এক জোটতে কবচ করে জান

এক জোটতে গোরাসাহেব হিন্দু মুসলমান।

তফাৎ করি না দেখিবেন উপর মধ্যে ভাই,

যে করিবে শোষণ হামাক শোষণকারী তাই।

যে মারছে জানে হামাক, জানের শত্রু তাই।

কালায় কালা, ধলায় ধলা, উপরতলায় এক

উপরতলায় এক যে জাতি খেয়াল করি দ্যাখ।

খেয়াল করি দ্যাখরে হামার,নেঙ্গুটিয়া ভাই,

আরেক জাতি হামরা হনু, গরীব বলিয়াই।

এখানে তিনি শ্রেণীগত অবস্থান নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। ঘূর্ণায়মান শোষণের বৃত্তকে তিনি জয়নুলের চিত্রকর্মের মতো ফুটিয়ে তুলেছেন

গলায় দিয়া রশি হামার হুকুম জারি করে

ধানের বলদ নগদ টাকায় খাজনা দেবার তরে।

বুদ্ধিটা কি ঠাহর করে দ্যাখেন তবে ভাই

ধান বেচিতে সেই মহাজন ছাড়া উপায় নাই।

ধান করিব পাট করিব রক্ত ঝরা ঘামে

ধান কিনিবে মহাজনে নিজের খুশি দামে

ধান বেচিয়া খাজনা দিলাম সন্তানে কি খায়?

ঋণ করিতে চাষী আবার সানকি ধরি যায়।

সৈয়দ শামসুল হক পঁচাত্তর-পরবর্তী অমানিশায় আমাদের সামনে আলোকবর্তিকা ছিলেন। তিনি সে সময়ের অপশাসনের বিরুদ্ধে শুধু লেখনীতে নয়, বরং অপশাসন ও অনাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামীদের সঙ্গে রৌদ্রতপ্ত রাজপথে তরুণ-যুবার মতন শামিল থেকেছেন। জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠন করে সারা দেশে কবিতা কর্মীদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সংগ্রামের মন্ত্রণা।

অপশাসনের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক সমাজের অবদান অনেক বড়। যখন রাজনীতি ও রাজনীতিকরা কোণঠাসা থাকেন, তখন বরাবরই শিল্পী, সাহিত্যিক সমাজ রাজনীতিকদের মাঠে নামার একটা পথ সৃজনে নিপুণ কারিগরের কাজ করেছেন। সৈয়দ হক সে নিপুণ কারিগরদেরও কারিগর ছিলেন।

আমাদের দেশে চলমান সময়ে দেখা যায় একজন রাজনৈতিক কর্মী তিনি সংস্কৃতিমনা নন, আবার একজন সংস্কৃতিকর্মী তিনি আবার রাজনীতির ঘোর বিরোধী। এ সংকট পাকিস্তান যুগেও আমাদের জীবনে ছিল না। একজন রাজনীতিক যেমন সংস্কৃতিবান, তেমনি একজন সংস্কৃতিজন রাজনীতিমনস্ক ছিলেন বলেই তাঁরা ভাষার সংগ্রাম, আইয়ুব ও ইয়াহিয়ার সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে তবলা-ডুগি ও তুলি-কলম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এমনকি একাত্তরে কেউ অস্ত্র, কেউ কেউ কণ্ঠ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। সৈয়দ শামসুল হক সেই সংস্কৃতি শূন্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।

আমরা তাঁর লেখায় একটা অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম দেখতে পাই। সেখানে যেমন শুভ-অশুভে লড়াই আছে, তেমনি শোষক-শোষিতের লড়াইও দেখতে পাই। লড়াইটা এলোমেলো নয়, বরং গোছানো এবং দর্শনভিত্তিক। লড়াইয়ের সময়কালকে তিনি ছোট্ট ভাবেননি। তিনি প্রয়োজনে সময় নিয়ে লড়াই করার কথাও বলেছেন। এ প্রসঙ্গে নূরলদীনের সারা জীবনের একটি শ্লোক স্মরণযোগ্য

ধৈর্য সবে, ধৈর্য ধরো, ধৈর্য করো আন্দোলন

লাগে না লাগুক বাহে এক-দুই-তিন কিংবা কয়েক জীবন।

নূরলদীনের সারা জীবন নাটকের এ উক্তি দ্রুত ক্ষমতায় যেতে নীতিভ্রষ্ট রাজনীতিকদের জন্য উপদেশও বটে।

সৈয়দ শামসুল হক রাজকবি ছিলেন না। রাষ্ট্রের বর্তমান কর্ণধারদের সঙ্গে তাঁর গভীর সখ্য ছিল। এটি দেখে যারা বিভ্রান্ত হন, তাদের অনুরোধ করব পঁচাত্তর-পরবর্তী রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের বিরুদ্ধে তাঁর নিরন্তর সংগ্রামকে বিবেচনায় নিতে। যাঁর পরিছন্ন অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, তিনি সংগত কারণেই মুক্তিযুদ্ধ ও তার চেতনার পক্ষের প্রতিনিধিত্বকারীদের প্রতি সহযোগী হবেন। এই সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্মের আদর্শের প্রতি। কোনো রাজন্যবর্গ হওয়ার জন্য ছিল না। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যারা, তাদের বিরুদ্ধে তিনি অনেকটা নির্মম ছিলেন। এ নির্মমতা শুধু লেখায় ছিল না, তিনি মাঠে-ময়দানে বক্তব্য দিয়েও তা তুলে ধরেছেন। এ কারণে মৌলবাদীরা তাঁর বিরুদ্ধে প্রচণ্ডভাবে নাখোশ ছিল। সে কারণে মৌলবাদীরা তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁকে ধর্মহীন মানুষ বলে প্রচারে ব্যস্ত। এটুকুই বলি, যিনি নিজে পিতা-মাতার কবর জিয়ারত করতেন, যিনি নিজেই ধর্মীয় বিধান মেনে কবরবাসী হয়েছেন, তিনি ধর্মহীন হবেন কেন? এসবই অপপ্রচার। মৃত্যুর পরেও মৌলবাদ তাঁর বিরুদ্ধে প্রবল, কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশে নিত্য লড়াইয়ে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদকেই আঘাত করেছেন। সে মৌলবাদ নিশ্চয়ই সৈয়দ শামসুল হককে নিষ্কৃতি দেবে না।

এস. এম. আব্রাহাম লিংকন: আইনজীবী, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক



Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।