কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি মুসলমানদের কলিজার টুকরা ।। বদরুল আরেফিন



কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যের জগৎ অনেকটা নক্ষত্রখচিত আকাশের মতো যার কিছুটা জানা হলেও অধিকটাই থেকে যায় অজানা। অতি নবীন পাঠক হিসেবে বহুধা প্রতিভার অধিকারী সাহিত্যিক নজরুল ইসলামকে নিয়ে কিছু লেখার মতো সাহসিকতা দেখানোর জন্য প্রথমেই মার্জনা কামনা করছি। অনেক দ্বিধা ও অন্তর্দ্বন্দকে নির্বাসিত করে যখন লেখাটি ছাপানোর জন্য মনস্থির করেছি ঠিক তখনও শিরোনাম ঠিক করতে পারিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ পড়ে প্রিয় মানুষ, কবি শামশাম তাজিলের একটি লেখায় সেখান থেকেই শিরোনামটি সংগ্রহ করেছি।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম বাঙালি মুসলিম সমাজে। সব মহৎ শিল্পী-সাহিত্যিকদের মতোই তিনিও স্ব-জাতি মুসলমানদের জন্য শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভেবেছেন। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে কবি 'কাব্যে আমপারার' আরজে লিখেছিলেন 'খাদেমুল ইসলাম -নজরুল ইসলাম'। ইসলামের বিশ্বপ্রেমিক মানবতাবাদী চিন্তাধারাকে তিনি বিশেষ শ্রদ্ধার সাথে দেখেছেন। তাই তার সৃষ্টির এক বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে ইসলাম ভিত্তিক লেখা। 
ইসলামী দর্শনের দৃষ্টিতে মানব জাতি এক আদমের সন্তান এবং সেজন্য এক পরিবার সদৃশ। মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্বের আসন ধূলিসাৎ করে এক স্রষ্টার প্রভুত্বের আওতায় বিশ্ব মানবের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক মুক্তি, সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, সম্প্রীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা ইসলামি সমাজ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। সেই সার্বজনীন আদর্শের বাণী যে কবি পেশ করেছেন তিনি সর্বমানুষের কবি। 
ফররুখ আহমদ, মাওলানা আকরাম খাঁ, আবুল মনসুর  আহমদ, গোলাম মোস্তফা ও কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলা সাহিত্যের মুসলিম পঞ্চরত্ন যারা মুসলিম জাতিসত্বার জাগরণকে নিয়ে ভেবেছেন, লিখেছেন সে জাতিসত্বার প্রাণস্পৃহাকে গতিময় করতে। রচনার সীমিত শিল্পগুণের জন্য হোক অথবা সামাজিক চেতনার সাথে বৃহত্তর সাযুজ্য নির্মাণের বিপুল ক্ষমতার অভাবের জন্য হোক, কবি নজরুলের মতো করে কেউ মুসলিম জনজীবনে জোয়ারধর্মী প্রাণশক্তি সৃষ্টিতে এতোটা সার্থক হননি। কবি নজরুল ইসলাম ইসলামি ভাবধারার অসংখ্য কবিতা, গান, হামদ-নাত, গজল লিখেছেন। তাঁর রচিত অমর গজল "ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ" যা না বাজালে বাঙালির ঈদ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। পবিত্র কোরআনের অংশবিশেষ কাব্যাকারে অনুবাদ করে লিখেছেন, "কাব্যে আমপারা"। রাসূল (সা:)-এর জীবনী অবলম্বনে লিখেতে শুরু করেছিলেন  "মরুভাষ্কর"। কবির রচিত উল্লেখযোগ্য কিছু নাত হলো  "ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ" "তোরা দেখে যা আমেনা মায়ের কোলে" "আমি যদি আরব হতাম" "তৌহিদেরই মুর্শিদ আমার"। 
মহানবী (সা:)-এর নব্যুয়াত প্রাপ্তির পর থেকে তারেকের স্পেন বিজয় পর্যন্ত মুসলমানরা বিশ্ব ইতিহাসে এক সোনালী সময়ের সূচনা করে। প্রকৃতপক্ষে শ্রেণিবৈষম্য বিলোপের ক্ষেত্রে, সাম্যের বাস্তবতা প্রতিষ্ঠায়, সুবিচারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনে, অনাচার-অত্যাচার উৎসাদনে, ধৈর্য-ত্যাগ-তিতিক্ষা-মানবিকতার প্রশিক্ষণে, শৌর্য-বীর্য প্রদর্শনে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য-দর্শন সৃষ্টি ও আধুনিকীকরণে তথা সামগ্রিকভাবে সভ্যতার অগ্রগতি ও প্রসারে মুসলমানরা যে শক্তি, জ্ঞান, বীরত্ব, মেধা, প্রেম ও মনীষার পরিচয় দিয়েছিলো, ইতিহাসে তার তুলনা নেই। সত্যিকার অর্থে তারা সভ্যতার এক বিস্ময়কর ইমারত নির্মাণ করেছিলো। এই গৌরবময় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার যে জাতি, মধ্যযুগে দেখা গেলো তারাই নিজেদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ভুলে গিয়ে  এক মুমূর্ষু জাতিতে পরিণত হয়েছে। একদিন যে আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপীয় শক্তির বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়ে রোমান-রাজকে পরাজিত করে, ক্রুসেডের যুদ্ধে ইউরোপীয় রাজশক্তিকে পর্যদুস্ত করে অন্যায়কারী ও অত্যাচারী শক্তির বিরুদ্ধে এক ভীতির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, তাকেই দেখা গেলো তারই সভ্যতা ও সংস্কৃতির অনুকারী ইউরোপের সম্রাজ্যবাদী শক্তির সামনে মাথা নত করে দাঁড়াতে। 
উপমহাদেশে মুসলমান তাদের রাজশক্তি হারালো। বাঙলার মুসলিম নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর ময়দানে ক্লাইভের হাতে বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে পরাজিত হলেন এবং বিশ্বের সকল মুসলিম রাজ্য শাসন ক্ষমতা হারিয়ে পদদলিত শক্তিতে পরিণত হলো। প্রতিকূল পরিবেশে আত্মবিস্মৃত মুসলমান ঐক্যের চেতনা হারালো, তাদের তাওহীদে বিশ্বাস হলো দোদুল্যমান, তারা হয়ে উঠলো স্বার্থপর, অনুকরণকারী, পরভৃত, পরমুখাপেক্ষী। 
মুসলমানদের পরাজয়ের মূলে ছিলো বিশ্বাসের শিথিলতা, ত্যাগের পরিবর্তে ভোগ, কৃচ্ছ্রতার পরিবর্তে বিলাসিতা, সাহসের পরিবর্তে ভীরুতা, সমষ্টিগত চিন্তার পরিবর্তে ব্যক্তি চিন্তা, জ্ঞান-বিজ্ঞান বিমুখতা -এক কথায় কোরআন ও সুন্নাহ, ইসলামি আদর্শ ও তাওহীদী চেতনা থেকে বিচ্যুতি ও পতন। 
আকাঙ্ক্ষিত শ্রেষ্ঠ পুরুষকে সব সময়ই দেখা যায় বিপন্ন জাতির সংকটকালে জন্মগ্রহণ করতে। বাঙালি তথা বিশ্ব মুসলিমের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিল্প জীবনের এমনই সংকটকালে ও উত্তরণ প্রেক্ষাপটে নজরুল জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে নিষ্পেষিত নজরুল বেদনার্ত দৃষ্টিতে এসবই দেখেছিলেন এবং আত্মবিস্মৃত ও ঐতিহ্য বিস্মৃত তন্দ্রালু জাতিকে জাগিয়ে তোলার জন্য অসিকে মসিতে পরিণত করেছিলেন। এই জাগিয়ে তোলার পথে তিনি সকল শোষক, সকল মুসলিম স্বার্থবিরুদ্ধবাদী, সকল কর্মবিমুখ, বিজ্ঞানবিমুখ শক্তির বিরুদ্ধে বজ্রের আওয়াজ সম্পৃক্ত শব্দ ও ভাষায় তীক্ষ্ণ আঘাত দিয়ে তওহীদী পৌরুষকে জাগাতে ও তাদের আত্মসচেতন করতে সোচ্চার ছিলেন। স্বার্থবাদী ও সম্রাজ্যবাদী রাজনীতির গেড়াকলে অবরুদ্ধ মুসলমানকে উত্তরণের পর্যায়ে টেনে নিতে জীবনপণ সাধনা করেছেন চিরবিদ্রোহের কবি। 
আত্মকলহে জর্জরিত এক  ঐতিহ্য-বিস্মৃত জাতিকে কবি সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ডাক দিয়ে বলেছিলেন,
"ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই
সুখ দুঃখ সম ভাগ ক'রে নেব সকলে ভাই।
প্রতিকূল পরিবেশে কয়েদ মুসলমানদের যখন তাওহীদে বিশ্বাস দোদুল্যমান তখন এক আল্লাহর পথে ডেকে কবি বলেন,
' উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ 
আমরা বলিব, " সাম্য, শান্তি, এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।"

'খেয়াপারের তরণী' 'কোরবানী' 'মোহররম' 'রণভেরী' 'আজাদ' 'জয় হোক! জয় হোক!' 'ডুবিবে না আশাতরী' 'কামাল পাশা' 'শাত-ইল-আরব' 'আনোয়ার' ইত্যাদি অসংখ্য কবিতার মাধ্যমে কবি আত্মবিস্মৃত মুসলিম জাতির চেতনায় বসন্তের হাওয়া সঞ্চার করে, তাদের ঊষর-ধূসর জীবনে ঘটাতে চেয়েছিলেন প্রাণপ্রবাহ।
গানে গানে কবি আকুতি করেছিলেন, "মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই।" কবির ইচ্ছানুসারেই তাকে সমাহিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে।

বদরুল আরেফিন 
প্রভাষক, লাউর ফতেহপুর ব্যারিস্টার জাকির আহাম্মদ কলেজ। 
নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।