সায়াহ্নে শ্রীমতির শশুর বাড়িতে আসা আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে অনেকে চলে গেলেন। সবার তো সংসার আছে, তাই আর কতদিন থাকবেন। উঠোনের পাশে শক্ত মাটি দিয়ে উঁচু করে বাঁধানো তুলসী গাছের নিচে সন্ধ্যা বাতি দিয়ে শ্রীমতি গেলেন শশুরকে প্রনাম করতে। শশুর মশাই বৌমাকে থামিয়ে দেয়ে বললেন,
— মাগো, এলা তোমার বিয়ে হইছে, তাই এলা তোমার সব কাজোত স্বামীক আগোত পেননাম করবেন। যাও, আগোত শ্রীমানকে পেননাম কর।
— কিছু জানি নে বাবা, তাই ভুল হয়া গেইছে। মাপ করি দেন।
শশুরের কথামতো শ্রীমতি স্বামীর কাছে গেলেন প্রণাম করতে। এরপর একে একে বাড়ির সকল বয়োজেষ্ঠ্যদের প্রণাম করলেন। নতুন বৌমার এমন ভক্তি দেখে শশুর মশায়ও বেজায় খুশি। তাই নিজে প্রণাম পাওয়ার সময় কথাটা মনে চেপে না রেখে মধুর কন্ঠে বললো—
— বাঁচি থাকো মা। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুক।
শশুরের কথা শুনে শাশুড়িও বৌমার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করলো। শাশুড়ি মায়ের আশীর্বাদ কালে শ্রীমতি বললো—
— মা, এলা তো রান্না করা নাগবে, তা কতগুলে চাউল নোমো, আর তরকারি কিসের করমো ?
বাড়িতে মোটে খাওয়ার মানুষ ছয়জন। আগে ছিল পাঁচজন, কিন্তু শ্রীমতি আসায় একজন বেড়ে গেছে। সে চিন্তা মাথায় রেখে শাশুড়ি বললো,
— স্যের খানিক নেও। আর কদ্দিন থাকি তো আমিষে খাবার নাগছি, আইজ একনা নিরেমিষ রান্না করো।
শ্রীমতিও সে কথায় সায় দিল। হঠাৎ শ্রীমান, মাকে উদ্দেশ্য করে বললো—
— মা বাজারোত যাবার নাগছোং, কিছু কি আনা নাগবে..?
কথাটি মাকে বলার অবশ্য কারনও আছে। নতুন বউ, তাই তাকে বলার সাহসটা হলো না। মা উত্তর দিলো—
— মুই আর কি কং বাবা। এলা তো রান্না ঘর সামলাবার মানুষ হইছে। ওমাকেই সব কবু।
নতুন বউকে কিছু বলার সাহস না থাকায় নিঃশব্দে চলে গেলে শ্রীমান। ছেলের এ কান্ড দেখে মা বৌমাকে বললো—
— বৌমা, ওয় তো কিছু কইলো না। তোমরা নিজে থাকি ওক একনা কবেন, কি কি আনা নাগবে। আর একটা কতা মনে আকেন। হামার তো অভাবের সংসার, সউগকিছু দেকি শুনি করেন।
— মা, তোমরা যা করবের কইবেন, মুই তাই করিম। আর সউগ কিছু তো তোমার গুলের.....অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বললো শ্রীমতি।
— ঠিক আছে বৌমা, এলা রান্না ঘরোত যাও।
শাশুড়ির কথা মত মুক ডাল আর কিছু সবজি ভাজি করে রাতের খাবার তৈরি করলো শ্রীমতি। অন্যদিন শ্রীমান বাজারে দেরি না করলেও আজ কেন জানি দেরি করছে। তাই সবাই যখন খেতে বসছে তখন শ্রীমানের মা একটু রাগের স্বরে বলে উঠলো—
— শ্রীমানটার কী এমন কাম বাজারোত, এলাও বাড়ি আইসে না। সবারে খাওয়া হইলো, ওর আসার কোনো নামগন্ধ নাই। নয়া বউটেও না খায়া আছে। কতক্ষেণ না খায়া থাইকপে ?
শ্রীমতি শাশুড়ি মায়ের এমন কথা শুনে বলে উঠলো,
— কোনো সমস্যা হবাননয় মা। তোমার বেটা আইসলে খামো এলা। তোমরা খায়া ঘরোত যাও।
শ্রীমতির একমাত্র দেবর একটু কথা কম বললেও আজকের এমন অবস্থা দেখে সেও বলে উঠলো—
— বৌদি তোমরা খাও তো। খায়া দায় দাদার খাবার ঘরোত নিয়ে যায়া থোন। যখন আসপে খাইবে এলা।
সবাই অনেক কিছু বললেও শ্রীমতি সেদিকে কোনো ভ্রম্নক্ষেপ করলো না। অনুরোধ করে শাশুড়ি মায়ের কাছে অনুমতি নিয়ে দুজনের খাবার নিয়ে ঘরে গেল। পেটে ক্ষুধা অনুভব করা গেলেও অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। কারন, সে যে তার প্রাণনাথ।