দেলো ভাই ব্যাক্তিগত ভাবে খুব ভালো মানুষ ও রসিক প্রকৃতির। তার ভালো নাম দেলোয়ার। সৌদি প্রবাসী। সকল চাচাতো ভাই-বোনেরা আমরা দেলোয়ার ভাইকে মিবাই বলে ডাকি, কারণ সে আমাদের বড় চাচার ছেলে।
গত কুরবানির পর ভিসা বদল করে নতুন ভিসায় যাওয়ার জন্য বাড়ি আসে। ভিসা প্রসেসিং এ প্রায় ৬-৭ মাস লেগে যায়৷ গত এপ্রিল মাসে তার ফ্লাইট হওয়ায় আমি নিজে তাকে ঘাট পর্যন্ত আগায় দিয়ে আসছি। যদিও আমার এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাওয়ার কথা ছিলো, একটা কাজ পরে যাওয়ায় আর এয়ারপোর্ট যাওয়া হয় নি৷
ওহ বলাই তো হয়নি সে ডায়াবেটিস রোগী। যাই হোক, শুনেছি ওখানে গিয়ে দেখে এত দিনের গ্রেজ ভাড়া, কর্মচারীদের বেতনের পাহাড় পরে গেছে। তার সাথে করোনা ভাইরাসের জন্য কাজও বন্ধ।
মাঝে খবর পেয়েছিলাম মিবাইর নাকি অনেক জ্বর হয়েছিল। ৪-৫ দিন পর কিছুটা সুস্থ হয়েছে। তার কয়েক দিন পর শুনতে পাই মিবাই হার্ড-এট্যাক করেছে, তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। আমার সবাই বুঝতে পেরেছি হার্ট-এট্যাক এর কারণ আর কিছুই না, হাইপারটেশন। কাজ নেই, টাকা নেই, মিটারের মতো বাড়তেছে খরচের পরিমাণ।
সেইদিনই তাকে আই-সি-ইউ তে নেওয়া হয়৷ তার পরের দিন তার বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারি মিবাইর তিনটি রোগ ধরা পরছে জ্বর, সুগার, হার্ট প্রবলেম৷ তারপর দুইদিন চলে যায় শুধু জানতে পারি ভালো আছে, এর চেয়ে বেশি কিছু না৷
রাতে আব্বু মার ফোনে আনুমানিক ২ টার দিকে ফোন দিয়ে বলে "দেলোর করোনা হইছে"। খবরটা শোনার পর রাতটা কিভাবে কাটছে তা বলে বুঝাতে পারবো না৷ সকাল থেকে মা আর আমি কাকাদের বাড়ি কয়েকবার যাওয়ার পরও এগারো বছরের ভাতিজা ও দেড়-দুই বছরের ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বলতে পারি নাই৷
দিনটি শুক্রবার হওয়ায় কাকা মসজিদে মিবাইর জন্য দোয়ার ব্যবস্থা করেছে। নামায শেষে, আমরা সবাই তার সুস্থতা কামনায় দোয়া করি। দোয়া শেষে আমি নিজে মিষ্টান্ন বিতরণ করেছি।
মসজিদ থেকে যেই বের হইছি, এক কাকার কন্ঠে বিষ বাণীর মত বেজে উঠল "দেলো আর নেই"। কিছু না ভেবে এক-দৌড়ে কাকা বাড়ি যাই৷ ততক্ষণে বাড়ি ভর্তি কান্নার রোল পরে গেছে৷ ভাবি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পরে আছে, কয়েক জন তাকে বাতাস করতেছে৷ কাকা, কাকি, ভাতিজ এমনকি প্রতিবেশীরাও কান্নায় ভেঙে পরেছে৷ নিজের অজান্তেই চোখ থেকে অশ্রু শ্রাবণের বৃষ্টির মতো পড়তে শুরু করল৷ তার সাথে পার করা পুরনো স্মৃতি মনে পরতেছিলো আর বুক ফাটা চিৎকার আটকে রাখতে পারছিলাম না৷ আমি কিছুতেই পরিবেশে টাকে বিশ্বাস করতে পারিনি৷ আমার শুধু মনে হইতেছিলো, এইতো একটা ফোন এলো আর বল্লো "দেলো বেচে আছে, ডাক্তার ভুল বলেছে"। কিন্তু সেই ফোনটি আজ ও আসেনি।
হয়তোবা, তার সুষ্ঠু পরিচর্যা হলে আজ আমাদের তার অকাল চলে যাওয়ায় ক্লান্তিকাল দেখতে হতো না৷ এই পরিচর্যা কিভাবে সম্ভব?? সে তো প্রবাসী। যে জীবনে প্রিয়জন কে ছেরে সুদূরে থাকতে হয়৷ এভাবেই হয়তো হাজারো প্রবাসীর জীবনের সমাপ্তি টানতে হয় তাদের প্রিয়জনের মুখের হাসি ফুটানোর জন্য৷
শেষ সময়ে আপনার জন্য কিছুই করতে পারিনি, দোয়া করি ওপারে ভালো থাইকেন, আল্লাহ যেন আপনাকে জান্নাত নসিব করে৷
আজও আমার চোখ অশ্রুতে ভরে যায়, আমার ছোট্ট ভাতিজা যখন বলে"কাকা কাকা.... "আব্বু পঁচা, আব্বু ফোন দেয় না৷ "