ওয়াসীম আকরাম'র গল্প পোস্টকার্ড শেষ পর্ব ।। বর্ণপ্রপাত





চিঠি লিখে নিচে ডান কর্ণারে দু’টি কবুতর মুখোমুখি বলপয়েন্ট কলমের একটি চিত্র এঁকে দিলাম এবং নিচে লিখে দিলাম ‘বন্ধু!’ সাথে আমার স্বাক্ষর। লিখে খুব যত্ন করে রেখে দিলাম, কলেজে গেলে পোস্ট করবো, পরদিন যথারীতি কলেজে গেলাম এবং ক্লাসে যাবার পূর্বে ২টাকা মূল্যের ডাকটিকেট কিনে পোস্ট মাস্টার আঙ্কেলের কাছে দিয়ে আসলাম, ঠিকানা দেখে উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন 
-কে এটা? 
~আমি বললাম আঙ্কেল আমার বন্ধু। 
-ও আচ্ছা!
~আঙ্কেল আমি যাই তাহলে, ক্লাসে যেতে হবে
বেশ কিছুদিন গেলো দু’একদিন পোস্ট অফিসে গেলাম খোঁজ নিতে, পোস্ট মাস্টার আমার পরিচিত আঙ্কেল হয়, আমার বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার পোস্ট অফিস গাড়ির কোন রাস্তা নেই, হেঁটেই যেতে হয়। তবুও মনের জোরে দু’তিন সপ্তাহ পর্যন্ত সপ্তাহে এক বা দুই বার খবর নিলাম আমার কোন চিঠি এসেছে কিনা। মনে জোর বিশ্বাস ছিল নিশ্চই চিঠির জবাব পাবো কিন্তু যখনি পোস্ট অফিসে যাই আঙ্কেল বলে “না বাবা তোমার ত কোন চিঠি নাই” শেষে নিরাশ হয়ে ভেবে নিলাম চিঠির কোন উত্তর পাবো না। তবুও ঐ যে ঘুনে ধরা বিশ্বাস ভিতরে ভিতরে কুঁড়ে খাচ্ছিলো, পোস্ট অফিসের কাছেই এলাকার এক বড় ভাইয়ের কসমেটিকস এর দোকান। বেশ ভাল সম্পর্ক আমার সাথে বন্ধুর মতই। ত আমি আসার সময় উনাকে বললাম ভাই পোস্ট মাস্টার আঙ্কেল যদি আমার নামে কোন চিঠি দেয় আপনি একটু নিয়ে যাবেন, আমি আপনার বাড়ি থেকে নিয়ে আসবো।
উনি রাজি হলেন।
এরপর চলে গেল আরো পনের দিন, আমি প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন সন্ধার সামান্য আগে খবর পাঠিয়েছেন পাশের বাড়ির আরেক বন্ধুর কাছে, আমার একটি চিঠি আছে সেই দোকানদার ভাইয়ের কাছে। তার ছোট ভাইয়ের নাম এবং আমার নাম একই নাম সেই সুবাদে চিঠিটি এসেছিল কিছুদিন আগে নতুন একটি পোস্ট আফিল হয়েছে সেখানে এবং সেখান থেকে তার ছোট ভাইয়ের কাছে পাঠানো হয়েছিল সপ্তাহখানেক আগে। যা হোক অনেক ঘুরে ফিরে শেষ পর্যন্ত সেই রাতেই যেয়ে চিঠিটি সংগ্রহ করলাম।

চিঠিটি দেখে মনে হচ্ছিলো অনেক মানুষের নাড়াচাড়ায় খুব নড়বড়ে, একটু ময়লাযুক্ত। কারণ সেটা ছিলো একটি পোস্ট কার্ডের খোলা চিঠি। চিঠিটি হাতে নিয়ে যখন দেখলাম প্রাপকঃ আমার নামটি হার্ট বিটটা নিমিষেই সর্বোচ্চ বেগে বেড়ে গেল!
সামান্য প্রাপ্তির যে এত আনন্দ হতে পারে তা কখনো অনুভব করিনি এর আগে। অতটুকু দেখেই রেখে দিলাম তখন আর পড়লাম না, বুঝতে পারলাম পড়ে না আবার আনন্দে আত্মহারা হয়ে পরি, বুক পকেটে ভরে নিয়ে আসলাম বাড়িতে! পড়ার টেবিলে বই নিয়ে বসেই রইলাম কোন পড়া হলো না, শুধু সময়ের অপেক্ষা করছিলাম নিরিবিলি হলে বের করে পড়বো।

প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে চিঠিটি বের করে পড়লাম, কথাগুলো খুব সাজানো-গোছানো পরিপাটি ছিলো, আর হতের লেখা ছিলো খুবই সুন্দর হয়তো হাজারে একটি মিলে এমন লেখা, স্বচ্ছ লেখার মাঝে মাঝে -েকার -িকারগুলো একটু বড় করে টেনে টেনে লিখা ছিলো। চিঠিটা এমন ছিলো—


প্রিয় বন্ধু!

আমি ভাল আছি, আপনি কেমন আছেন? নিশ্চই ভালো।
আমি একদমই বিরক্ত হইনি আপনার লেখাতে বরং অবাক হয়েছি। আমাকে যে কেউ এত সুন্দর করে চিঠি লিখবে কখনো ভাবিনি।

আমি অষ্টম শ্রেনীতে এবার বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছি, আমার জন্য দোয়া করবেন! আজ আর নয়। নিচে আমার সম্পূর্ণ ঠিকানা লিখে দিয়েছি, আপনার প্রতিউত্তর আশা করছি।

ইতি
মৌসুমি ইসলাম মৌ


ঠিকানা
গ্রাম................(প্রাইভেসির জন্য খালি রাখলাম)
প্রজত্নেঃ তাইজুল ইসলাম 
পোস্টঃ লাহুড়িয়া 
থানাঃ লোহাগড়া
জেলাঃ নড়াইল


দু’তিনটে চিঠির আদান-প্রদান চললো, তারপর বেশ কয়েক মাস হয়ে গেলো আমি কয়েকটি চিঠি পোস্ট করে ফেললাম কোন উত্তর আসছে না, প্রায়ই পোস্ট অফিসে যাই কিন্তু আমার কোন চিঠি নেই। প্রতিবার যাই আর হতাশ হয়ে ফিরে আসি। পুরাতন পোস্ট অফিস নতুন পোস্ট অফিস দু’দিকেই খোঁজ নিতে থাকি কিন্তু আর চিঠি আসেনা। বেশ চিন্তায় পরে গেলাম কি কারন হতে পারে, কেনো এমন করছে? এটলিস্ট কি হয়েছে সেটা ত অন্তত বলতে পারে। আমি অনেক রিকোয়েস্ট করে লিখলাম তোমার চিঠি দিতে যদি কোন সমস্যা হয়, না দিও তবু বলো চুপ কি কারনে? আমার মনে নানান গল্প রচিত হতে থাকলো একবার ভাবি হয়তো আমার চিঠির কারনে ওর পারিবারিক সমস্যা হতে পারে সে কারনে হয়তো উত্তর দিতে পারছে না, আবার ভাবি হয়তো আমার চিঠিগুলো হয়তো ওর কাছে পৌছায়-ই না, আবার ভাবি হয়তো বিয়ে হয়ে গেছে, আরো নানান ভাবনা। তবু আমি একটার পর একটা চিঠি লিখেই যাচ্ছি, এক দেড় বছর হয়ে গেল এভাবেই। আমি এমনও লিখলাম যে যদি এই চিঠিটি মৌসুমী না পেয়ে অন্য কারো হাতে যায় অনুগ্রহ করে ওর হাতে দিন অথবা ওর কোন সমস্যা থাকলে আমাকে জানাবেন, চিঠিতে ও ওর চাচা হয় সম্পর্কে এমন একজনের নাম দিয়েছিল প্রজত্নে তার কাছেও লিখেছিলাম সেও কোন উত্তর আসেনি! 

ঢাকা থেকে নড়াইলের দূরত্ব ২১৫ কিলোমিটার আমার বাড়ি থেকে ওর বাড়ি হবে বড়জোর ২৫০ কিলোমিটার মাঝে মাঝে চিন্তা করি যদি নড়াইল চলে যাই কেমন হয়! রাত জেগে চিন্তা করি কবিতা-টবিতা লিখি। মনেতে একটা খুবই অসস্থি কাজ করে দু’বছর হয়ে গেল আর কোন চিঠি পাইনি। স্টুডেন্ট মানুষ হাতে টাকা পয়সাও তেমন থাকে না। এতদূরের রাস্তা যেতে যেমন টাকার প্রয়োজন তেমনি সময়ের প্রয়োজন। এ বয়সের একটাই দোষ সাধ্যের চেয়ে আত্মবিশ্বাস বেশি প্রগাঢ়। যেই চিন্তা সেই কাজ। বন্ধুদের থেকে কিছু টাকা পয়সা জোগাড় করে, ঢাকা বন্ধুর বাসায় বেড়ানোর নাম করে বেড়িয়ে পরা আর কি! নাবাবগঞ্জ থেকে ঢাকা গুলিস্থান বাস, গুলিস্থান-সাইয়েদাবাদ হেঁটে, সাইয়েদাবাদ বাস থেকে মাওয়া হয়ে ভাটিয়া পাড়া হয়ে ডাইরেক্ট নড়াইল, যেতে যেতে প্রায় চারটে বাজে, নড়াইল হতে লোহাগড়া প্রায় ২০ কিলোমিটার, এখানে একটি হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার ছুটলাম মনের ভেতর ত ভয়, সংকোচ সব দুরু দুরু করছে কি জানি কি হয়, পাই না পাই খোঁজে! বাসে লোহাগড়া গেলাম লোহাগড়া থেকে গ্রামের পথে, মেঠো পথে মানুষ চালিত ভ্যানে উঠলাম, চারিদিক মনোরম দৃশ্য সবুজ আর সবুজ রাস্তার পাশে সারি সারি তালের গাছ, মাঝে মাঝে শস্য ক্ষেতের আলে তিনটে, চারটে করে তালের গাছ প্রকৃতির প্রেমে পরে গেলাম, দেখতে দেখতে চলে এলাম মৌসুমীর গ্রামে, গ্রামে এসে ত পরলাম বিপাকে আমি ত আর বাড়ি চিনি না, এতবড় গ্রাম কোথায় খোঁজ করবো, গ্রামের যাকেই মৌসুমী নামের কথা জিজ্ঞেস করি কেউ চিনতে পারে না। গ্রামের একটা সরু পথ বেয়ে সামনে এগুতে লাগলাম। ভাগ্যিস ওর চাচার নামটা মনে ছিলো একটু এগিয়ে একটি ছোট্ট মোদির দোকান, দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম এই গ্রামে তাইজুল ইসলাম সাহেবের বাড়ি কোনটা বলতে পারেন? তিনি চিনতে পারলেন আর আমাকে বললেন আপনাকে আরো ১০মিনিট সামনে হাঁটতে হবে, তারপর এই রাস্তা শেষ ওখান থেকে দু’টি রাস্তা দু’দিকে গেছে, আপনি ডান দিকের রাস্তায় হেটে পাঁচ মিনিট যাবেন ডান পাশে দেখবেন একতলা একটি বিল্ডিং চারিদিকে বাউন্ডি করা ঐ বাড়িটি ওনাদের।

এদিকে সন্ধা ঘনিয়ে আসছে, আর যতই সামনে এগুচ্ছি ততই হৃদপিন্ডের কম্পন বেড়ে চলছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো দেখা হবে বন্ধুর সাথে, নাকি অপমানিত হতে হবে তার পরিবারের লোকের হাতে, নানান চিন্তায় বাহিরের সন্ধার চেয়ে মনে সন্ধাই নেমে আসছে আগে, আরো চিন্তা আছে যে করেই হোক রাতের মধ্যেই ঢাকায় ফিরতে হবে। সব চিন্তার ভীর ঠেলে তিন রাস্তার মোড়ে আর মাত্র পাঁচ মিনিট, এক কদম দু’কদম ইতস্থত এগুচ্ছি যেতে যেতে একদম বাড়ীর গেটের সামনে, উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখছিলাম বাড়ির ভিতর কাউকে দেখা যায় কিনা, যা লক্ষ করলাম ঘরের সব জানালা দরজা বন্ধ! সন্ধে হয়ে আসছে কোন বাতি-টাতি জ্বলছে না, দেখে মনে হচ্ছে এখানে বহুকাল ধরে মানুষের বসবাস নাই। সব উল্লাস, আত্মবিশ্বাস মুখ থুবড়ে পরলো নিমিষেই, কষ্টে বুক ছিড়ে আসতে লাগলো হৃদপিন্ডে রক্ত প্রবাহ যেন থেমে গেল, শরীর শীতল হয়ে গেল। এতক্ষণ যত উঁকি ঝুঁকি মেরেছি গেটের দিকে একবারও লক্ষ করিনি যে বিশাল আকারের এক তালা ঝুলাছে। এখন আমার কাছে মোবাইল আছে, পকেটে কলম ছিলো কাগজ নেই, আশে পাশে তাকিয়ে রাস্তায় পরে থাকা একটি কাগজ কুড়িয়ে নিলাম। মোবাইল নাম্বারটা লিখে নাম লিখে চিরকুটটি তালার মাঝে গুঁজে রেখে দিলাম। বেশ কিছু দূরে একটি বাড়ি দেখা যাচ্ছিলো ঐ বাড়িতে যেয়ে কিছু ইনফরমেশন জানার চেষ্টা করলাম তারা তেমন কিছুই বলতে পারলো না, শুধু বললো ওরা এই বাড়িতেই থাকে সপ্তাহখানেক ধরে দেখছিনা, হয়তো কোথাও বেড়াতে যেতে পারে।

আর কিছুই করার রইলো না, সারা দিনের ক্লান্তি দ্বিগুন করে ফিরে এলাম ঢাকাতে সেই রাতে....!

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।