এই ড্রাইভার, গাড়িটা একটু জোরে চালাও ।
দুই মিনিট পর পর এই কথাটা বলে ড্রাইভারকে ধমকাচ্ছেন শফিক সাহেব।আজ তার মেজাজটা একটু গরম।একটা ইম্পর্টেন্ট মিটিং আছে আজকে অফিসে।
শফিক সাহেব একজন বড় শিল্পপতি।এমনিতে তিনি মানুষ ভালো তবে যখন রেগে যান তখন তাকে সবাই একটু বিশেষভাবে এরিয়ে চলে। বিশেষকরে সময়ের ব্যাপারে তিনি খুবই সচেতন, সব কাজ ঠিক সময় মত হাওয়া চাই। আজকে তার অফিসে যেতে একটু দেরী হয়ে গেছে, আর তাই মেজাজের তাপমাত্রা অন্যদিনের থেকে একটু বেশি।
গাড়িটা বেশ দ্রুত চলছে । চার রাস্তার মোড়ে এসে অসাবধানতাবশত গাড়িটা গিয়ে ধাক্কা দিলো পাশে দাড়িয়ে থাকা একটা রিকশাতে। ভাগ্যিস তখন রিকশার চালক সেইখানে ছিল না।সে গিয়েছিলো পাশের দোকানে চা খেতে। রিকশার অবস্থা দেখে রিকশার চালক হায়! হায়! করতে করতে দৌড়িয়ে এলো।
রিকশা চালক গাড়ির কাছে এগিয়ে এসে বললো, “এইডা কোনো কাম করলেন সাহেব!" এমনিতেই আমাগো নুন আনতে পান্তা ফুরায়।অহন আমি করমু কি আর খামু কি?
এমনিতেই শফিক সাহেবের মেজাজটা সকাল থেকে গরম তারপর আবার রিকশাওয়ালা এসে তাকে এইসব বলছে। তিনি আরো রেগে গেলেন। তিনি গাড়ির জানালার গ্লাস টা নামিয়ে কিছু টাকা লোকটার মুখে ছুড়ে দিয়ে বললেন,
"Now , get lost .
And go to hell, you idiot"
লোকটা কিছু না বলে, টাকাটা কুড়িয়ে নিলো ।
অফিস থেকে ফেরার পথে শফিক সাহেব তার বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখলেন অনেক মানুষ ভিড় করে দাড়িয়ে আছে।
বিষয়টি দেখার জন্য তিনি ও একটু এগিয়ে গেলেন, গিয়ে দেখলেন সকালের সেই লোক ( সেই রিকশাওয়ালা) রাস্তায় পড়ে আছে।তার সারা শরীর রক্তাক্ত । পাশে দাড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তি বললো,একটা ট্রাক আইসা পিছন থেকে মাইরা দিছে।শফিক সাহেব মনে মনে বললেন,
“আপদ মরেছে"।
তার বেশ কিছু দিন পর শফিক সাহেবের মন চাইলো তার গ্রামে যেতে। যদিও তিনি অনেক আগে থেকেই শহরে থাকেন কিন্তু তার জন্ম তো গ্রামে, তাই গ্রামের প্রতি একটা টান থেকেই যায়। তিনি চেয়েছিলেন স্বপরিবারে গ্রামে যাবেন, কিন্তু তার স্ত্রী আর ছেলে মেয়েরা কেউ'ই যেতে চায়নি। তাদের নাকি গ্রাম ভালো লাগে না। তাই অগত্যা একা ই যেতে হলো শফিক সাহেবকে ।
গ্রামে এসে শফিক সাহেবের সবার আগে যার কথা মনে পড়লো তার নাম মধু মিয়া। মধু মিয়া আর শফিক সাহেব ছোট বেলার বন্ধু। দুই জন সবসময় এক সাথে থাকতো। শফিক সাহেবের বাবা তাকে পড়ালেখার জন্য শহরে পাঠিয়ে দিলেও মধু মিয়া গ্রামেই ছিল।
গ্রামের লোকজনের কাছে শুনে শুনে শফিক সাহেব মধু মিয়ার বাড়ি খুঁজে বের করলো। মধু মিয়ার বাড়িতে ঢুকে শফিক সাহেব দেখলেন বাড়ির উঠোনে তিন বছরের একটা বাচ্চা বসে খেলা করছে । একটু ডাকা ডাকি করার পর ঘর থেকে একজন মহিলা বের হয়ে এলো। পরিচয় জানতে চাইলে মহিলা বললো সে মধু মিয়ার স্ত্রী।
নিজের পরিচয় দিয়ে এইবার শফিক সাহেব মধু মিয়ার কথা জিজ্ঞেস করলেন।মধু মিয়ার কথা জানতে চাওয়ার পর মধু মিয়ার স্ত্রী অঝোরে কাদতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর সে ঘর থেকে মধু মিয়ার একটা ছবি এনে শফিক সাহেব এর হাতে দিলো। ছবিটা দেখে শফিক সাহেব কিছুক্ষণ হতভম্ভ হয়ে দাড়িয়ে থাকলেন। যেনো তিনি তার বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন!
মধু মিয়ার স্ত্রী বললো বন্যায় আমাগো সব ভাইসা গেছে। তারপর উনি কামের খোঁজে শহরে গেছিলেন।শহরে রিশকা চালাইতেন । কিছু দিন আগে একটা টিরাক এর সাথে অ্যাকসিডেন্ট কইরা........"।আর কিছু বলতে পারলো না মধু মিয়ার স্ত্রী, সে আবার কাদতে লাগলো।
শফিক সাহেব এর নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। তার কানে শুধু একটা কথা ই বাজতে থাকে যেইটা তিনি মধু মিয়ার লাশ দেখে বলেছিলেন,
“আপদ মরেছে"
বিকালে মধু মিয়ার স্ত্রী শফিক সাহেবকে মধু মিয়ার কবরের কাছে নিয়ে নিয়ে গেলো।
মধু মিয়ার কবরের কাছে গিয়ে শফিক সাহেব কোনো কথা বলতে পারলেন না।তিনি মধু মিয়ার কবরের পাশে বসে পড়লেন। কবরের উপর হাত রাখার পর শফিক সাহেবের অজান্তেই তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো।
কবরের পাশে বসে তিনি শুধু একটি কথায় বলতে লাগলেন,“আমাকে মাফ করে দিস বন্ধু।"“আমাকে মাপ করে দিস।"
লেখক : তাসনিম তিশা
বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।