০১.
তখনও ভোর হয় নি। তখনও বাসন্তিকা বর্ণ-শোভায় শোভিত শাড়ীতে দুলে ওঠা ফাল্গুনের মেঘহীন আকাশের পূর্ব নীলিমা জুড়ে রক্তরাগে মোড়ানো রক্তিম সূর্যের পূর্বরাগের পাখনা মেলা সোনামাখা বিজড়ন দিগন্তের সীমানা ছুঁয়ে যায় নি। তখনও পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ আর ঝগড়ার কোলাহলে মিশে যাওয়া প্রলাপে আকাশ চিরে চৌচির হয়ে যায় নি। তখনও ঘন ঘোর কুহেলিকার আস্তরন ভেঙ্গে প্রভাতী অধর যামিনি শেষের শুভ্র-ধবল দিবসকে আহ্বান জানায় নি। না জানালেও ভরা রাত্রি জেগে থাকা অনেক দূরের কোনো ঘন অরণ্যের কোনো একটি বৃক্ষ-শাখায় বসে চোখ জুড়োনো, মনোলোভা একটি চিরদিনের চিরচেনা মিষ্টি পাখি- ঘুঘু কী মিষ্টি কন্ঠে ওর সঙ্গিনীকে কাছে পাবার জন্যে আকুল হয়ে অবিরত ডেকেই চলেছে। আরও অতি দূর থেকে ওর সঙ্গিনীটিও বুঝি আরও কোনো একটি বনবৃক্ষের ডগায় বসে ওর সঙ্গীর আকুলিত আহ্বানে অবিরাম সাড়া দিয়েই চলেছে। ওর সাড়াতেও একই আকুলতা জড়ানো। কিন্তু তারপরেও সঙ্গিনীটি ওর কাছে আসছে না। সঙ্গীটিও সঙ্গিনীটির কাছে যাচ্ছে না। অথচ ওদের দু’জনের সাড়াতে বোঝাই যায় ওদের বিচ্ছেদ হয় নি। তবুও মনে হয় বিচ্ছেদের বেদনায় ওরা দু’জনই দু’জনের কাছে কেমন যেন সকরুণ বেদনা-বিধুর। যদিও ওদের ডাকে বেদনা বিধুরতার মাত্রাটি কী পরিমাণের- বোঝার কোনো উপায় নেই। তবুও ওদের সাড়া দেবার শব্দ-ভঙ্গিটি থেকে কিছুটা হলেও আঁচ করে নেয়া যায়- ওরা দু’জনই একে অপরের কাছে আসতে চায়। ভাবতে কষ্ট হয় না যে, এই একটি মাত্র আগ্রহই ওদের দু’জনের কাছে অতি-প্রবল। কিন্তু কে কার কাছে আগে আসবে- এ সিদ্ধান্তটিই বোধকরি ওরা নিতে পারছে না। হয়তো সঙ্গিনীটি চাইছে সঙ্গীটিই ওর কাছে আগে আসুক, আবার সঙ্গীটি হয়তো চাইছে এর ঠিক উল্টোটি। হয়তো দু’জনের কাছাকাছি আসবার মাঝখানে এ ধরনের একটি নিগুঢ় অভিমান বোধ ওদের দু’জনের দু’টি অন্তরকে এভাবেই ভিজিয়ে দিচ্ছে। এ কারণেই বুঝি কেউ কারুর কাছে আসতে পারছে না। তবে কোনো না কোনো এক সময় আসতে ওদের হবেই। একজনের ঠোঁটের সাথে আর একজনের ঠোঁটকে যে কথা কইতেই হবে- না হলে যে ওদের অভিমানে চুর চুর বিরহ-ভাণ্ড পূর্ণ অমৃত-সুধা পান করবার কেউই থাকবে না। আর সে কারণেই যে ওদের পরস্পরকে একে অপরের কাছে আসতে হবে ওই সুধা-ভাণ্ডে রক্ষিত অমৃতের স্বাদ গ্রহণ করবার জন্যে- এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।
এ রকম একটি শিহরণ জাগানিয়া পরিবেশের মধ্যে আবার শত শত ঝি ঝি পোকার সমস্বরে বিরামহীন তুমুল একমাত্রিক চিৎকারের শ্রবণ দীর্ণ করা প্রতিযোগিতা যেন পরিবেশটিকে আরও ভয়াবহ রকমের ত্রাসিত করে তুলছে। হাজার হাজার জোনাকির নিভে জ্বলা আলোর সাথে আঁধারের মাখামাখি যেন ফাল্গুন শুরুর কুয়াশাচ্ছন্ন শেষ রাত্রিটিকে একটি অদৃশ্য ভীতির আকরে নিমজ্জিত করে চলেছে মুহূর্তে মুহূর্তে সেই নিভে জ্বলা আলো আর আঁধারের সাথে ছন্দ মিলিয়ে। এ এক অদ্ভুত বিধান খেয়ালী বিধির। অতিক্ষুদ্র একটি পতঙ্গের শরীরের একটি অংশ থেকে ততধিক ক্ষুদ্র একটি হলদে প্রভার আলোক বিন্দু নিমেষে জ্বলে উঠে প্রকৃতিকে তিল পরিমাণের মিষ্টি আলোকের ঝিলিক দেখিয়ে তখনই আবার নিভে গিয়ে ঘোর আঁধারে ঢেকে দিচ্ছে প্রকৃতিকে। ঘন ত্রাস আর ভীতির মধ্যেও মননের কোথায় যেন একটি অপূর্ব ভালো লাগার অনুভুতি অবচেতনাতেই ক্রিয়াশীল হয়ে যায় ক্ষণিকের জন্যে হলেও বুঝি। কিন্তু ভালোলাগার এ মৌহূর্তিক অনুভূতিটি মোটেই আর অতিরিক্ত এতটুকু সময়ের জন্যেও স্থায়ী হয় না। কোথায় যেন মিলিয়ে যায় দূরের কোনো ঘন অরণ্যের মতো থোকা থোকা ঘনিষ্ঠ-ঘনত্বে পূর্ণ মাথা নোয়নো দীর্ঘাঙ্গী বাঁশ ঝাড়ের ভেতর থেকে ভেসে আসা রাত্রির শেষ প্রহর ঘোষণায় রত শৃগাল কুলের অবিশ্রান্ত শ্রুতি-বিরুদ্ধ আর বিকট কর্কশ চিৎকারের শব্দে। এ চিৎকারের বুঝি কোনও শেষও নেই।
এবার যেন এক প্রকার আকস্মিকভাবেই সম্বিত ফিরে পায় একটি তীব্র খরস্রোতা নদী-‘কুমারিকা’র তিন কিলোমিটার দক্ষিণ দিক থেকে শুরু হয়ে উত্তর দিকে প্রলম্বিত বাঁধের রাস্তার ওপর দিয়ে একটি প্রাইভেট কারের ষ্টিয়ারিংয়ে বসে দূরন্ত গতিতে ড্রাইভ করতে থাকা ত্রিশোর্ধ নারীটি। নদী ভাঙ্গনের কবল থেকে একটি জেলা শহরকে রক্ষা করবার জন্যে অনেক আগেই এ বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছিলো। এবং বাধটি নির্মাণের অনেক দিন পর সাধারণ মানুষ এবং যানবাহন চলাচলের উপযোগী করে বাঁধটির পুরোটাই পাকা সড়কে রূপান্তরিত করা হয়েছিলো। এতে নদী ভাঙ্গনের কবল থেকে শহরটিকে রক্ষা করবার মাধ্যমে শহরের মানুষ জনের যথেষ্ট উপকার সাধিত হলেও নদীটির অপর পাড়ের বিশেষ করে চরাঞ্চলের মানুষদের দুর্ভোগের মাত্রাটি অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিলো। বিশেষতঃ প্রতি বছর বর্ষা ঋতুতে। ওই ঋতুতে প্রবল বন্যার পানির প্লাবনে চর এলাকার অধিকাংশ বাড়ী ঘরই বিদ্ধস্ত হয়ে যেত। এবং প্রতি বছরই এ নির্দিষ্ট ঋতুটিতে চরম দূর্যোগের মুখোমুখি হয়েই কোনোমতে ওদেরকে বেঁচে থাকতে হতো। এ বাঁধটি সেখানকার মানুষদের জন্যে বোধকরি বাস্তব অর্থেই সৌভাগ্যের চাইতে দূর্ভাগ্যের দূর্ভারই বয়ে এনেছিলো অধিক মাত্রায়। তারপরেও সেখানকার মানুষজন বিষয়টিকে মেনে নিয়েছিলো শুধু এ কারণে যে, বাঁধটি নির্মিত হবার ফলে শহরে যাতায়াতের সময়টি ওদের জন্যে অনেকটাই কমে গিয়েছিলো এবং যেহেতু ওরা কখনই নিজেদের যুগ যুগান্তরের ভিটে মাটি আর হৃদয় নিংড়ানো নির্যাস দিয়ে তৈরী করা পরিবেশ ত্যাগ করে শহরে গিয়ে শহরের সঞ্জীবন বিহীন পাথরের মতো কঠিন শুষ্ক মাটিতে নিজেদের বসতি নির্মাণ করতে পারে নি। কারণ ওরা সেটি করতে চায় নি। কোনো বড় ধরনের প্রলোভনের বিনিময়েও করতে চায় নি।
নারীটি প্রাণপণ চেষ্টা করছে ভোর হবার আগেই যাতে মূল নদীটির তীরে পৌঁছোনো যায়। আর সে কারণে গাড়ীর গতি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি করেই চলেছে নারীটি। স্পীড মিটারের ইন্ডিকেটরটি সত্তর থেকে আশি কিলোমিটারের মধ্যে ওঠা নামা করছে। বহুদিন আগে পাকা হলেও বর্তমানের এ ধরনের ভাঙ্গাচোরা একটি রাস্তায় কুয়াশাচ্ছন্ন শেষ রাত্রিতে এত স্পীডে গাড়ী চালানো যে কত ভয়ঙ্কর ভাবতেই চাইছে না নারীটি। ডান বাম কোনো দিকেই তাকাচ্ছে না ও। নিষ্পলক স্থির দৃষ্টি সম্মুখের দিকে নিবদ্ধ। গাড়ীটিতে ফগ লাইট থাকবার কারণে শেষ রাত্রির কুয়াশা ভেদ করে গাড়ী চালাতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না ওর। বোঝা যায় গাড়ী চালাতে যথেষ্টই দক্ষ নারীটি। অবশ্য গাড়ী ড্রাইভিংয়ে দক্ষতা অর্জনের নেপথ্যে ওর শৈশবের একটি ঘটনা মূখ্য ভুমিকা পালন করেছিলো বলে ও মনে করে। বিষয়টিকে এই মুহূর্তে কিছুটা অস্বচ্ছ এবং ভ্রমাত্মক বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তবে কিছু সময় পরেই এই স্বাভাবিকতার নেপথ্যের কারণটি আপনা আপনিই পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে।
০২.
কিন্তু এ ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষাটিকে যদি আত্ম-সীমায়তির ভেতর একটি নির্দিষ্ট মাত্রাগত নিয়ন্ত্রণে আনয়ন করে স্থিত রাখা না যায় কেবল তাহলেই বিষয়টি একটি সমস্যার আকার ধারণ করতে পারে। যদিও কোনও কারণে প্রত্যক্ষভাবে সে আকার না-ও ধারণ করে তথাপি পরোক্ষভাবে ধারণ করবার একটি সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর মূলতঃ আশঙ্কাটি সেখানেই। এবং এ আশঙ্কার বিষয়টি মাথায় থাকবার পরেও নারীটি একেবারেই যেন ডেসপারেট। কোনো কিছুতেই সে নিজেকে স্বাভাবিক অবসস্থায় ফেরাতে পারছে না। ভোর যতই এগিয়ে আসছে গাড়ীর গতিও ততই বেড়ে যাচ্ছে। ভোর হবার আগেই নারীটিকে যে নদী তীরে পৌঁছুতেই হবে।
শেষ পর্যন্ত গাড়টি পৌঁছে গেলো কুমারিকা নদীর পূর্ব তীরে। তখন কেবলমাত্র ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কুয়াশার কারণে তখনও আঁধারর প্রলেপ প্রকৃতি জুড়ে বিন্যস্ত থাকলেও পূর্ব দিগন্তে সূর্যের রক্তিম আভার রেখা অস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে। গাড়ীটির ষ্টার্ট বন্ধ করে গাড়ীটির ডান দরোজাটি খুলে যে মুহূর্তে নারীটি একটি পা বাড়িয়েছে নীচে নামবার জন্যে ঠিক সেই মুহূর্তেই প্রচণ্ড শব্দে পরপর বেজে উঠলো কেন্দ্রিয় কারাগারের ভেতরের তিনটি ঘন্টা। অর্থাৎ কারাগারে অবস্থানরত সকল কয়েদি এবং হাজতিকে তাদের স্ব স্ব ওয়ার্ড এবং কক্ষ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে-বাজানো ঘন্টার শব্দগুলি তারই সঙ্কেত। এটি কারাগারের প্রতিদিনের চিরাচরিত নিয়ম। সেন্ট্রিরা এক এক করে সব ওয়ার্ড এবং কক্ষের দরোজা খুলে দিয়ে দরোজার সামনে অপেক্ষারত। ধীরে ধীরে সব কক্ষ এবং ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করলো কয়েদি এবং হাজতিরা। এরপর গুনে গুনে সবাইকে জেলখানার ভেতরের মাঠের নির্দিষ্ট স্থানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানোর পালা।
০৩.
ঘন্টাধ্বনির তীব্র কর্কসতায় ঘুম ভেঙ্গে যাবার সাথে সাথে স্বপ্নটিও ভেঙ্গে গেলো জেলখানার কক্ষের মেঝের ওপর বেছানো একটি কম্বলের ওপর শায়িত নারীটির। নারীটির নাম লতিকা বিন্দি। বিন্দির জন্ম হয়েছিলো গ্রামের বাড়ীতে। স্থানীয় ধাত্রীকে দিয়েই ওর প্রসব করানো হয়েছিলো। প্রসবের ব্যাথা উঠবার পরপরই বিভিন্ন ঔষধি লতা গুল্মের নির্যাসের মাধ্যমে তৈরী করা এক প্রকারের ওষুধ প্রসুতিকে খাওয়ানো হয়েছিলো যাতে প্রসবটি নির্বিঘ্ন এবং সহজেই হতে পারে। ওষুধটি কাজ করেছিলো। বিঘ্নহীনভাবে জন্ম লাভ করে প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেছিলো বিন্দি। জন্মাবার এক সপ্তাহ পর ওর কপালে একটি সুক্ষ্ম লাল টিপ পরিয়ে দিয়েছিলো ওর মা। গ্রামের মানুষজন ওই ধরণের টিপকে বিন্দি বলেই মনে করতো। আর সে কারণেই ওর ডাক নামটি হয়ে গিয়েছিলো বিন্দি। ছ’মাস পর ওর বাবা ওই বিন্দি নামটির আগে আর একটি নাম জুড়ে দিয়েছিলেন- ‘লতিকা’। যেহেতু বাচ্চাটি প্রসবের আগে প্রসুতিকে লতা গুল্মের ঔষধি রস খাওয়ানো হয়েছিলো সেইহেতু ওর বাবা- আব্দুল্লাহ্ আইবেক আল মোহম্মদ বিন্দি শব্দটির সামনে ‘লতিকা’- শব্দটি বসিয়ে দিয়েছিলেন। আব্দুল্লাহ আইবেকের পিতা যেহেতু মনে করতেন তার বংশ সুলতানী আমলে ভারতের মহান শাসক সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেকের বংশ থেকে উদ্ভুত সেইহেতু পূত্রের নামের সাথে আইবেক পদবীটি সংযোজন করে দিয়েছিলেন তিনি। আর এতে তিনি এক ধরণের গর্ব অনুভব করতেন। সেই থেকে ওই পদবীটি তার পরবর্তী বংশধরদের বংশীয় পদবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলো। এরই সূত্র ধরে বিন্দির পিতা কন্যার নামের সাথে ‘আইবেক’ পদবীটি জুড়ে দিয়েছিলেন। বিন্দির পূরো নামটি হয়ে গিয়েছিলো- ‘লতিকা আইবেক বিন্দি’। তবে সবাই ডাকতো বিন্দি বলেই। বয়স বত্রিশোর্ধ। দীর্ঘঙ্গী, শ্যামল বর্ণে শোভিত একরাশ দীর্ঘ কালো চুলের ঝর্না স্পষ্ট করে দেয় ওর অটুট যৌবনের ইঙ্গিতটিকে। দৃষ্টি যেন হঠাৎ করেই আটকে যায় ওর চুল আর ঘন ভ্রু যুক্ত দীঘল দুটি চোখের ওপর। প্রথম দৃষ্টিতেই ভালো লাগার মতো দেহ-বল্লরী ওর। সহজে ভোলা যায় না। ও একটি কলেজের সহকারী অধ্যাপক। পেশা বলতে অধ্যাপনা অর্থাৎ শিক্ষকতা। এ ধরণের একটি মহান পেশার সঙ্গে জড়িত থেকে যে কাজটি ও করেছে সেটি সমাজের চোখে চরম অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হলেও ওর দৃষ্টিতে মোটও তা নয়। এবং ওই কাজটির জন্যে ও বিন্দু পরিমান অনুতপ্ত তো নয়ই বরং ওই কাজটি ও নিজে করতে সক্ষম হওয়ায় পৃথক একটি গর্ব অনুভব করতো নিজের ভেতর। এবং এই গর্ব অনুভব করবার কারণে নিজের জীবনটিকে ও একেবারেই তুচ্ছ মনে করতো। কারণ ও যে ঘটনাটি ঘটিয়েছিলো সে ঘটনায় অপরাধের যে মাত্রা তার চাইতেও কয়েক গুন বেশী অপরাধ ওর শৈশব জীবনে ঘটিয়েছিলো এই শিক্ষা পেশাতেই নিয়োজিত থাকা আর একজন শিক্ষক। আর সেই শিক্ষককৃত অপরাধের আঘাত আজও সে ভুলতে পারে না। প্রতিমুহুর্তে হনন করে চলে ওকে সেই আঘাতের সহ্যাতীত যন্ত্রনা। আর ওই যন্ত্রনা প্রশমনের জন্যেই ও ঘটনাটি ঘটিয়েছিলো। এতে ও মনে করে ওর কোনো অপরাধ নেই। ও লজ্জিত অথবা দুঃখিত কোনোটিই নয়। সে জন্যেই ও ভাবতো প্রতিমুহূর্তের আত্মহননের চাইতে একবারেই নিঃশেষ হয়ে যাওয়া অনেক সুখের। অনেক তৃপ্তির। ওকে তো মানসিকভাবে হত্যা করা হয়েছে অনেক আগেই। এখন শুধু দৈহিকভাবে মৃত্যুর অপেক্ষা। এই অপেক্ষার প্রহর শেষ হলেই ও যেন বাঁচে!
স্বপ্নে ও দেখছিলো কুমারিকা নদীটি অতিক্রম করে ও প্রতিবেশী একটি দেশে প্রবেশ করছে। প্রবেশ করবার পর জীবনটি হয়তো ওর একটি নিশ্চিন্ত স্থিতি লাভ করবে। বিন্দি মনে মনে যতই ভাবুক অথবা যতই মুখে বলুক জীবন ওর কাছে তুচ্ছ তবুও এ স্বপ্নটির মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায় ওর মনের অবচেতনে ও একটি নিশ্চিত নির্বিঘ্ন জীবন প্রত্যাশা করে। কিন্তু হলো না। স্বপ্নটি ভেঙ্গে গেলো। একরাশ এলোচুল মাথায় নিয়ে কম্পিত পায়ে বেরিয়ে এলো নিজের কক্ষ থেকে। শুধু চারদিকটি একবার দেখে নিলো। আজ আটাশ জানুয়ারী। আজকে সর্বোচ্চ আদালত থেকে ওর মামলার রায় দেয়া হবে। কিছু সময় পরেই ওকে নিয়ে যাওয়া হবে সেই আদালতের হাজতে। তারপর সেখান থেকে আদালতের কাঠগড়ায়।
নিয়ম অনুযায়ী তাই হলো। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ জন জন বিচারপতি সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্টের এ্যাপিলেট ডিভিশনের পূর্ণঙ্গ বেঞ্চের নির্ধারিত বিচারপতিবৃন্দ এজলাসে তাঁদের আসন গ্রহন করলেন। আইনজীবি আর উৎসুক সাধারণ মানুষে এজলাস কক্ষ কানায় কানায় পূর্ণ। বিচারপতিবৃন্দ আসন গ্রহন করবার সঙ্গে সঙ্গে এজলাস কক্ষের সবাই তাদের আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ওঁদেরকে সম্মান জানালো। এরপর এজলাস জুড়ে পিন পতন নীরবতা। লতিকা বিন্দিকে কাঠগড়ায় নিয়ে আসা হলো। নিস্প্রান, নিস্প্রভ বিন্দি। চোখে মুখে ভাবান্তরনের কোনো লক্ষনের চিহ্ন মাত্র নেই। পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকলো কাঠগড়ায়। বিন্দি জানে ঘোষিত রায়ে কী ঘটবে ওর ভাগ্যে। মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলো বিন্দি। তাই ভাবান্তরেরও কোনো প্রশ্ন ছিলো না ওর কাছে। প্রধান বিচারপতি বেশ কিছু সময় ধরে বিন্দিকে পর্যবেক্ষণ করলেন। এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বিন্দিকে প্রশ্ন করলেন- ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার মামলার রায় ঘোষিত হবে------ আপনার কোনো প্রতিক্রিয়া ?’- বিন্দি নিরুত্তাপ শুকনো কন্ঠে উত্তর দিলো- ‘কিছু নেই স্যার। যে রায়ই আপনারা ঘোষনা করবেন আমি মেনে নেবো।’-আর কোনো প্রশ্ন করলেন না প্রধান বিচারপতি। অন্যান্য বিচারপতিবৃন্দও না। প্রধান বিচাপতি রায় ঘোষনা শুরু করলেন- ‘বাংলাদেশের মাননীয় হাইকোর্ট একটি হত্যাকাণ্ড সংঘটনের জন্যে আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের যে রায় প্রদান করেছিলেন সে রায়টিকেই আজ দেশের সর্বোচ্চ এই আদালত বহাল রাখলো। অর্থাৎ আসামিকে মৃত্যু দণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। একই সাথে আই জি, প্রিজনকে ফঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু দণ্ড কার্যকর করবার নির্দেশ প্রদান করা হলো। যতক্ষণ পর্যন্ত আসামির মৃত্যু নিশ্চিত ততক্ষন আসামিকে ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে রাখবা আদেশ দেয়া হলো।’ -রায় ঘোষনা শেষে বিচারপতিবৃন্দ এজলাস কক্ষ থেকে এক এক করে নিষ্ক্রান্ত হলেন। সাধারনতঃ এ্যাপিলেট ডিভিশনের রায় খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে ঘোষনা করা হয়। আসামিকেও কোনো প্রশ্ন করা হয় না। অথচ আজকে কেন যে ওকে প্রশ্ন করা হলো এবং কেন যে রায়টি কিছুটা দীর্ঘায়িত আকারে ঘোষনা করা হলো-বুঝতে পারলো না বিন্দি।
বিন্দির মা এজলাসে ছিলো। রায় ঘোষনা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে এজলাস থেকে বেরিয়ে বাইরের দরোজার পাশে দাঁড়ালো। পরপরই পুলিশ কর্ডন করে বিন্দিকে এজলাসের বাইরে নিয়ে আসা মাত্রই দরোজার পাশ থেকে এসে ওর মা ওকে জড়িয়ে ধরে নীরবে অশ্রুপাত শুরু করলো। কোনো কথা বললো না। বিন্দি মায়ের একটি হাত নিজের হাতের মুঠায় নিয়ে মায়ে মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু একটি কথা বললা- ‘আমি মনে প্রাণে মৃত্যু দণ্ডই কামনা করেছিলাম মা।’- আর কিছু না বলে পুলিকে উদ্দেশ্য করে বললো-‘আমাকে নিয়ে চলুন।’- পুলিশ ওকে নিয়ে প্রিজন ভ্যানে ওঠালো। ভানটি চলে গেলো কেন্দ্রিয় কারগারের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জনাকীর্ণ আদালত কক্ষ সারিবদ্ধ চেয়ারে আবৃত বিরান ভুমিতে রূপান্তরিত হলো।
এই মামলাটিতে নিম্ন আদালত বিন্দির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের যে রায়টি দিয়েছিলো উচ্চ আদালত সে রায়টিকেই বহাল রাখে। উচ্চ আদালতের রয়ের বিরুদ্ধে বিন্দি সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করতে চায় নি। কিন্তু একমাত্র মায়ের জীবিত থাকার বিয়ষটি বিবেচণা করেই আপিলটি করেছিলো বিন্দি। আপিল করবার পরেও বিন্দি জানতো পূর্বের রায়কেই বহাল রাখবে আপিল বিভাগ। কিন্তু তখন মা আর কিছু বলতে পারবে না। এবং এটি মাথায় রেখেই বিন্দি আপিল করবার ক্ষেত্রে সম্মতি জানিয়েছিলো। দেশের সর্বোচ্চ আদালত ওর মৃত্যুদণ্ডের সাজাটিকে বহাল রেখে ওর মনষ্কামনা পূর্ণ করে দিলেন। ভেতরে ভেতরে অনেকটা স্বস্তি অনুভব করলো বিন্দি। বিন্দির জীবনের একটি মাত্র অধ্যায় আর অবশিষ্ট থাকলো- ফাঁসিতে ঝুলে মৃত্যুবরণ।
০৪.
যখন বিন্দি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী তখন একদিন স্কুল থেকে বাড়ী ফিরবার পথে একটি প্রাইভেট কার ওকে ধাক্কা দিয়ে মূল সড়কের পাশে ফেলে রেখে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়। মেয়েটি রাস্তার পাশে পড়ে যাবার পরপরই ওকে ঘিরে পথচারী এবং স্থানীয় লোকজনের ভীড় ক্রমেই বাড়তে থাকে। ভীড় বেড়ে যাবার কারণে সেখানকার শোরগোলের মাত্রাটিও বেড়ে যেতে থাকে স্বাভাবিক নিয়মেই- স্বাভাবিক নিয়ম বলছি এ কারণে যে, আমাদের সামাজিক পারস্পেক্টিভে এটি একটি নিয়মেই পরিনত হয়েছে। এই প্রেক্ষিতের কারণেই ভীড় বেশী হলে চ্যাচামেচি, হাঙ্গামা, উচ্চ বাচ্য- এ সবের মাত্রাটিও যে বেড়ে যাবে- এটিতে কোনও সন্দেহ নেই- যা আমরা সবাই জানি এবং বুঝি। এবং এটি না জানার অথবা না বোঝার কোনো বিষয়ও নয়। এখন যদি আমরা সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকি তাহলে আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে প্রতারনা করবার পর্যায়ভুক্ত হবো। তাই বলে আমরা এমন কিছুও করতে পারি না যাতে বোঝা যেতে পারে- আমরা মোটেও সে ধরণের কিছু করছি না।
এত কিছু বলা হলো শুধু একটি কারণে যে- আমাদের সমাজে সময়ে সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা আমাদের নৈমিত্তিক জীবন প্রবাহের চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে একেবারে একাকার হয়ে গেছে। এই যে কোনও একটি ঘটনা কখনও ঘটে গেলেই ঘটনাস্থলে সাধারণ মানুষের ভীড় বেড়ে যাওয়া, হাঙ্গামা, চ্যাচামেচি, চিৎকার ইত্যাদির মাধ্যমে ঘটনাস্থলের পরিবেশটিকে একেবারেই নারকীয় পরিবেশে রূপান্তরিত করে ফেলা- এটি যেন আমাদের সামাজিক চরিত্রের একটি মজ্জাগত রূপের আকারে প্রতিষ্ঠিতি পেয়ে গেছে আপনা আপনিই। কিছু সময় আগে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি সে প্রতিষ্ঠিতির খুবই ছেট্টো আকৃতির একটি গৌণ দৃষ্টান্ত মাত্র। দুর্ঘটনা কবলিত মেয়েটিকে উদ্ধার করে তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করবার উদ্যোগ গ্রহণ না করে শুধু বিশৃক্সক্ষলা সৃষ্টিতেই যেন মেতে উঠেছে সবাই। ফলতঃ যা হচ্ছে তা মূলতঃ মেয়েটির যন্ত্রণা বৃদ্ধি।
এই হাঙ্গামা, চ্যাচামেচির মধ্যেই কে একজন প্রচণ্ড ভীড় ঠেলে মেয়েটির মাথার কাছে গিয়ে বসলো এবং ওর মাথাটিকে নিজের ডান বাহুর ওপর নিয়ে মেয়েটির মুখের দিকে তাকালো। মেয়েটি তখনও জ্ঞান হারায় নি, মোটমুটি স্বাভাবিক রয়েছে। লোকটিকে দেখে মেয়েটি বলে উঠলো-‘স্যার, আপনি এসেছেন!’ বোঝা গেলো মেয়েটি খুব বেশী আহত হয় নি এবং সবাই বুঝলো মেয়েটি লোকটিকে চেনে।
‘হ্যাঁ, এসেছি তো। দেখছো না তোমার মাথা আমার হাতের ওপর। চলো আমি তোমাকে তোমার বাড়ীতে পৌঁছে দেবো।’- এই বলে ভীড়ের মাঝে থাকা একজনকে উদ্দেশ্য করে বললো- ‘একটি রিকশা ডেকে দিন তো প্লিজ। আমি ওর স্কুলের শিক্ষক। আমি ওকে ওর বাসায় নিয়ে যাচ্ছি।’- শিক্ষকটির কথা সবাই বিশ্বাস করলো এবং আশ্বস্ত হলো এই ভেবে যে- যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেলো। একজন শিক্ষক তার স্কুলের আহত ছাত্রীকে ওর নিজের বাড়ীতে পৌঁছে দেবে- এতে আর কারও কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবার প্রশ্নই ওঠে না। ইতিমধ্যে একটি রিকশা এসে দাঁড়ালো ওদেরকে নিয়ে যাবার জন্যে। শিক্ষকটি মেয়েটিকে আগে রিকশায় তুলে দিয়ে নিজে গিয়ে ওর পাশে বসলো। রিকশাটি গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলটি ভীড়শুন্য হয়ে গেলো।
০৫.
‘হ্যাঁ, তুমি বিশ্রাম নিতে নিতে আমার হাতের কাজটুকুও শেষ হয়ে যাবে। এই টুকু সময়ের জন্যে তোমার বাবা মা অস্থির হবেন না। চলো।’- মেয়েটিও আর কিছু বললো না। রিকশা থেকে নেমে স্যারের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলো। একটু পরেই ওরা পৌঁছে গেলো স্যারের বাসায়। বাসায় পৌঁছেই স্যার ওর ঘরটি খুলে মেয়েটিকে একটি চেয়ারে বসতে বলে ঘরের জানালা দু’টি খুলে দিয়ে ওকে বললেন- ‘তুমি বসো, আমি তোমার জন্যে জেল আর ওষুধ নিয়ে আসছি।’- স্যার বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। বাড়ীতে কাউকে না দেখে মেয়েটি যেন কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। টেবিলে রাখা দু’একটি বই নিয়ে নাড়াচাড়া করলো আর কি যেন ভাবতে থাকলো। এভাবে কিছু সময় কে*টে যাবার পর স্যার ওষুধ নিয়ে ফিরে এলেন। মেয়েটিকে বললেন- ‘এই নাও, বাম হাতের যেখানে আঘাত পেয়েছো সেখানে এই জেলের খানিকটা লাগিয়ে দাও। দু’মিনিটের মধ্যেই ব্যাথা কমে যাবে। আর এই পাতাটি থেকে একটি ট্যাবলেট খেয়ে নাও পাঁচ মিনিটের মধ্যেই একেবারে সুস্থ্য হয়ে উঠবে।’- স্যার টেবিলে রক্ষিত পানির জাগ থেকে এক গ্লাস পানি গ্লাসে ঢেলে ওর হাতে দিলেন এবং পাতা থেকে একটি ট্যাবলেট নিয়ে ওর হাদেয়ে বললেন- ‘খেয়ে নাও।’- মেয়েটি আর কিছু না বলে ট্যাবলেটটি খেয়ে নিলো। এরপর মেয়েটি জেলের টিউব থেকে ডান হাতের অঙ্গুলের ডগায় সামান্য একটু জেল নিয়ে বাম হাতের কনুইতে ধীরে ধীরে ঘষতে লাগলো। এবার স্যার বললেন- ‘তুমি বিশ্রাম করো, এর মধ্যে আমি আমার কাজটুকু সেরে নিই।’- বলে স্যার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ট্যাবলেটটি খাবার পর ধীরে ধীরে মেয়েটির চোখে ঘুম নামতে শুরু করলো। ও যেন কেমন নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকলো। এভাবে সামান্য সময় কে*টে যাবার পর মেয়েটি আর চেয়ারে বসে থাকতে পারলো না। চেয়ারের পাশেই স্যারের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। সামান্য সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেলো মেয়েটি। ঠিক এ রকমের একটি পরিবেশের জন্যেই বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করছিলেন ওর শিক্ষকটি। শিক্ষকটি যখন ফিরে এলেন তখন দেখলেন অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন মেয়েটি। বালিশে মাথা রেখে ডান কাত হয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে মেয়েটি। শিক্ষকটি ওর কাছে গেলেন। ওর চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হলেন- মেয়েটি গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। অনেকক্ষণ মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন শিক্ষকটি। ঘুমন্ত অবস্থায় মেয়েটি যে এত সুন্দর হতে পারে স্বাভাবিক অবস্থায় বুঝতে পারেন নি তিনি। উত্তেজিত হয়ে পড়লেন ভীষণভাবে। খুব দ্রুত মেয়েটিকে চিৎ করে শোয়ালেন এবং বিছানায় উঠে ওর পাজামার ফিতে খুলে ফেললেন। তারপর যা হবার তাই ঘটতে শুরু করলো মেয়েটির ওপর। পাগলের মতো মেয়েটিকে নিষ্পেষিত করতে করতে শুরু করলেনে শিক্ষকটি। শেষের দিকে প্রচণ্ড যন্ত্রনায় মেয়েটির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ খুলেই দেখলো ওর ওপর ওর স্যার। মেয়েটি আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে শুধু বললো- ‘স্যার আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে ছেড়ে দিন।’- দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁটটি কামড়ে ধরে নিজের দু’হাত দিয়ে নিজের মুখটি ঢাকলো মেয়েটি। কিছু সময় পর ওর দেহের ওপর থেকে নেমে এলো ওর স্যার- যিনি কিনা ক্লাসের সব ছাত্রীকে অবিরত আদর্শবতী হবার উপদেশ বিতরণ করে থাকেন!
মেয়েটির ওপর থেকে নেমে চেয়ারে বসে কতকটা নির্দেশ দেবার ভঙ্গিতেই বললেন শিক্ষকটি- ‘শোনো, যা হবার তা-তো হয়ে গেছে। এখন এসব নিয়ে ভেবে আর কোনো লাভ নেই। যে ঘটনাটি ঘটলো এ সম্পর্কিত একটি কথাও তুমি কাউকে বলবে না। আমি সবকিছুর ছবিই মোবাইলে তুলে নিয়েছি। ঘটনাটি তুমি প্রকাশ করলে এই ছবিগুলি আমি ফেসবুকসহ সব Social Media- তে প্রকাশ করে দেবো। আর তোমার বাবা মা যদি রাজী থাকেন তাহলে আমি তোমাকে বিয়ে করবো।’-এ কথাগুলি বলে বাথরুম থেকে কয়েক টুকরো টিস্যু এনে মেয়েটির হাতে দিয়ে বললেন- ‘আমি বাইরে যাচ্ছি, এই টিস্যুগুলি দিয়ে সব মুছে নাও। বাইরে থেকে এসেই আমি তোমাকে নিয়ে তোমাদের বাড়ীতে যাবো। আর আমি একটু আগে তোমাকে যা যা বলেছি সে সব কথার একটিরও যের নড়চড় না হয়। হলে ক্ষতি তোমারই হবে। বুঝতে পারলে তো আমি কী বললাম?’- মেয়েটি কোনো কথাই বললো না। শিক্ষকটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। একই সাথে নির্দ্ধারিত হয়ে গেলো বিন্দির ভাগ্য। চিরদিনের মতো নষ্ট হয়ে গেলো বিন্দি। অনেকটা সময় ধরে কি যেন ভাবতেই থাকলো বিন্দি। দৃষ্টি শুন্য আকাশের দিকে স্থির। জানালা দিয়ে যেটুকু আকাশ দেখা যায় সে টুকুর দিকে তাকিয়ে অবিরাম ভেবে চললো বিন্দি। এক সময় স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলো। কারণ ও এতক্ষণ ভেবে ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে- ঘটনাটির কথা ও কাউকেই বলবে না। বান্ধবীদেরকে তো নয়ই এমন কি বাবা মা’কেও না। তবে ওই শিক্ষককে ও কখনই ক্ষমা করতে পারবে না। প্রতি*শোধ ও নেবেই। চরম প্রতি*শোধ- যে প্রতি*শোধের জ্বলন্ত আগুনে শিক্ষক নামের ওই জানোয়ারটি জ্বলে জ্বলে ছাই হয়ে যাবে। বিন্দির জীবন তো শেষ হয়ে গেছে কিন্তু ওই শিক্ষকের জীবনও আর বাঁচবে না- এটি বিন্দির আত্ম-শপথ, চুড়ান্ত অঙ্গিকার। যে অঙ্গিকার, যে শপথ থেকে এক বিন্দুও সরে আসবার অবকাশ নেই বিন্দির কাছে।
ফিরে এলেন শিক্ষকটি। এসেই বিন্দিকে বললেন- ‘তুমি কি তৈরী? চলো।’
‘হ্যাঁ স্যার, চলুন। আমি কাউকেই কিছু বলবো না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।’- বিন্দির এ কথা শুনবার পর শিক্ষকটি কেমন যেন একটি দ্বিধা দ্বন্দে পড়ে গেলেন। ভাবলেন- এত দ্রুত এত স্বাভাবিক হলো কি করে মেয়েটি। অন্য কোনো দূরভিসন্ধি নেই তো। তাড়া দিলো বিন্দি- ‘কই স্যার চলুন, দাঁড়িয়ে পড়লেন যে?’
‘হ্যাঁ, চলো।’- দু’জনই বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেলো বিন্দির বাড়ীতে। বিন্দিকে ওর বাড়ীতে পৌঁছে দিয়ে শিক্ষকটি চলে গেলেন ওর নিজের কাজে। যাবার আগে বিন্দি শিক্ষকটিকে বললো- ‘স্যার আমি আমার কথা রাখবো। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।’- বলেই বিন্দি বাড়ীর ভেতর প্রবেশ করলো।
০৬.
ইতিমধ্যেই কে*টে গেছে বারোটি বছর। এই বারো বছরে যমুনা দিয়ে অনেক পানি গড়িযে গেছে। বিন্দি স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়েয়র সীমানা পেরিয়ে এসেছে। ও ভালো রেজাল্ট নিয়ে অনার্সসহ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেছে। বাবা পদোন্নতি পেয়ে শিক্ষা সচিবের কার্যালেয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে যোগদান করেছেন। সংসারের মলিন আবরনটি সরে গিয়ে উজ্বল ধবধবে সফেদ আকার ধারণ করেছে। বাবা মায়ের অন্তরালে একটি মৃদু উষ্ণ সুখের আবেশ তৈরী হয়েছে- যা ওদের কথা বার্তায় এখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরই সূত্র ধরেই বোধকরি বাবা মা কন্যার বিয়ে দেবার জন্যে উপযুক্ত টাত্রের অনুসন্ধান করছেন। কিন্তু বাবা মা ওকে সে বিষয়টি অবহিত করলেও বিন্দি অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বিয়ে করতে চায় নি ও। মা ওকে বিষয়টি ভেবে দেখবার জন্যে কয়েকবার বললেও বিন্দি একই কথা বলেছে। এরপর বাবা মা-ও আর ওর সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু বলে নি আর ওর সিদ্ধান্তের বিরোধিতাও করে নি। ষষ্ঠ শ্রেনিতে অধ্যয়ন কালীন ওর জীবনে যে ঘটনাটি ঘটে গেছে সেটি ও কখনই ভুলতে পারে নি। স্কুল জীবন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করবার সময়েও ও সব সময়ের জন্যেই চরম বিষণ্ন থেকেছে। স্কুল জীবনের বান্ধবীদের সঙ্গে স্বাভাবিক আঁচরণ করলেও কোনো বান্ধবী ওকে কোনো প্রশ্ন না করলে ও কোনো কথা বলে নি। বিশ্ববিদ্যালয়েও তাই। বাড়ীতে বাবা মায়ের সাথে যেটুকু কথা না বললেই নয় শুধু সেটুকুই বলেছে। আর সব সময় থেকেছে পড়ার টেবিলে। মা বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন। জিজ্ঞাসাও করেছিলেন ওকে- ‘কিরে বিন্দি তুই এখন এত চুপচাপ থাকিস কেন? আগে তো এমন কখনও ছিলি না। কোনো সমস্যা হয়েছে।’- উত্তরে বিন্দি বলেছে- ‘মা পড়াশুনার ভীষণ চাপ। আমাতে ভালো রেজাল্ট করতে হবে। শুধু এটুকুই তোমরা মাথায় রেখো।’¬- আর কিছু ও বলে নি। মা-ও এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করে নি।
কলেজ জীবনেই বাবার অনুমতি নিয়ে কার ড্রাইভিংটি শিখে নিয়েছে। একটি বিশেষ জিদ ওর ভেতর সব সময়ের জন্যে ক্রিয়াশীল থেকেছে যে, গাড়ী দুর্ঘটনার কারণেই ওর জীবনের সর্বোচ্চ সর্বনাশটি ঘঠেছে। এটি না ঘটলে ওর জীবনটি হয়তো সুস্থ্য থাকতে পরতো। ও যখন মাষ্টার্স ডিগ্রী অর্জন করে তখন বাবার কাছে একটি কার কিনে দেবার অনুরোধ করেছিলো। তবে এখুনি না। ওর যখন কোনো ভালো চাকুরী হবে তখুনিই বাবা যেন ওকে একটি কার কিনে দেয়। বাবা ওর চাওয়াটি শুনে খুশিই হয়েছিলেন। বলেছিলেন- ‘তুই আমার একটি মাত্র সন্তান। আর তোর কোনো চাওয়াকে আমি অপূর্ণ রাখবো- ভাবলি কি করে?’- বিন্দি বাবার সম্মতি প্রাপ্তিতে খুশি হয়েছিলো। ওর ইচ্ছে ও নিজের গাড়ীতে চড়ে ওর অফিসে যাবে এবং অফিস থেকে ফিরে আসবে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকা কালীন বাবা শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সচিবের অধীনে উচ্চমান অফিস সহকারীর পদে কর্মরত ছিলেন। তখন ওর আর্থিক সচ্ছলতা আজকের মতো ছিলো না। তাই বিন্দিকে পায়ে হেঁটে অথবা কখনও কখনও রিকশায় চড়ে স্কুলে যাওয়া আসা করতে হতো। আর এখন ওর বাবা শিক্ষা মন্ত্রনালয়েরই এ্যাডিমিনিন্সট্রেটিভ অফিসার- একটি সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত। এখন ওর অনেক সচ্ছলতা। তাই একমাত্র মেয়েকে একটি ছোট্র কার কিনে দেয়া ওর পক্ষে মোটেই কোনো সমস্যা হিসেবে মনে হয় নি ওর কাছে। সে কারণেই কন্যার এটুকু চাওয়াকে অগ্রাহ্য করতে চায় নি পিতা। মা দুর্ঘটনার করণ দেখিয়ে মৃদু আপত্তি জানালেও বাবার সম্মতিটিই টিকে গেছে শেষ পর্যন্ত। এরপর বিন্দি মায়ের গ*লা জড়িয়ে ধরে বলেছে- ‘আচ্ছা মা তোমর মেয়ে গাড়ীতে করে অফিসে যাবে, অফিস থেকে বাড়ীতে ফিরে আসবে- তোমার ভালো লাগবে না?’
‘ভালো তো লাগবেই। কিন্তু এই ভালো লাগা কোনো দুর্ঘটনার কবলে পড়ে যদি চুরমার হয়ে যায়- আমার আশঙ্কাটি সেখানেই।’- মায়ের কথা শুনে বিন্দি মা’কে শান্তনা দিয়ে বলেছে- ‘মা, পুরুষদের চাইতে মেয়েরা অনেক সতর্কতার সাথে গাড়ী চালায় এবং খুব ভালোভাবেই চালায়। তোমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণই নেই। তুমি দেখে নিও।’- আর কিছু বলে নি বিন্দি। সোজা নিজের শোবার ঘরে চলে গেছে।
মাষ্টার্স ডিগ্রীটি অর্জনের ছ’মাসের মাথায় ওদের জেলার বাইরের একটি উপজেলার সরকারী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক পদে ওর একটি চাকুরী হয়েছে। বাবা মা ভীষন খুশি হয়েছেন। বাবা ওর মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের নির্দিষ্ট ফাণ্ড থেকে কিছু টাকা ঋণ গ্রহণ করে মেয়ের জন্যে একটি ছোটো আকারের কার কিনেছেন। সেই কারটি ড্রাইভ করেই বিন্দি প্রথম গিয়েছে সেই কলেজে ওর পদে যোগদান করতে। কলেজের প্রিন্সিপাল থেকে শুরু করে সকল শিক্ষক শিক্ষিকা ওকে সাদরে বরণ করে নিয়েছে। বরণ করবার পালা শেষে অধ্যক্ষের কক্ষেই কিছু লাইট ফুডের Arrenge-করেছিলেন অধ্যক্ষ নিজেই। সবাই মিলে বসে ছিলেন অধ্যক্ষের টেবিলের চারপাশ জুড়ে। সবাই যখন খেতে শুরু করেছে ঠিক তখুনি একজন শিক্ষক এসে প্রবেশ করলেন অধ্যক্ষের কক্ষে। প্রবেশ করেই একটি চেয়ারে বসলেন। শিক্ষকটি বিন্দিকে লক্ষ করেন নি। কিন্তু বিন্দি ওকে লক্ষ করেছিলো। প্রথম ওকে এখানে দেখেই চমকে উঠেছিলো বিন্দি। তবে সামান্য সময়ের জন্যে। তারপর সামলে নিয়েছিলো নিজেকে। এই লোকটি সেই শিক্ষক যে ওকে ষষ্ঠ শেনিতে অধ্যয়নকালীন শিক্ষকটির নিজের ঘরে ওকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে জোর করে ধ** করেছিলো। খুবই স্বাভাবিকভাব নিজের চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে প্রশ্ন করেছিলো ওই শিক্ষকটিকে- ‘স্যার, আপনি এই কলেজে? কবে জয়েন করেছেন?’- প্রশ্নটি করেই শিক্ষকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো বিন্দি। শিক্ষকটিও ওকে চিনে ফেলে কিছুটা বিব্রত হয়ে উত্তর দিয়েছিলো- ‘এই তো এক মাস আগে। স্কুলের চাকুরীটি ছেড়ে দিয়ে এই কলেজে জয়েন করেছি। তা তুমি কবে?’- ওর প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলো বিন্দি ‘এই তো স্যার আজকেই। ঠিক আছে স্যার চলুন এবার সবাই মিলে খেয়ে নিই।’- একেবারেই স্বাভাবিক বিন্দি। অতীতে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনাটির কোনো চিহ্ন মাত্রই নেই ওর আঁচরণে। বিন্দির এ আঁচরণে শিক্ষকটিও সম্ভবতঃ কিছুটা আশ্বস্ত হলো এই ভেবে যে, যাক বিন্দি যে কথাটি ওকে দিয়েছিলো সেটি পালন করেছে পূরো মাত্রায় শতভাগ। খাবার পালা শেষ হলে অধ্যক্ষ সব শিক্ষক শিক্ষিকার সাথে বিন্দির পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয় পর্ব শেষে যে যার ক্লাসে শিক্ষকরা চলে গেলেন। শুধু বিন্দি অধ্যক্ষের আনুমতি নিয়ে আজকে আর ক্লাসে গেলো না। গাড়ীটি ষ্টার্ট করে যাত্রা করলো বাড়ীর দিকে। সারা রাস্তায় গাড়ী চালাতে চালাতে শুধু একটি বিষয়ই চিন্তা করলো- যাক এতদিনে হাতের মুঠোর ভেতর পাওয়া গেছে শিক্ষক নামের ওই জানোয়ারটিকে। এ সুযোগটি কিছুতেই মিস্ করতে পারবে না বিন্দি। ওর নিজের অঙ্গিকার পূরণ করতে হবে এবার।
০৭.
ওদের দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবার পর একদিন ওই শিক্ষকটি বিন্দিকে ওর গাড়ীতে করে শিক্ষকটির কাক্সিক্ষত গন্তব্য স্থানে পৌঁছে দেবার অনুরোধ করলে বিন্দি ওকে গাড়ীতে তুলে নেয়। গাড়ীতে বসেই শিক্ষকটি বিন্দির সঙ্গে কথা বলে- ‘আমি তোমাকে একটি কথা বলতে চাই।’- এ কথার উত্তরে বিন্দিও স্পষ্ট করে বলে- ‘হ্যাঁ স্যার বলুন, কি বলবেন?’- কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিন্দি কঠিন থেকে কঠিনতর হতে থাকে- যা শিক্ষকটির ধারণা করবার কথা নয়। বিন্দির আশ্বাস পেয়ে শিক্ষকটি সরাসরি বিন্দির কাছে একটি প্রস্তাব রাখে- ‘আমি এখনও বিয়ে করি নি। অবিবাহিতই রয়ে গেছি। তোমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।’- এ কথা শুনবার পর বিন্দি অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে এবং ঠাণ্ডা মাথায়- ‘আমার বিয়ে নিয়ে আমি এখনও ভাববার সুযোগই পাই নি। তাই এখন এ প্রসঙ্গটি নিয়ে কথা না বলাই ভালো। চলুন আপনি কোথায় যেন নামবেন বলেছিলেন?’
‘হ্যাঁ, সামনের বাম দিকে পার্ক করলেই হবে।’- বিন্দি গাড়ীটি রাস্তার বাম দিকে থামিয়ে দিলো। শিক্ষকটি গাড়ী থেকে নেমে গেলেন। বিন্দি সরাসরি ওর বাড়ীর দিকে যাত্রা শুরু করলো।
০৮.
এর মধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে আরও চার বছর। এই চার বছরের মধ্যে দু’বছরের মাথায় ওর বাবার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর আগে ওর বাবা ওর মা’কে বলে গিয়েছিলেন- ‘বিন্দির মামলা রায় যা-ই হোক রায় ঘোষনার পর তুমি শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সচিব এনায়েতুর রহমানের সঙ্গে অত্যন্ত গোপনে তাঁর বাসায় দেখা করবে। আমি ওঁকে সবকিছু বলেছি, তুমি শুধু দেখা করবে। আর উনি যে পরামর্শ দেবেন সেই পরমর্শ অনুযায়ী তুমি ব্যবস্থা নেবে।’- এর বাইরে আর কোনো কথা বলে নি বিন্দির বাবা বিন্দির মা’কে।
চার বছর পর ওই হত্যা মামলার রায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে ঘোষনা করা হলো। এই রায় ঘোষনার পর এখন শুধু মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করবার পালা। মৃত্যু দণ্ডটি যতটা না কঠিন তার চাইতেও শতগুন বেশি কঠিন নিশ্চিত মৃত্যু ক্ষণটির জন্যে অনিদ্রায় অর্দ্ধহারে প্রহরের পর প্রহর গুনে চলা।
০৯.
আজ ১৭ মার্চ। বিন্দির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের শেষ দিন। রাত বারোটার আগেই বিন্দির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। আইন অনুযায়ী মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি প্রকাশিত হবার পর ২১ দিনের আগে নয় এবং ২৮ দিনের পরে নয়- এর মধ্যেই রায় কার্যকর করতে হবে। সে হিসেবে ২৮ দিনের সর্বশেষ দিনটি আজকের রাত্রি বারোটা পর্যন্ত। জেল কর্তৃপক্ষ সেভাবেই আজ রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে রায় কার্যকরের সময় নির্ধারণ করেছে- যা সময় মতো আসামিকে জানিয়েও দেয়া হয়েছে। আসামিও মানসিক দিক থেকে চুড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েও রেখেছে। আজকের রাত্রিটিই বিন্দির জীবনের শেষ রাত্রি। তবে বিন্দি সন্তুষ্ট একটি মাত্র কারণে- যে ব্যক্তিটি বিন্দির জীবনের অঙ্কুরটিকেই ধ্বংশ করে দিয়েছিলো বিন্দিও তার জীবনটিকে পৃথিবীর চিত্রপট থেকে মুছে দিথে সক্ষম হয়েছে। এটিই বিন্দির জীবনের সবচাইতে বড় প্রাপ্তি। আর কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই বিন্দির।
ঘড়ির কাঁটায় ঠিক রাত দশটা। কণ্ডেম সেল থেকে বের করে আনা হলো বিন্দিকে। মহিলা রক্ষিদের তত্বাবধানে একটি প্রশস্ত বাথরুমে ওকে গোসল করানো হলো। গোসল শেষে ওকে বাথরুম থেকে বের করে এনে ওকে দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করতে বলা হলো। বিন্দি নামাজ পড়লো। এরপর জেলখানা মসজিদের ঈমাম বিন্দিকে তওবা পড়ালেন। এসব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। ফাঁসি কার্যকর করবার নির্দিষ্ট সময় কাছাকাছি এসে পড়লো। ওর দু’হাত পেছনে বাঁধা অবস্থায় ওকে ফঁসির মঞ্চে নিয়ে আসা হলো চোধ দু’টি কালো কাপড়ে ঢেকে দিয়ে। রাত্রি ১১টা বেজে চল্লিশ মিনিট। বিন্দিকে ফাঁসির মঞ্চে তোলা হলো। মঞ্চে তুলবার পর ওর পা দু’টিও খুব শক্ত করে বেঁধে দেয়া হলো। মাথায় লম্বা কালো টুপি পরিয়ে মাথা মুখ ঢেকে দেয়া হলো। নিয়ম অনুযায়ী মঞ্চের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছেন আই জি প্রিজন, ঢাকা জেলা প্রশাসক, কারাগারের জেলার, সিভিল সার্জন, দু’জন ম্যাজিষ্ট্রেট, মসজিদের ঈমাম সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। জল্লাদ বিন্দির গ*লায় ফাঁ*সির রজ্জু পরিয়ে দিলো। এখন শুধু ফাঁসির রজ্জুর অপর প্রান্ত যে লিভারটির সঙ্গে যুক্ত জল্লাদ কর্তৃক সেটিকে টেনে দেয়ার অপেক্ষা। জেলারের হাতে রক্ষিত রুমালটি মাটিতে ফেলে দেবার সঙ্গে সঙ্গে লিভারটি টেনে দেবে জল্লাদ। আর তখনই বিন্দির দেহটি পড়ে যাবে প্রায় বিশ ফুট গভীর একটি পাকা কুয়োর ভেতর। পড়ে গিয়েই ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলতে থাকবে বিন্দির দেহ- যতক্ষণ না ওর মৃত্যু নিশ্চিত হয়। জেলার বার বার ঘড়ি দেখছেন আর অপেক্ষা করছেন নির্দিষ্ট সময়টির জন্যে। আর ঠিক সে মুহূর্তেই আই জি প্রিজনের মোবাইল ফোনটি বেজে উঠলো। আই জি প্রিজন ফোনটি কানে ধরলেন। সামান্য কথা বলবার পর ফোনটির সুইচ অফ করে দিয়ে আই জি প্রিজন সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন- ‘ মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মহোদয় এখুনি এখানে এসে পৌঁছুবেন। ততক্ষণ আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে। আপনারা সবাই চেয়ারে বসুন।’- কেউ কোনো কথা না বলে চেয়ারে বসে পড়লেন। এর মধ্যেই কারাগারের মূল ফটকটি খুলে দেয়া হলো। দু’টি সাদা রংয়ের গাড়ী এসে কারাগারে প্রবেশ করলো। গাড়ী দু’টি থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীসহ চার জন নেমে সোজা ফাঁসির মঞ্চে চলে এলেন। মন্ত্রী মহোদয় আসবার সঙ্গে সঙ্গে সবাই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। দাঁড়ানো অবস্থাতেই মন্ত্রী মহোদয় একটি লম্বা সাদা খাম আই জি প্রিজনের হাতে দিয়ে বললেন- ‘চিঠিটি সবাইকে পড়ে শোনান।’ - আই জি প্রিজন চিঠিটি পাঠ করতে শুরু করলেন-
‘সংশ্লিষ্ট মামলাটির সার্বিক Case History- পাঠ এবং পর্যালোচনা করে, অপরাধ ঘটানোর বিষয় ও কার্যকারণ বিবেচণা এবং আসামির ওপর যে ধরণের অপরাধ ঘটানো হয়েছে সে সবের কারণ অনুসন্ধান এবং চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সংবিধানের Article-49 -৪৯-এর বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে প্রদত্ত ক্ষমতা বলে এই মামলার আসামি- ‘লতিকা আইবেক বিন্দি’র অপরাধকে ক্ষমা করে উক্ত মামলার দায় থেকে অব্যাহতি প্রদান পূর্বক নিঃশর্ত মুক্তি প্রদান করা হলো। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।’
স্বাক্ষর-
রাষ্ট্রপতি,
গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
চিঠিটি পাঠ করা শেষ হলে আই জি প্রিজন বিন্দিকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামিয়ে আনবার নির্দেশ দিলেন জল্লাদকে। জল্লাদ বিন্দির হাত, পা এবং চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে এবং মাথার কালো টুপি খুলে ফেলে বিন্দিকে সবার সামনে নিয়ে এলো। বিন্দি সবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সবাইকে সালাম প্রদান করলো। সবাই সালাম গ্রহন করলেন। প্রথমেই বিন্দিকে লক্ষ করে কথা বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী- ‘আপনাকে অভিনন্দন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আপনার অপরাধকে ক্ষমা করে আপনাকে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদান করেছেন। এখন আপনি সম্পূর্ণ মুক্ত।’- আর কিছু বললেন না মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এবার কথা বললেন আই জি প্রিজন- ‘আপনি মুক্ত। তবে আজকের বাকী রাতটুকু আপনাকে এখানেই থাকতে হবে। এটি আইন এবং নিয়ম। রাত্রিতে কোনো আসামিকে মুক্তি দেবার বিধান নেই।’- বলে জেলারকে কয়েকটি নির্দেশনা দিলেন। যার মধ্যে মুখ্যটি হলো বিন্দিকে কনডেম সেলের পরিবর্তে অন্য একটি কক্ষে বিছানাপত্র দিয়ে ওর শোবার ব্যবস্থা করণ। এরপর জেলার ওকে একটি চেয়ারে বসতে বলে সবাইকে নিয়ে নিজের অফিস কক্ষে নিয়ে গেলেন।
১০.
অবশিষ্ট রাতটুকু বিন্দির চোখে আর ঘুম এলা না। একদিকে আনন্দের উত্তেজনা আর একদিকে সমাজের চোখে ওর একটি ভিন্ন প্রতিচিত্র ফুটে ওঠা। তার পরেও ওর শান্তনা- ও এমন একটি কাজ করেছে যে কাজটি সমাজে বসবাসকারী মানুষজনের মূল্যবোধের অভ্যন্তরে আলোড়ন তুলবার জন্যে এতটুকু হলেও বিশেষ একটি শক্তির মাত্রা সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। সেই শক্তির মাধ্যমে মানুষের মূল্যবোধ উর্দ্ধায়িত হতে পারবে।
ভোরের আজান শেষ হয়েছে। ধীরে ধীরে পূর্ব দিগন্ত রক্তিমাভা ধারণ করতে শুরু করেছে। কারাগারের সব কয়েদি এবং হাজতিকে কারাগারের মাঠে লাইন আপ করে দাঁড় করানো হয়েছে। বিন্দির কক্ষের দরোজা খুলে দেয়া হয়েছে। বিন্দি কক্ষের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। ওর মুক্তির যাবতীয় কাগজপত্রে গত রাত্রেই ওর স্বাক্ষর নিয়েছেন জেলার সাহেব। আজকে ওর করণীয় কোনো আনুষ্ঠানিকতা অবশিষ্ট নেই। বারান্দা থেকে নীচে নামবার জন্যে পা বাড়িয়েছে বিন্দি এমন সময় একজন সেন্ট্রি এসে বিন্দিকে জেলার সাহেবের অফিস কক্ষে যাবার জন্যে অনুরোধ জানালো। বললো- ‘জেলার সাহেবই আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে নিয়ে যাবার জন্যে। আমার সঙ্গে আসুন, আমিই নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে। আপনার মা-ও এসেছেন।’- আর কিছু না বলে দু’জনই হাঁটতে শুরু করলো জেলারের অফিসের দিকে।
বিন্দি জেলারের অফিস কক্ষে প্রবেশ করতেই মা মেয়ে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে। কেউ কাউকে কোনো কথাই বলতে পারে নি। শুধুই কেঁদেছে। আবেগ কিছুটা থিতিয়ে এলে জেলার বিন্দিকে ডেকে কাছে নিয়ে বলেছে-‘এবার তোমার মায়ের হাতটি শক্ত করে ধরে বাড়ী ফিরে যাও। তুমি এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। তুমি প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের একটি জীবন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে মা। মানুষ তোমাকে মনে রাখবে।’
জেলারকে সালাম জানিয়ে মায়ের হাত ধরে কারাগারের সামনের খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়ালো ওরা দু’জন। দীর্ঘ চার বছরের কারাবাস শেষে আজ প্রথম মুক্ত আলো হাওয়ায় একেবারে স্বাধীনভাবে প্রাণপূর্ণ একটি শ্বাস বুক ভরে গ্রহণ করলো বিন্দি। তারপর তাকালো আকাশের দিকে। তাকিয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। এক সময় দৃষ্টি নামিয়ে মায়ের চোখে চোখ রেখে বললো- ‘মা, আমার ওপর যে অত্যা*চার করা হয়েছে, যে অপরাধ করা হয়েছে সে অত্যা*চার আর অপরাধের যথাযথ জবাব দিতে গিয়ে সমাজের চোখে আমিও একটি অপরাধ করেছি। কিন্ত আমার কৃত সে অপরাধটি আমার ওপর সংঘটিত আর দশটি সে ধরণের অপরাধের পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে- এটি আমি বিশ্বাস করি এবং এটিই আমার শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। চলো।’-একটি সুপ্রভাতের সূচনা করে মায়ের হাত ধরে বাড়ীর দিকে পা বাড়ালো বিন্দি।