ধারাবাহিক উপন্যাস: দিদার চৌধুরী'র "হৃদয়ের কান্না" -৯।। বর্ণপ্রপাত


কাশি বাড়ির পথের ধারে বিরাট একটি বিটপী বৃক্ষ, কত কালের তা অনুমান করা হলে ভুল হবে হয়ত। সারি সারি শাল বিথীকার মাঝে -একটি বিটপী বৃক্ষ নিজেকে সগৌরবে রাজ বৃক্ষপতি ঘোষণা করে দাঁড়িয়ে আছে। নিস্তব্ধ নির্জনে বৃক্ষপতির পদতলে বসে অধির আগ্রহে অপেক্ষমান; ইন্ধন প্রিয়তমার আগমনের প্রহর গুনছে। এই বুঝি এলো শিউলী?
শীতের আগমনে শাল পত্রশূন্য হতে লাগল। বাগানের নিস্তব্ধতাকে শালপাতা পতনের শব্দে মুখরিত করে তুলল। ঝরা শালপাতার গায়ে পায়ের আঘাতে ঝনঝন শব্দের আওয়াজে, সেদিকে ইন্ধন ফিরে তাকালো। দেখল, শিউলী আসছে মৃদু পায়ে, হাতে একটি হাতব্যাগ, পরনে একটি নীল শাড়ি। পাতা ঝরা শালবীথিকার মাঝে ফুটে উঠেছে, সুন্দরের অপ্রকাশিত ভাষার অন্তরা। অপরাধীর সুরে এক ঝলক হাসির রেশ ঠোঁটে ফুটে উঠল। তারপর মিটমিট করে চেয়ে বলল,
: দেরি হয়ে গেল বলে রাগ করনি তো?
ইন্ধন তার কথার জবাব না দিয়ে, নিচের দিকে চেয়ে অভিমানী হয়ে বসে থাকল। হাতে একটি শুকনো পাতা। হাতের দশ আঙ্গুলে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করছে পাতাটিকে। মাথা তুলে ইন্ধন তাকিয়ে বলল,
: এই বুঝি তোমার আসার সময় হলো?
: শিউলি এতেই বুঝতে পারল, সে একটি বড় ধরনের অপরাধ করে ফেলেছে। দেরিতে আসার অপরাধ সে কি, একমাত্র অপেক্ষামান ব্যক্তিরাই জানেন। শিউলী কি কথা দিয়ে কথা শুরু করবে, তা তার মাথায় আসলো না।ইন্ধন‌ও‌ চুপ করে রইল।
শিউলী নানা ধরনের কথা বলে ইন্ধনে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করল। কিন্তু কোন প্রকার চেষ্টায়ও ইন্ধনের রাগ ভাঙানোর গেল না। অবশেষে শিউলী নিজেই কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে চলে যাওয়ার উপক্রম করল। এতেও কাজ হলনা, শিউলী একটু গিয়ে পুনরায় ফিরে আসল।অবাঞ্চিত অভিমান ভঙ্গ করে ইন্ধন বলল,
: যেতে চেয়েছ , তা যাওনি কেন?
: চলে গেলে কি তুমি খুশি হতে?
: কারো অবহেলা থেকে নিজেকে রক্ষা করা কি উচিত নয়? শিউলী ভ্রু কুঁচকে বলল,
: ও আজকাল কোনটি ভালো কোনটি খারাপ তা বেশ ভাবছো দেখি? তা বলি আজকাল এত ভাবনা আসছে কোথা থেকে? ইন্ধন চুপ করে রইল।
এক পড়ন্ত বিকেলে নিস্তব্ধতায় সারি সারি অচেনা বৃক্ষের বাগানে, অভিমানি দুজনে দুজনার কাছাকাছি আসা। ভালোলাগা ভালোবাসা সব কিছুই মিলে এক রোমাঞ্চ অনুভূতি। অতঃপর ক্ষণিকের অভিমানের দীর্ঘ ভালোবাসার রোমান্সের সংলাপ।
এটি এই এক জীবনে বড় পাওয়া। একে তুচ্ছ করার ক্ষমতা কারোরই নেই। ভালোবাসা ভালোলাগা এই অধ্যায়টি জীবনের কাছে খুব একটা রহস্যময় ভাব। তা বলার অবকাশ রাখে না। ভালোবাসার খুব ঘোরলাগার কারণে সবকিছুই ভালো লাগে।
সবুজের প্রকৃতি, খোলা আকাশ, ফুলের গন্ধ, নদী সবকিছুই ভালো লাগে। ভালো লাগে নিস্তব্ধতা ভালো লাগে যুগলের হাত ধরাধরি করে পথচলা। বেড়ে যায় হৃদয়ের ব্যাকুলতা। কারণে অকারণে প্রিয়জনের মুখ খানি একটু দেখার বাহানা। ভালোবাসার রঙে ভরে উঠে সবকিছু। শিউলীর হাতের উপর ইন্ধনের হাত রেখে কাছে বসে , ইন্ধন বলল, 
: কেন আসতে বললে, তা তো বলছো না।
: একটি জরুরী কথা বলার ছিল।
ইন্ধন আনমনা হয়ে জিজ্ঞেস করল,
: কি কথা?
: বাবা আমার বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজছেন ।মনে হয় বাবার শীঘ্রই আমার বিয়ে দিতে চান। 
ইন্ধন হেসেই বললো,
: তাহলে তো খুশির কথা ,তোমার বিয়ে হতে যাচ্ছে।
শিউলী ইন্ধনের কথায় বিরক্ত হয়ে বলল,
: এখন ঠাট্টা করার সময় নয়।
: অবশ্যই যদি তোমার বাবার নিকট আমি যোগ্য বলে বিবেচিত হ‌ই।তা হলে তোমার জন্য আমি প্রার্থী হতে পারি।
শিউলী খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,
: তুমি যাবে আমার বাবার কাছে ? অবশ্যই তুমি বিবেচিত হবেই।
: আমি জানিনা আমার যোগ্যতা কতটুকু? তবে আমি যাব‌ই। ইন্ধন‌ আজ সব কথার মাঝে কিসের যেন গন্ধ পাচ্ছে। সবকিছুই আজ ভাবিয়ে তুলছে তাকে। জীবনের সব রহস্যকে পাশ কাটিয়ে অগ্রে গমনের প্রচেষ্টা ছিল, সকল সময়ের এক প্রাণান্তর প্রচেষ্টা। যা প্রত্যেকটি ঘটনা, চাওয়া পাওয়ার মাঝে নতুন কঠিন প্রাচীরের অবস্থান। বহিঃজগতের সাথে অন্তঃজগতের মিল না থাকলে, বহিঃপ্রকাশ হয় না। বরং তাতে দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যা দেখেছি অনেক ভদ্র সমাজে, সময়ের পরিক্রমায় ।
দিনে দিনে শিউলী আর ইন্ধনের মধ্যকার দূরত্ব বহুদূর থেকে একটু তে এসে পৌঁছল। ভালোবাসা ভালোলাগা আসা-যাওয়ার মধ্যে সীমিত নয়। মায়া, মমতা প্রেম ভালোবাসা, জীবনের মননশীলতার বিনিময় সবকিছুর মিলন ঘটল বহুপদে। বহুমুখী প্রতিভা আর বহুল বিত্তধারী যখন মিলনের জন্য কাতর , সেখানে ধর্মনীতি আর বংশ নীতি তোয়াক্কা করে কয়জনে?
যে বাইবেল ছেড়ে গীতাকে গ্রহণ করল, আবার সে গীতাকে ছেড়ে কুরআন গ্রহণ করবেনা এর বিশ্বাস কোথায়? তবে এর ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। চাকরি পাওয়ার পর থেকে শিউলী আর ইন্ধনকে এত ঘনঘন যুগল বন্দী অবস্থায় দেখা যায় যে, সে কারণে জমিদারি এলাকায় একটি হালকা গুঞ্জন‌ও ‌ উঠে গেল। কর্মচারীর আর মালিকের অযৌক্তিক সম্পর্ক, সে সম্পর্ক মেনে নেওয়া যায়? সেই সম্পর্ক এই সমাজের কাছে যৌক্তিকতা কোথায়? তবুও সৃষ্টি যখন হয়েছে এর শেষ অবধি অপেক্ষা করা যুক্তিসংগত।
কিন্তু উপকারীর উপকার স্বীকার করায়, যে শিউলীর বাবা ইন্ধন নামের পাড়াগাঁয়ের এক বেকার যুবককে বেঁচে থাকার জন্য একটি চাকরি সংস্থান করে দিল। আজ সেই ইন্ধন‌ই কিনা ঐ উপকারীর মান সন্মানকে ধূলায় লুটিয়ে দিবে?
সমস্ত জমিদারিতে এক ধরনের উৎকণ্ঠা, কটাক্ষতা, টিপ্পনী নানা বিধ কথার ইশারা-ইঙ্গিত জমিদারবাবু এই কিছুদিন যাবত অনুধাবন করে এসেছেন। একবারের জন্যও জমিদারবাবু তার মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা পোষণ করেনি। 
এই কারণে যে, মাতৃহারা শিউলীকে মাতৃ ও পিতৃ আদরে মানুষ করেছেন। আজ পিতৃস্নেহের কারণে পিতা মেয়েকে কোন শাসন কিংবা মনের কোন প্রকার কষ্ট কারণ হতে চাইনি। তাই একসময় আত্মসম্মানের তাগিদে গোপনে ইন্ধনকে ডেকে পাঠালেন।
ইন্ধন মনে মনে খুশি হয়ে, খুব সকাল সকাল জমিদার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হল। ভাবলো নিশ্চয়ই শিউলী তার বাবাকে তাদের সম্পর্কের কথা বলেছে। তাই তার বাবা হয়তো রাজি হয়ে ইন্ধনের সাথে সে বিষয়ে কথা বলার জন্য নিশ্চয় ডেকে পাঠিয়েছেন।
এদিকে ইন্ধনকে দেখিবামাত্র পিতৃতুল্য শিউলির পিতা, ইন্ধনের পা স্পর্শ করার উপক্রম হলে, ইন্ধন সে হাত ছাড়িয়ে নিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় ইন্ধন হতভম্ব হয়ে গেল। বুঝতে পারল না কোথায় কি হয়েছে। কিন্তু যখন শিউলীর পিতা ইন্ধন কে অনুরোধ করে বলল। অচিরেই শিউলির বিবাহ কার্য অনুষ্ঠিত হবে। তাই আজ থেকে সকল প্রকার সম্পর্ক ত্যাগ করার জন্য বিনীত অনুরোধ করলেন। যেন শিউলির পথের বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। এই ও বলল যে, এই সকল কথা শিউলী কোনমতে যেন জানতে না পারে।
ইন্ধন পিতৃ আজ্ঞা মনে করে, নীরবে সে আজ্ঞা গ্রহণ করে নিল। সে আজ্ঞা তার জীবনকে মহা-বেদনার সমুদ্রে প্রবাহিত করে দিবে। সে জানতো না, বাস্তবিকতা বড়ই নির্দয়। অতঃপর সেদিন হতেই জমিদার বাড়িতে আর ইন্ধনকে দেখা গেল না।
(চলবে)

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।