ধারাবাহিক উপন্যাস: দিদার চৌধুরী'র "হৃদয়ের কান্না" -১০।। বর্ণপ্রপাত


অতঃপর যা হওয়ার তাই হল, চাকরিতে আর মন বসতে চায় না ইন্ধনের। হৃদয় ভেঙ্গে এক হাহাকারের প্রকাশ পেল। দেহ মন অবশ হয়ে যেতে লাগল। উদভ্রান্তের মতো ছুটতে লাগলো এদিক-সেদিন। কিছুই তার ভাল লাগছিল না। ইন্ধন শিউলীকে না পাওয়ায় আজ হৃদয় অভিমানে বিভ্রাট। ইদানীং একা একা রাত কাটায় বাহিরে। কোথায় যেন মাঝে মাঝে হারিয়ে যায়। তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন প্রায় দিনই বাড়িতে দেরি করে আসে। জিজ্ঞেস করলেও কোন প্রকার উত্তর দেয় না। ইদানীং নেশায় মত্ত হয়ে উঠছে। মাঝে মাঝে কিসের যেন পচা দুর্গন্ধ তার মুখ থেকেই বের হয় ।এই যেন চিত্তশুদ্ধি এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা।

শিউলী হঠাৎ ইন্ধনের এই নীরবতায় ব্যাকুল হয়ে উঠলো। বারবার ইন্ধনের কাছে লোক পাঠালো শিউলী। অনেক পত্র লিখেছে শুধু একবার দেখা করার অভিপ্রায়ে।কিন্তু কোন এক অজানা কারণে কোন পত্রের উত্তর মিলল না।

অবশেষে একদিন শিউলী নিজেই খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারল, আজ বেশ কিছুদিন যাবৎ ইন্ধনের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

ইন্দনের হঠাৎ রহস্যময় ভাবে এভাবে হারিয়ে যাওয়া শিউলী সহজে মেনে নিতে পারল না। চিন্তায় চিন্তায় শিউলীর দেহ-মনে ক্ষীণ হয়ে আসতে লাগলো।

যে ইন্ধনকে হৃদয়ের মাঝে ঠাঁই দিয়ে আপন করার জন্য শিউলীর মন ব্যাকুল। আর সেই সময়ে শিউলীকে ছেড়ে চলে যেতে হল ইন্ধনকে। সবকিছু যেন হঠাৎ ঘটে গেল কোন কিছু না জানার আগে। কি কারণে ইন্দনের রহস্যময় দূরে থাকা জানতে পারল না শিউলী। শুধু দীর্ঘ নিঃশ্বাস সাথী হয়ে আছে। অকাতরে দু'হাতে বিলানো ভালোবাসা ,না পাওয়া হৃদয়, দুঃখ সহিষ্ণুতা হৃদয়কে চুরমার করে ঝড় তুলে যায়।

বিনিদ্র রজনী পূর্ণিমার চাঁদ রাতের আকাশে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। কিন্তু মনে চাঁদ মলিন ভাষার দণ্ডনায়ক।
শেষ যেদিন শিউলীর বাড়ি হতে ইন্ধন চলে এসেছিল। তার তিনদিন পর হতে অদ্যাবধি ইন্ধনকে কেউ গ্রামে দেখতে পেল না। এ ভাবে অনেক গুলো দিন কেটে গেল।

 ইতিমধ্যে তার বিধবা বোনের বিবাহ হয়ে গেল। তার স্বামী ফরেস্ট্রি বিভাগে চাকরি করেন।বিয়ের কিছুদিন পর তার স্ত্রী ও শাশুড়ীকে নিয়ে তার কর্ম স্থলে চলে গেলেন। ভদ্রলোক খুব ভালো মানুষ ছিলেন।
শিউলিকে পাওয়ার তীব্র ইচ্ছা ছিল ইন্ধনের। অথচ শিউলীর পিতার ইচ্ছায় শিউলীর ভালোবাসাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ইন্ধন আজ ভবঘুরে। সে শুধু শিউলীকে ছেড়ে গেল না, ছেড়ে গেল মা-বোন এমনকি পিতার শেষ চিহ্ন বসতবাড়ি।

নিজ চৌহদ্দি পেরিয়ে এক সময় ইন্ধনকে দেখা গেল শিলংয়ের এক পাহাড়ি এলাকায়। শিলংয়ে তখন শীতকাল, সর্বত্র শীতবস্ত্রের খুবই অভাব। পাহাড়ি অঞ্চলের লোকেরা সন্ধ্যা রাতে কাঠ পুড়িয়ে শীত নিবারণ করে থাকে। ইন্ধনকে দেখা গেল জীর্ণ শীর্ণ দেহে অগ্নিদগ্ধ কাঠের পাশে বসে থাকতে। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে কাঠ আগুনে ঠেলে দিচ্ছে ।আর বিড়বিড় করে মনে মনে কি যেন বলে যাচ্ছে। বুঝলাম শিউলীকে না পাওয়ার বেদনা অদ্যাবধি বয়ে চলছে ।

এখানকার লোক একে তিন বছর যাবত দেখে আসছে। সবাই তাকে আধা পাগল বলে জানতো। তবে কারো কোন ক্ষতি কিংবা নষ্ট করত না বলে, কেউ কিছুই বলতো না বরং আদর‌ই করত। গায়ে একটি বড় শাল সব সময় থাকতো। যেটি এক সময় শীতের রাতে শিউলী তাকে দিয়েছিল। হয়তো শিউলীর শেষ চিহ্ন মনে করে, এখনো এটি গায়ে জড়িয়ে আছে। মাথার চুলগুলো অগোছালো, ধুলোবালিতে ভরা। মুখের দাড়িমোচে ভরা চেহারায় রহস্যময় ছাপ। কোথায় যেন কি হারিয়ে গেছে তার। কিন্তু কোথাও তা খুঁজে পাচ্ছে না এমন। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো ।সবকিছু হারিয়ে ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়িয়ে আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করার ইচ্ছা পোষণ করা। কিন্তু সেই ভাব- ইচ্ছা ইন্ধনের মনে প্রকাশ পেল না। শুধু মনে হল ধ্বংসাবশেষের উপর এ যেন এক ধ্যানমগ্ন ধ্যানী। সে মাঝে মধ্যে এই গ্রামের এক বুড়ির বাড়িতে যায়। কেন যায়? হয়তো মনের গহ্বরে জমে থাকা বেদনার নিস্তব্ধ ভাষা ক্ষণিকের জন্য ভুলে থাকার ব্যর্থ প্রচেষ্টায়। নিষিদ্ধ পল্লীর নেশা জলের নিষ্কণ্টক বেদনার হিমবাহ অন্তরকে পুড়ে নিষ্কৃতি করে। হয়তো সেই নিষ্কৃতি পাওয়ার আশায়।

অন্যদিকে ইন্ধন চলে যাওয়ার পর হতে, শিউলীর মানসিক ও শারীরিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। ইদানীং তার শারীরিক কিছুটা উন্নতি হলে, তার পিতা বিবাহ যোগ্য পাত্রের সন্ধান ব্যতিব্যস্ত হয়েছেন।

কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর সে রকম একটি সুযোগ্য পাত্র সন্ধান মিলল। যথা নিয়মে বিবাহের দিনক্ষণ ঠিকঠাক হলো। শিউলী ও বিবাহে অমত করল না। শুধু একবার ভেবেছিল, আত্মহত্যা করে এই অনাবশ্যক ধরা হতে চির বিদায় নিবে। কিন্তু এই পাপ কর্ম শিউলীর দ্বারা হলো না। আর পাপের ভাগ যত বড়ই হোক না কেন তাতেও কোন অমত ছিলনা। যদি জন্মদাতার সামান্য বদনাম হয়, তবে একালে ও পরকালে জন্মই বৃথা। কিন্তু ইন্ধনের ভালোবাসা জন্ম-জন্মান্তর তা হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। তাকে দূরে সরাবার বিন্দুমাত্র অভিপ্রায় তার নেই। দেবতারসম ভালোবাসা ছিল ইন্ধনে।

বিবাহের আলোকসজ্জা ,ঢোল বাদ্য, কর্ম কোলাহল, চারিদিকে আনন্দধারা। নয়নের প্রবাহমান জলের ধারাকে রোধ করার শক্তি। বিবাহ আসরের কোন তন্ত্র মন্ত্র কাবু করতে পারলো না। অশ্রুসিক্ত নয়নে বিবাহর যাবতীয় কাজ শেষ হল।

এবার বিদায়ের পালা। শিউলীর বিদায় ক্ষণে এমন অবস্থা হলো। সবার চোখের জল উপস্থিত না হয়ে পারল না। আজই সবার শুনতে পেল ঘরের বাহিরে উচ্চস্বরে শিউলীর সকরুণ রোদন।

যা এতোকাল গতিরোধ ছিল বলপূর্বক। আজ সেই নিয়মের ব্যবস্থা লোপ পেয়েছে।

বিদায়ের সকরুণ সানাই মুহূর্তে বেজে উঠেছে। কিন্তু পূর্বের প্রবাহমান বেদনার স্মৃতি রোমন্থন না হয়ে। হঠাৎ হাসির ঝালক ফুটে উঠল শিউলীর অধরে। হয়তো ক্ষণস্থায়ী বর্তমানকে ভুলে থাকার কারণে। কিংবা আপনজনদের মনে সুখের পরশ দেওয়ার তাগিদে। সবকিছু ভুলে থাকায় হলো সময়ের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য। অদৃশ্য বর্তমানের সুখের বসতি কামনা করে অশ্রুসজল নয়নে বিদায় নিল বিরহী শিউলী কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবহেলার অন্তরালে, হৃদয়ের গহ্বরে, পরাজয়ের দুর্গতির অলক্ষিত গ্লানির নীরব ভাষা, অনুভূতির হৃদয় দিয়ে শুনতে হয়। কে শুনবে এই মর্মবাণী? আন্তরিকতা শূন্য উপলব্ধিহীন নেই লোকালয়।
"দুঃখীর দৃষ্টিতে বিশ্ব অন্ধ আর সুখীর দৃষ্টিতে জীবন বিশ্ব রসময়"।
প্রবাহমান কাল হতে নারীর অধিকার নারীর মন কেউ বুঝতে চাইনি। হৃদয়ের আবেগ অনুভূতি ,মায়া মমতা, ভালোবাসার প্রকৃত ভান্ডার‌ই তো নারী। তাদের ছোঁয়ায় বিশ্ব প্রকৃতি নব বিচিত্রময় রূপ ধারণ করে। অথচ এই নিপুণ নিখুঁত শিল্পীর মনের ভাষা কেউ বুঝতে চেষ্টা করেনি। নারীর মর্মবিদারী আহাজারি অজ্ঞাত লোকচক্ষুর অন্তরালে। এখানে বস্তুত কারা দায়ী ? সমাজ না সমাজের ধারক।

শিউলি তার পিত্রালয় ত্যাগ করার, শেষ বিন্দু পর্যন্ত ইন্ধনের এর কথা স্মরণ করছিল। কিন্তু কোথায় ইন্ধন? বেঁচে আছে না মরে গেছে তারই বা খোঁজ কে রাখে।

নব পরিণীতা শিউলীর স্বামী চম্পক রায়। ভদ্রলোক হরিণার জজ কোর্টের বিচারক‌‌। চরিত্রবান আর ন্যায় বিচারক হিসেবে সুনাম সারা হরিণা পার হয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। স্বামী হিসেবে শিউলির সাথে যথার্থ হয়েছে।

এক শ্রাবণের বর্ষণে শিউলীর স্বামী বসে আছে বারান্দার এক কোনে। হাতে আজ বিচারকের মাপকাঠির পুঁথি পুস্তক নেই। চম্পক রায়কে এমন নীরব দেখায় ,যেন শ্রাবণের বারিধারা ঝরছে তার হৃদয়ে। দীর্ঘসময়ের সংসারের অন্তরালে জীবনের চাওয়া পাওয়া কখনো কখনো মএনকে উদাসীন করে তোলে ‌। কিছু কিছু না পাওয়ার বেদনা মনকে হাহাকার করে তোলে। জীবন থেকে অনেকটা দিন কেটে গেল, নানা সুখ দুঃখে কেটে গেল অনেকটা বছর। জীবন সংসারে অনেকটা দিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও। এই নীরব ভাষী শিউলীর কোন অভিযোগ কখনো উত্থাপন করেনি। আজ অবধি শিউলীর কোল জুড়ে কোন কিছুইতো দিতে পারলাম না।
চলবে

আপনার লেখা ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস, সাহিত্যিকের জীবনী, সাক্ষাৎকার, সাহিত্যের খবর বর্ণপ্রপাতে প্রকাশ করতে চাইলে ইমেইল করুন bornopropat@gmail.com

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।