১.
পিতৃদেবের সম্প্রদান করা বর শ্রীমানকেই এখন দ্বিতীয় ঈশ্বর মনে করে শ্রীমতি। গেল আষাঢ়ের শেষ দিকে অগ্নি, বট এবং পাড়া প্রতিবেশিকে সাক্ষী রেখে শ্রীমানের সাথে শ্রীমতিকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দেন পুরোহিত মহাশয়। নববধু বেসে শ্রীমানের বাড়িতে আসার ৫ম দিন চলছে শ্রীমতির। বিয়ের আমেজ এখনো শেষ—ই হয়নি। ননদিনী রাই হঠাৎ বৌদির হাত ধরে বলে উঠল—
— কি গো বৌদি, খালি কাম করলে হোবে, খাওয়া নাইগবের নয়..? সারাজীবন তো কাম করবেন। আগে এক নাইওর হউক, তারপর কামকাজ করা যাইবে।”
এই বলে রাই বৌদিকে টেনে নিয়ে গেল রান্না ঘরে। বৌদির প্রতি এমন আদর দেখে শ্রীমতির কাকি শাশুড়ি জোর গলায় বলতে লাগলো—
— এতো দরদ দেখাইস না মায়ও, কাম কাজও একনা করা নাগবে। গাওখেন ঝাড়া দিয়ে উঠুক।
— কাকি, বৌদি আগোত একবার বাপের বাড়ি যায়া ঘুরি আসুক, তারপর কাম করবে— ননদিনী রাইয়ের প্রতিবাদ।
এতো কথার মাঝেও শ্রীমতি কোনো কথাই বললো না। মনে মনে ভাবলো, বাপ—মা যখন এ বাড়িতে পাঠিয়ে, তখন কাজ তো করতেই হবে। তবে শ্রীমতি রাইকে একটা কথা ঠিকই বললো—
— ঠাকুরঝি, তোমার দাদা খাইলো কিনা সেটা জানি আসি খাই...?
কিছুক্ষণ হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকে রাই বললো—
— সে কি গো বৌদি, তোমরা তো......না থাইক, কিছু কইলেম না। বৌদি শোনো, তোমার দুইজনার গাও থাকি এলাও কুড়ের (হলুদের) দাগ যায় নাই। এলায় দাদার জন্যে এতো দরদ দেখা নাগবের নয়। ওয় সময়মত খায়া নিবে। তোমরা খাওতো আগোত।
কি আর করা। স্বামীর বোনই তো বলেছে। এখনো তো এ বাড়ির কর্তৃত্ব সে পায় নি। তাই কিছু না বলে খেতে বসতেই হলো। কিন্তু শ্রীমতি মনে মনে বললো—
— রাই, কেমন করি তোমার দাদাক না কয়া খাং, তোমার দাদা যে মোর প্রাণনাথ।
শ্রীমতির এমন ভাবনা কে আর বুঝবে। সে ভাবনা মনের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে রইলো।
— দেখো তো ফির কি চিন্তে করে ! বৌদি শোন, এ বাড়িটে এলা তোমার। হামরা আইজ আছি কাইল নাই। মা বাবা আর দাদাক নিয়ে তো সারাজীবন থাইকপেন। কতদিন হইলো এ বাড়িত আইচছেন, এলাও তোমার সাথে বসি খাবার পাইলোং না। এলা কিছু ভাবেন না তো। বইসো, হাত খেন ধোন।
অগত্যা ননদিনীর জেড়ে খেতেই হলো। তবে খেতে বসে খুব মনে পড়লো শ্রীমতির মনপিঞ্জরে লুকিয়ে থাকা মানুষটারে। কারন, বাপের বাড়ি থেকে বিদায় নেয়ার সময় দিদিমা বলে দিয়েছে—
— শোন রই শ্রীমতি, স্বামী হইলো অগতির গতি। তাই, তার মুখের উপড়ে কোনো কথা কইস নে। তায় না খাওয়া পর্যন্ত নিজে কখনো খাইস নে।
দিদিমার এ কথাটা মনে পড়ায়, মনে দাগ কেটে গেল শ্রীমতির। এদিকে ননদিনীর জোড়াজুড়ি। তাই বাপের বাড়ি থেকে বিদায়ের সময়ের দিদিমার কথা মনে করে ঠাকুরের কাছে এমন ভাবে ক্ষমা চাইলো, একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ জানতে পারলো না।
(চলমান)