মোবাইলের ব্যবহারটা সেলা গ্রামে-গঞ্জে নাই কইলেও চলে। যে দুই একটা মোবাইল ছিল, তাও কতবা যোজন দূরোত। নেট দুনিয়ার কথা সেলা হয়তো বেশিরভাগ মানষিরে অজানা ছিল। তবে সাধারন মানষির যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে ছিল চিঠি-পত্র।
সেইবার হুলির সমায় দিনহরি হুলি খ্যালের গেইসে উয়ার দাদার শ্বশুড় বাড়ি। দাদার শালি মিতালি সেলা বয়সে খুব ছোটো। তবে উয়ার দাদার শালা হরেন ছিল উয়ার সমবয়সি। সগারে সাথে কোনেক হাসি-খুশি, আমোদ-ফুর্তিতে হুলি খেলাবে বুলি হুলির দিনে উমার বাড়ি যাবার কথা। কিন্তু হরেন পাড়ার চেংরাগিলার সাথে সকাল সকাল হুলি খ্যালের যাওয়াতে দিনহরি আর উয়ার নাগাল পাইল না। কাজে হুলি খ্যালের আইসাটা বেকার বুলি মনে হইল দিনহরির। কিন্তু মিতালি কইল, “চল দাদা, রামু দাদার বাড়ি হুলি খ্যালের যাই। উমার বাড়িত রিংকি দি আছে, শেফালি দি আছে, বিকাশ বনু আছে, উমার পাড়াত আরও মেল্লা দাদা-দিদি আছে হুলি খেলার মতন। হরেন দাদাও উমারে ওত্তি হুলি খ্যালের গেইসে।” ....কথাটা শুনি দিনহরির মনটা ফরফরা হইল, ওটে যুদি হরেনের দেখা পায় তাহলে হুলি খ্যালের পাবে।
দিনহরি রাজি হয়া কইল, “চল যাই। আর যুদি তোর হরেন দা ওটে না থাকে তাহলে ঘুরি চলি আসিমু কিন্তু।”
“হুমম, চল।”
দুইজনে চলি গেল। দিনহরি দেখা পাইল, তোতকোরি ফির হরেন রিংকির বাড়িত হুলি দিয়া ভূত হয়া বসি আছে। এমন সমায় দিনহরিক দেখিয়া রিংকি আনন্দে উল্লাই মাথা হয়া কইল, “আইসো হায়, দিনহরি আসিসে। উয়াক ধরি কোনেক কাদোত ধেদেরাই।” .... যেই না এংকরি কইল, ওমনি ঘর থাকি হিরহির করি প্রায় আট-দশজন চেংরি একসাথে হিরিস করি বিরি আসিল। দিনহরি দেখি তো অবাক ! যেহেতু হুলি খ্যালের আসিসে, পালেয়া তো লাভ নাই। তার জইন্য চুপ করি বসি থাকিল। কিন্তু দিনহরি কোনেক ধমক দিসে বুলি চেংরিগিলা আর কাহোয় উয়ার গোর যাবার সাহস পাইল না। কিন্তু হঠাৎ করি একজন পাছপাক হাতে ফটকরি কান্তাইর কাজল সইষ্যার ত্যাল দিয়া মাখি আনিয়া দিনহরির গালোত নাগেয়া ভূত বানে দিল। উয়ার ভূতের মতন চেহারা দেখি সগায় উমুলি উমুলি হাসি উঠেছে। কিন্তু যায় উয়াক কাজল নাগে দিল, তাক আর চিনির পাইল না। এমন সুন্দরী চেংরি এই পাড়াত ইয়ার আগোত আর কুনোদিন দ্যাখে নাই দিনহরি। গালোত, মাথাত হুলি নাগা আছে সুন্দরীর, কিন্তু তার মইধ্যতও উয়ার রূপের বাহার দেখি থাকির মতন। দুপুরে খাবার আগোত দিনহরি হুলি খেলা শ্যাস করি বাড়ি ফিরি আসিল।
গাও-পাও ধুইয়া দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শ্যাস করি হরেন আর দিনহরি বসি বসি গল্প করেছে। ফটকরি দিনহরি হরেনোক কইল, “চেংরিটা কায় রে হরেন ?”
“কুন চেংরি রে ?”
“রিংকিঘরের বাড়িত যায় মোক কান্তাইর কাজল নাগাইল।”
“ওহ, উয়ায়-- বিকাশ বনুর কাকার বেটি বইনি পারুল। বাপ-মাও নাই বেচারির, বিকাশ বনুরে বাড়িত মানষি হইসে। তোমারে ওত্তি ফুলবাড়িত বাড়ি। ক্যানে রে ?”
দিনহরি মুখকান উল্টাপাখে ঘুরি আস্তে করি কইল, “পছন্দ হইসে রে।”
“হয় নাকি ?”
“হুমম। বিয়াও করিবে নাকি পুছিস তো।”
“ধইস ! ফটকরি একটা চেংরিক এংকরি কোয়া যায় রে ! তার বদল তুই একটা কাজ কর, একখান চিঠি লেখি দে, মুই নিগি দিম।”
“হুমম, ঠিক কথা কসিত। মুই আজি চিঠি ল্যাখেছোং তাহলে। সইন্ধ্যার সমায় উমার ওত্তি ব্যারের যামু এলায়। তুই চুপকরি চিঠিখান উয়ার হাতোত দিয়া মোর কথা কইস।”
“হবে। তুই তাহলে ল্যাখ, মুই গোরুলাক নড়ে দিয়া আইসোং।” .... হরেন উঠিয়া চলি গেল। দিনহরি বসি বসি ভাবেছে, কি লেখিবে !
বিকালে বসি বসি দিনহরির চিঠি লেখা শ্যাস। সইন্ধ্যার সমায় পারুলোক চিঠি দিবার বাদে হরেনোক সাথে নিয়া রিংকিঘরের বাড়ি চলি গেল দিনহরি। বাড়ির সগায় মনে করিসে, হরেন হয়তো দিনহরিক ধরি ব্যারের আসিসে। কিছুক্ষন গল্প করির পর রিংকি চা বানেবার বাদে আন্দোন ঘর চলি গেল। আর পারুল, হরেন, দিনহরি আর বিকাশ ঘরোত বসি গল্প করেছে। এমন সমায় রিংকির বাপ বিকাশোক ডেকাইল, “জামাই বায়রা আইসোতো বাহে কোনেক।”.... বিকাশ চলি গেল। বিকাশের পাছে পাছে দিনহরিও ঘর থাকি বিরি চলি গেল। ঘরোত থাকিল হরেন আর পারুল। হরেন পারুলের হাতোত চিঠিখান দিয়া কইল, “হ্যাঁ, এই চিঠিখান ধর। দিনহরি তোক পছন্দ করিসে। উয়ায় তোক এই চিঠিখান দিবার বাদে আসিসে।” ....হরেনও চিঠি দিয়ায় বায়রা চলি আসিল। চিঠিখান নিয়া পারুল দ্যালদ্যাল করি কাঁপির ধরিল। কথাটা রিংকিক কবে না নাই-- এই কথাটা ভাবিতে ভাবিতে সেদিন সারা আতি আর নিন হয় নাই পারুলের।
পরের দিন সকালে পারুল ভয়ে ভয়ে চিঠিখান রিংকির হাতোত দিয়া কইল, “পড়তো হায়।”
“কি পড়িম ?”
“এইখানে পড়।”
“কি এইখান ?”
“চিঠি।”
“ চিঠি ! কিসের চিঠি ? কোটে পালু ?”
“কালি যে চেংরাটা হুলি খ্যালের আসিসে, উয়ায় আতিত দিয়া গেইসে।”
“দিনহরি ?”
“হুমম, পড়েক তো কি লেখিসে ?”
চিঠিখান নিজে না পড়িয়া রিংকিক পড়ির বাদে দিবার কারণটা হইল, পারুল নিরক্ষর। নিজের নামটাও লেখির পায় না, আর উয়ায় ক্যামন করি চিঠি পড়িবে। রিংকি চিঠি পড়ে আর হাসে, আর পারুল যতটা খুশি হয়, ততটায় ভয়তে কাবু। মনত যুদিও খুশির ফুলঝুরি বিকাশের ভয়তে আর রিংকিক কিছু কোবার পাছে না। যুদি রিংকি একবার বিকাশোক কয়া দ্যায়, তাহলে আর বাঁচির পথ নাই। কিন্তু চিঠি পড়ির পড় রিংকি কইল, “তোর জবাব কি তে হায় ?”
পারুল রিংকির কথা শুনি টোকটোকি খাইল। তাও কইল, “কি কং মুই !”
“যুদি রাজি আছিস তে তাও ক, আর রাজি না থাকিলে তাও ক। তোর উত্তেরর আশায় থাকিবে কিন্তু দিনহরি।”
“কিন্তু.... বিকাশ দা যুদি একবার শুনে।”
“ক্যামন করি শুনিবে ?”
“তাও মোক ভয় নাগেছে হায়। যুদি একবার শুনির পায়, তাহলে মোক মারি ফেলাবে!”
“ভয়ের কিছুই কারণ নাই। তুই রাজি আছিস না নাই ক।”
“ কিন্তু....”
“কুনো কিন্তু না হয় পারুল। আর যুদি ‘না’ করি দিস তাও ক ওইটায় লেখি দিম তাহলে।”
“না ! না না ‘না’ না কইস।”
“তার মানে হ্যাঁ।”
“মুই জানোং না।” .... এই কয়া চিঠিখান নিয়া পারুল এক দৌড়ে ঘর চলি গেল।
দুই দিন বিতি গেল, কিন্তু পারুলের কুনো জবাব না পায়া দিনহরি ভাবি নিসে, হয়তো পারুল রাজি নাই। তারপর আর কি, দিনহরি নিরাশ হয়া বাড়ি ফিরি আসিল। কিন্তু কিছুদিন পর পারুল বাড়ি আসিবার আগ মুহুর্তে রিংকিরটে একখান চিঠি লেখি নিসে। তাতে উয়াও উয়ার মনের কথা লেখি নিসে। সাথে উয়ার বাড়ির পুরা ঠিকানাও চিঠিত লেখি দিসে। সেই চিঠিখান ধরি রিংকি আর পারুল হরেনঘরের বাড়ি যায়া শুনির পায় যে, দিনহরি বাড়ি চলি গেইসে। পারুল চিঠিখান হরেনের হাতোত দিয়া আস্তে করি কইল, “চিঠিখান উয়াক দিসতো।”
হরেনও টুক করি নিয়া কইল, “ঠিক আছে দিম।”
“উয়ার বাড়ি কোটে রে হরেন ?”
“তোমারে ওত্তি, মাকলাবাড়ির ঘাট।”
“হামারে ওত্তি ! মাকলাবাড়ির ঘাট !”
“হুমম।”
“ঠিক আছে। তুই চিঠিখান উয়াক দিস কিন্তু।”
“আচ্ছা। চিন্তা না করিস।” .... তারপর আরও কিছুক্ষন গল্পস্বল্প করি পারুল আর রিংকি ভাটিবেলা বাড়ি ফিরি আসিল।
পরের দিন বেলা দশটার সমায় পারুল বাড়ির ঘাটা ধরিল। যাবার সমায় রিংকিক কইল, “কাহকো কইস না কিন্তু।”
রিংকিও কইল, “পাগোল আছিস নাকি। মুই আরও মানষিক ক্যানে কইম ! তুই চিন্তা না করিস। কুনো সাহাইয্য নাগিলে মোক কইস।”
“আচ্ছা, মুই গেলুং তে।” .... পারুল বিকাশের সাথে বাড়ি ফিরি আসিল।
কিছুদিন পর হরেন চিঠি ধরি চলি আসিল দিনহরির বাড়ি। চিঠিখান পায়া দিনহরির খুশি যুনি উথুলি পড়ে। ফটাফট চিঠিখান পড়িয়া দেখিল যে, পারুলও উয়াক খুব পছন্দ করিসে। প্রতি শনিবার দুপোর দুইটার সমায় উয়ায় ফুলবাড়ি বাজার যায়। দিনহরির ভালে সুবিধা হইল। উয়ায় উয়ার দাদার সাইকেলখান ধরি পরের শনিবার দুপোরে জোগোত-জাগাত চলি গেল ফুলবাড়ি বাজার। অনেক্ষন বাচ্চে থাকি যেলা পারুলের দেখা পাইল সেলা মনটা খুশিতে ভরি উঠিল। দুইজনে অনেক্ষণ গল্প করি বাড়ি ফিরিল।
পরের শনিবার আরও দিনহরি পারুলোক দেখির বাদে চলি গেল ফুলবাড়ি বাজার। সেদিনও অনেক গল্পগুজব করি বাড়ি ফিরিল দুইজনে। .... তারপর প্রতি শনিবার এইমন করি দুইজনে দেখা করিতে করিতে পারুল উয়ার দাদার চোখুত পড়িসে ভালে কয়দিন। মানষিও বিকাশোক উল্টাপাল্টা কথা কয়। কাহ কাহ কয়, “বিকাশ, পারুলটা তো গাবুরে হইল। বিয়াও দেওয়া খায় বারে। আবভাব খুব খারাপ দেখা যায় মাইটার।” .... মানষির এইমতন কথা শুনি কুনটা দাদার মন-মেজাজ ঠিক থাকিবে ?
একদিন পারুলোক উয়ার বৌদি কইল, “দিনহরির সাথে কি তোর কুনো সম্পর্ক আছে পারুল ?” .... বৌদির এই কথা শুনি তো পারুল খোং খোং। বুঝির পাইসে যে, উয়ার দাদায় এই কথাটা কইসে-- যেহেতু কয়েকদিন বিকাশের চোখুত পড়িসে। আর দিনহরিকো উয়ার দাদা ভাল করি চিনে।
পারুলও থোতমোত হয়া কইল, “কুন দিনহরি বৌদি ?”
“যার সাথে শনিবার করি বাজারোত দেখা করিস।”
“ওহ, ওই দিনহরি দা। কিন্তু ক্যানে তে বৌদি ?”
“তোর দাদা তোর বিয়াও ঠিক করিবে বুলি ভাবেছে। যুদি উয়াক পছন্দ করিস, তাহলে ক।”
“না... মানে...”
“ কুনো সম্পর্ক নাই ! তাহলে তো ঠিক আছে।”
“না না। সম্পর্ক আছে। মুই উয়াক পছন্দ করোং।”
“তাহলে এক কাজ কর--- তোর দাদা কইসে, এর মইধ্যে উয়াক একদিন বাড়িত আসির কইস। তোর দাদা কথা কবে উয়ার সাথে।” ..... কথাটা শুনি খুব খুশি হইল পারুল। কিন্তু ভয়ও ধরিল মনত--- যুদি উল্টাপাল্টা কিছু কথা কয় দাদা, তাহলে তো সর্বনাশ !
দোমোখোমো মনে পারুল পরের শনিবার দিনহরিক কইল, “তোক দাদা দেখা করির কইসে।”
“হয় নাকি ?”
“ হুমম। আইসা শুকুরবারে আসিস।”
“কোটে দেখা করিম ?”
“হামার বাড়িত।”
“দাদা কি কবে রে ?”
“কায় জানুক ! কিন্তু, মোক ভয় নাগেছে জানিস।”
“কিসের ভয় রে পাগলি !”
“দাদা যুদি রাজি না হয়, সেলা কি হবে ?”
“রাজি হবে। তুই মোর উপর ভরসা রাখ।”
“তোর উপর ভরসা আছে বুলি তো কথাটা কলুং।”
“হুমম। তুই নিশ্চিন্তে বাড়ি যা। মুই শুকুরবারে যাইম, দাদাক বাড়িত থাকির কইস।”
“ঠিক আছে।” .... এই কয়া পারুল বাড়ির ঘাটা ধরিল। দিনহরিও বাড়ি ফিরি আসিল।
শুকুরবারে দিনহরি আর উয়ার এক বন্ধু--- দুইজনে মিলি পারুলের বাড়িত আসি হাজির। পারুলের বাড়ি-ঘর দেখি তো দিনহরির হুশ খরে গেইসে। দিনহরির দেহাটা দ্যালদ্যাল করি কাঁপেছে, ঝসি-টসি ডাইল। পারুলঘরের সেই বিশাল বাড়ি--- দুই দুইটা বড়ো বড়ো দালান ঘর। মানষি মাত্র তিনটা। চাকর-বাকরের থাকির ঘরগিলায় দিনহরির ঘরের থাকি অনেক ভালো। বাড়ি-ঘরের অবস্থা দেখি দিনহরি নিজে মনে মনে ভাবেছে যে, “এটে আর সাগাই হবে না!” ... এমন সমায় বিকাশ আসি হাজির। বিকাশোক দেখি দিনহরি কইল, “দাদা ভালো তো ?”
“হ্যাঁ ভালো। তুই ক্যামন আছিত ?”
“মুইও ভালো।”
“আচ্ছা কাজের কথাত আসি।”
“হ্যাঁ দাদা।”
পারুলোক চা বানেবার প্যাটে দিয়া বিকাশ দিনহরিক কইল, “নিজে তো থাকিস একটা খোটোরাত। পারুলোক নিগি কোটে থাকাবু ? পারুল কোটে থাকে দেখসিস ? কি আছে রে তোর ? দাদা-বৌদির হোটোলোত এলাও তুই নিজে খাইস, পারুলোক কি খোয়াবু রে--- ছাঁই-মাটি ?” দিনহরির মনটা কাঁইচের মতন করি ভাঙিয়া চুরমার হয়া গেল। জবাব দিবার মতনও ব্যবস্থা নাই। কি জবাব দিবে---- বিকাশ যেইলা কথা কছে একটাও তো আর ভুল না হয়।
“না দাদা, হামার তো আর এলায় বিয়াও করির প্লান ছিল না।”
“কিন্তু, হামরা যে পারুলের বিয়াও নাগামু। তোর কথামতন তো আর হামার চলা যাবে না।”
“কিন্তু----”
“কুনো কিন্তু না হয়। তোক মুই একটা সুযোগ দ্যাছোং---- ছয়মাস সমায় দিলুং, তাড়াতাড়ি বাড়ি-ঘর ঠিক কর।”
“ঠিক আছে দাদা।”.... কুনোকিছু না ভাবিয়া দিনহরি কথাটাত তো রাজি হইল ঠিকে, কিন্তু--- বাড়ি-ঘরের যা অবস্থা তাতে ছয় মাস তো কি, একবছরও একেবারে ফিটফাট করা সম্ভব না হয়। বিকাশও জানে, দিনহরির হিম্মৎ হবে না ছয়মাসে বাড়ি-ঘর ঠিক করির। আর ততদিন উয়ায় উমার লেবেলের কাহরো সাথে পারুলের বিয়াওখানও দিবার পাবে। সেদিন দিনহরি আর উয়ার বন্ধু বাড়ি ফিরি আসিল। সারা আতি নিন পাড়ে নাই বিকাশের কথাগিলা শুনি। সেদিন আতিতে ঠিক করিল কেরালা চলি যাবে।
পরের শনিবার পারুলের সাথে দেখা করিল দিনহরি। উয়ার কেরালা যাবার কথা শুনি পারুল কইল, “কেরালা যাবার নাগিবে না। তার বদল চল হামরা কুনোওত্তি পালে যাই।”
“না পারুল না। দাদা তো রাজি আছে, মোক সমায়ও দিসে---- তাও ক্যানে পালে যাই রে! ভুল হবে সেইটা।”
“মোক ভয় নাগেছে !”
“ভয়ের কিছুই নাই। তুই নিশ্চিন্তে থাক। ওত্তি থাকি তোক প্রতি সপ্তায়_ মুই চিঠি লেখিম।”
পারুলও কান্দিতে কান্দিতে কইল, “ঠিক আছে। পরে কিন্তু কুনো কিছু হলে মোক দুষির পাবু না, কলুং।”.... দিনহরির কোনেক্কো মনত নাই যে পারুল তো লেখাপড়া জানে না। না পাবে চিঠি পড়ির, আর না পাবে পাল্টা চিঠি লেখির। রিংকির বাড়িত যায়াও তো আর সবসমায় চিঠি লেখি নেওয়া সম্ভব হবে না।
দিনহরি কেরালা চলি গেল। পারুলোক পাবার আশায় জিউ-যাহান ছাড়ি খাটে। কাজ করে আর দাদাক টাকা পাঠায় বাড়ি-ঘর ঠিক করির বাদে। কিন্তু দাদাটাও খুব সরল-সাদাসিদা মানষি--- পুরান বাড়িটা ঠিক না করিয়া দিনহরির বাদে সেই টাকাতে একটা নয়া বাড়ি বানের ধরিসে। আর দিনহরি প্রতি সপ্তায় একখান করি চিঠি ল্যাখে পারুলোক। কিন্তু পারুল না পায় তার জবাব দিবার, আর না পায় চিঠিখান নিজে পড়িবার। বৌদিও তো মুর্খ মানষি আর দাদা--- উয়াক তো শরোমে পড়ির দেওয়া যাবে না চিঠিখান। পাড়ার কাহকো দিয়া পড়ি নিলে বাপ-ঠাকুদ্দার নাম ডুবি যাবে। উপায়ও কিছু নাই। সপ্তার চিঠি সপ্তায় নিয়া টেরেঙোত ঢিপ নাগে থয় পারুল। দিনহরিরও মন ভাল নাই পারুলের জবাব না পায়া।
তিনখান মাস এংকরি বিতি গেল। বিকাশ ততদিনে পারুলেরটে দিনহরির কুনো খবর না পায়া ভাবিসে--- উমার সম্পর্কটা বোধায় শ্যাস হয়া গেইসে। তার বাদে পারুলোক না পুছিয়া উয়ায় নবারুন ঘটকোক দিয়া পারুলের বাদে একটা ভালো ঘরের খবর আনির কইল। নবারুনও কয়েকদিনের মাথায় একটা ঘরের খবর ধরি গেল--- চেংরাটা বি.এস.এফ এর চাকরি করে। বিকাশের আর উয়ার বনুসের তো খুব পছন্দ হইসে চেংরাটাক। চেংরাও পারুলোক পছন্দ করিসে। কিন্তু পারুলের পছন্দ হয় নাই--- উয়ায় যে আছে দিনহরির আশায়। না পাছে কাহকে কুনো কোবার, আর না পাছে এই যন্ত্রনা সোবার।
চেংরা তো পারুলোক দেখি যায়া সপ্তাখানেকের মইধ্যে ঘটকোক খবর দিসে যে, “পারুলোক খুব পছন্দ হইসে। যুদি বিয়াও নাগায় তাহলে দুই সপ্তার মইধ্যে হলে ভালো হয়।”.... ঘটকের মুখোত এই কথা শুনি বিকাশ ‘না’ করির পাইল না। রাজি হয়া গেল। পারুলের মত-অমত কিছুই শুনির চেষ্টা করিল না বিকাশ। ভালো একটা দিন দেখিয়া বিয়ার তারিখ পাকা করিল।
বিয়ার দিন আর বেশি দেড়ি নাই। পারুলের বাড়ি থাকি বিরা বন্ধ। বিকাশ সাগাই-সোদোর সগাকে নিমন্তন শুরু করি দিসে। শ্বশুড় বাড়িত যেলা নিমন্তন দিবার গেইসে---- রিংকি তো খুব খুশি। কিন্তু যেই শুনিসে যে বিয়ার পাত্র দিনহরি না হয়, ওমনি মনটা ভাঙি গেল। বিকাশের সাথে উয়াও উমার বাড়ি চলি গেল।
সেদিন আতিত পারুল রিংকির দেখা পায়া যত জ্বালা-যন্ত্রনার কথা সবে খুলি কইল। রিংকিও পারুলের কথামতন একখান চিঠি লেখিল। পরের দিন চিঠিখান দিনহরিক প্যাটাবে ভাবিল। কিন্তু, চিঠিখান দিনহরিক নিগি দিবে কায় ?... পরের দিনে লোক খুঁজিল, কিন্তু পাইল না। কারণ, এইলা চিঠি কি আর যারে-তারে হাত দিয়া প্যাটে দেওয়া যায় ! তাছাড়া পাড়ার সগায় জানে দিন ফুরালে উয়ার বিয়াও।
মনের কথা চিঠিতে থাকিল, দিনহরিক আর কোয়া হইল না পারুলের।... আর কিছু করার থাকিল না, খুব ধুম-ধাম করি ঢাকে-ঢোলে বিয়াওখান হইল উয়ার।
দিনহরি কিন্তু অতকিছু জানে না, উয়ায় উয়ার মতন করি প্রতি সপ্তায় পারুলোক চিঠি ল্যাখে আর সমায় মতন উয়ার দাদাক প্যাটে দ্যায়।
দিনহরির কেরালা যাবার ছয়মাস হয়া গেল, পারুলের পাল্টা চিঠি কুনোদিন পাইল না। এই ছয়মাসের ভিতিরা দিনহরির নয়া বাড়িটা প্রায় কমপ্লিট। কারণ, উয়ার দাদা উয়ার দেওয়া একটা পাইসাও হিদি-হুদি খরচ করি নষ্ট করে নাই। যত টাকা প্যাটে দিসে সব উয়ার নয়া বাড়ি বানাইতে খরচ করিসে।
সাত মাসের ঠিক আগে আগে একদিন দিনহরির দাদা উয়াক চিঠি লেখিল--- বাড়ি ফিরি আসিবার বাদে। এই চিঠিখান পায়া দিনহরির মন আর কেরালাত এক মুহুর্ত থাকির চান্দাছে না। দাদা-বৌদির আর ভাতিজা-ভাতিজির জইন্য কাপড় নিয়া, পারুলের তানে নাল টুকটুকা একখান দামী শাড়ি, চুড়ি-মালা, দূল নিয়া খুশি মনে টিকিট কাটি বাড়ি ফিরিল।
নয়া বাড়িটা দেখিয়া তো দিনহরির মনটা ভাঙি গেল। সাথে সাথে দাদাক কইল, “মোক তুই ব্যাগোল করি দিলু দাদা !”
“আরে না রে পাগলা, তুই বিয়াও-বাধা করিবু, সংসার হবে। একটা বাড়িতে থাকিলে হয়তো ঝোগরা-ঝাটি নাগির পায়---- তারে বাদে তোর পাইসা দিয়া তোক নয়া বাড়ি বানে দিলুং। আর বাড়িটা আলাদা হইল তে কি হইল রে পাগলা, হামার দুইভাইয়ের মন আলাদা না হলেই হইল বুঝিলু”
“কিন্তু দাদা.....”
“কুনো কিন্তু না হয়। মেল্লাদিন পর বাড়ি আসিলু, যা আড়াম কর। এইলা নিয়া পরে কথা কমু।”
“ঠিক আছে।”.... এই কয়া, যা কিছু পারুলোক দিবার বাদে নিসে---- সবগিলায় নিয়া দিনহরি ফুলবাড়ির ঘাটা ধরিল।
সোজা চলি আসিল পারুলের বাড়ি। অনেক্ষন পারুলোক ডেকাডেকি করিল, কিন্তু পারুলের কুনো জবাব নাই। পারুলের বৌদি ঘর থাকি বিরি আসি দেখিল দিনহরিক। বৌদি পুছিল, “কি ব্যপার ?”
“পারুল কোটে বৌদি ?”
“উয়ায় তো নাই।”
“কোটে গেইসে ?”
“শ্বশুড় বাড়িত।”
“শ্বশুড় বাড়ি !”
“হুমম।”
“মিছা কথা না কইস বৌদি।”.... দিনহরির চোখুত ততক্ষনে জল ছলছল করেছে।
“মিছা কথা না হয়। বিশ্বাস যুদি না হয়, তাহলে মোর কিচ্ছু করার নাই।”
“কিন্তু উয়ায় যে মোক বিয়াও করিবার কথা দিসিলো !”
“মুই কি জানোং ! উয়ায় তো স্ব-ইচ্ছায় বিয়াও করিসে।”.... এই কথা শুনি দিনহরির মুখোত আর কুনো কথা নাই। এতটা ধোকেবাজ, এতটা মিথ্যাবাদী ক্যামন করি হোবার পায় পারুল--- এইটা দিনহরির যুনি কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। বিশ্বাস না করিয়াও উপায় নাই।.... ফটাফট ফম পড়েছে পুরানা স্মৃতিগিলা। আর যত বেশি ফম পড়েছে, চোখুর জল তত বেশি উথুলি উথুলি পড়েছে--- আটকেবার হিম্মৎ হয় না দিনহরির।
বাড়ি ফিরি আসিল দিনহরি। আতিত আর কিছু খায় নাই। বৌদি খাবার ডেকালে কয়, “বন্ধুর বাড়িত খায়া আচ্চুং। তোমরা খাও।”.... তারপর আর কুনো কথা নাই।
সেদিন আতি থাকি শুরু জলঢাকার পারোত বসি দিনহরির মদ-গাঞ্জা খাওয়া--- আর কুনোদিন বন্ধ হয় নাই। মানষিটায় পাগলার মতন হয়া গেইসে। ডুগডুগা নাগা দেহাটা নাটা বিরাইসে! কুনোদিন বাড়ি ফিরে, কুনোদিন ফিরে না---- মদ-গাঞ্জা খায়া রাস্তা-ঘাটে যেটে-সেটে পড়ি থাকে ! আর জ্ঞান থাকা অবস্থায় বারবার একটা কথা কয়, “শাজাহান তো সম্রাট ছিল পারুল, তার জইন্যে উয়ায় মমতাজের বাদে ‘তাজমহল’ বানাইসে। আর মুই ? মুই তো সাধারণ একটা দিন-মজুর ! মুই কি বানাইম ? তাও তোর বাদে একটা প্রেমের মন্দির বানাসুং পারুল, প্রেমের মন্দির।”
তারিখ: ১০.০৩.২০১৯