একটি আত্মহত্যা কিংবা পুনর্জীবনের গল্প ।। শহীদুল ইসলাম অর্ক


 এটা মৃত্যুর পরোয়ানা নাকি জীবনের আহবান বরকত বুঝতে পারে না। হয়ত জীবন, হয়ত মৃত্যু! সংশয়ের দোলাচালে দুলতে দুলতে বরকত সামনে তাকায়। এইমাত্র হুইসেল দিয়ে স্টেশনে ঢুকল কর্ণফুলি এক্সপ্রেস। গত একমাস ধরে সে কমলাপুর রেলস্টেশনবাসী হলেও আপ-ডাউন ট্রেনের সময়সূচিগুলি মুখস্ত হয়নি। হবে কী করে? সে তো এটা করতে ঢাকায় আসেনি, সে এসেছে টাকা কামাতে। দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা কুড়িগ্রামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে তার হতদরিদ্র বাবা আট-দশটি সন্তান নিয়ে পরে আছে অকুল পাথারে! সে সবার বড়। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরের মাঝ থেকে জীবনের জাহাজটিকে নিরাপদে তীরে ভেরানোর কঠিন দায়িত্ব এই মুহুর্তে তার কাঁধে। বাবা ভরশা পান না। তার বক্তব্য,  বরকত হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম গাধামানব। মুক্তিযুদ্ধে পা হারানো বাবা বড় আশা করে ছেলের নাম রেখেছিলেন বরকত, ভাষাশহীদের নামে। ছেলেবেলায় বাবা তাকে ভাষা আন্দোলনের গল্প বলতেন, মুক্তিযুদ্ধে তার পা হারানোর গল্প বলতেন। কিন্তু বরকত বাবার ইচ্ছে মানুষ হয়ে উঠেনি। বড় ছেলের জীবন তাঁকে আশাভঙ্গের বেদনায় ক্রাচবদ্ধ জীবনকে আরও হতাশায় ভরিয়ে তোলে। অল্প কিছু জমিতে চাষাবাদ করে এত বড় পরিবারের ছ'মাসের অন্নসংস্থান হয়, বাকি ছ'মাস চলে কষ্টে-সৃষ্টে ধার-দেনায়। বেকার জীবনে বিব্রত থাকতে হয় পরিবারের কাছে। বাবা ঘুমানোর পর বাসায় ঢোকা তার অভ্যাস। মা নিরব থাকেন। তাঁর নিরবতা বরকতকে আরও পীড়িত করে তোলে। তার সমবয়সীরা কেউ চাকরি করছে, কেউ ব্যবসা। সেই একমাত্র বেকার। আজকাল তার মন শুধু পালাই পালাই করে। শোনা যায় অনেকে ঢাকায় গিয়ে জীবন বদলায়। "তাহলে ঢাকায় যাই", সে ভাবে। পড়ন্ত বিকেলের লালচে রোদ যেদিন তার মুখে এসে পড়ল, পুকুরঘাটে একা একা, সে পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। 


পরদিন খেতে বসে সে কথাটা পাড়ল। মা ডালের বাটি এগিয়ে দিতে দিতে বললেন- ঢাকায় গিয়ে কি করবি? 
"দেখি, কিছু একটা তো হবেই।" তার মৃদু উচ্চারণ।
"কবে যাবি?"
"কাল।"

পরদিন লোকাল ট্রেনের কামরায় সৌভাগ্যবশত সে একটা সিট খুঁজে পেল। এরপর পনের ঘন্টার কু- ঝিকঝিক। তারপর কমলাপুর। সাথে মায়ের অশ্রু, ডিম বিক্রির খুচরো টাকা, বাবার দুঃচিন্তা।

কিন্তু আজ, একটু আগে, কর্ণফুলি এক্সপ্রেস তখনো আসেনি, এমন সময় একটা ঘটনা তাকে হতবিহ্বল করে তুলেছে। ট্রেনের যান্ত্রিক গুঞ্জন, যাত্রীদের চেঁচামেচি, কুলি-মজুরদের চিৎকার, বিচিত্র সব কোলাহলের মিলিত শব্দ তাকে আচ্ছন্ন করতে পারছে না। সিমেন্টের বেঞ্চিতে সে স্ট্যাচুর মত বসে আছে অনেকক্ষণ। তার কানে একটানা বাজছে,  একটু আগে বলা গোলাম মহাজনের কথাগুলো। 

গোলাম মহাজনের সাথে তার পরিচয় ঢাকা আসার ছয়দিন পর। সে স্টেশনে একটা চায়ের দোকানে দিনমজুরি করছিল। মহাজনকে সে সেদিন আরও দু'জন লোকসহ দোকানে ঢুকতে দেখল। তাকে দেখেই মনে হল লোকটা সুখি। সত্যিকার অর্থে গোলাম মহাজনের আচরন, কথায় সুখিভাব প্রবল। সারাক্ষণ মুখে হাসি, পরিপাটি চেহারা এরকম একটা আভাস দেয়। বরকতকে সেদিন তিনি ছোটভাই বলে সম্বোধন করেছিলেন। চায়ের কাপ হাতে তিনি বারবার হেসে উঠছিলেন কীসব কথায়। এরপর মাঝমাঝে দেখা হত এখানে সেখানে। দেখা হলে কুশল জিজ্ঞাসা করতেন।

কয়েকদিন আগে একবার প্রশ্ন করলেন-
" ছোটভাই কী করছ এখন?"
-কিছু না।
-চলে কেমনে?
-কিছু করার চেষ্টায় আছি।
-তো, আমারে বলবা না?
বরকত প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে মহাজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। 
-শোন ছোটভাই, আমি তোমার সাথে শনিবার কথা বলব। চেষ্টা করব তোমারে কোনো কাজ দিতে। বাকিটা আল্লাহ ভরশা।
একথা বলেই হনহন করে দ্রুত প্রস্থান করেন।

বরকতের মাথায় সন্দেহ উঁকি দেয়। সে ভাবে, মহাজন নিশ্চয়ই চোরাকারবারি, ফেন্সিডিল, গাঁজা, ইয়াবা ব্যবসায়ী। তিনি হয়ত বরকতকে দিয়ে এসব করার প্লান করেছেন। সে শুনেছে এই টাইপের লোকজন নাকি হতাশ যুব সমাজকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে।

কিন্তু বরকতের ভাবনা ভুল প্রমান করতেই যেন গোলাম মহাজন আজ এসেছিলেন। তাকে নিয়ে বসলেন একটু দূরে জনসমাগম কম এরকম একটা জায়গায়, সিমেন্টের বেঞ্চিতে। কুশল বিনিময়ের পর বললেন-
-যেহেতু তোমার চাকরি দরকার,  আমি তোমাকে চাকরি দেব।
-কিন্তু আমি কোনো অবৈধ কাজ করব না। 
 বরকতের সাফ জবাব। মহাজন হো হো করে হেসে বললেন-
 -তোমার কি ধারনা আমি তোমারে দিয়ে বাবা বেচমু?
 বরকত নিরুত্তর।
 -শোন ছোটভাই। আমি তোমারে চাকরি দিমু। বৈধ কাজ। বেতন পাইবা মাসের ১ থেকে ৫ তারিখের মধ্যে। ঝড় তুফান যাই হোকনা কেন, তুমি সময়মত বেতন পাবা। নিজে খাবা, বাসায় টাকা পাঠাবা। শুধু কাজটা ঠিকঠাকমত করবা।  ওকে?
 -কিন্তু কাজটা কী?
 -কাজটা সহজ। কিন্তু কাজের জন্য ফিট হইতে হবে। এইটা একটু কঠিন।
 -খুলে বলেন।
 -আমি তো বলবার চাইতেছি। শোন কাজটা হল, সহজ কথায় খয়রাতি।
 -ভিক্ষা?
 -হ্যা।
 -এইটা আবার কেমন চাকরি?
 -তুমি বইসা থাকবা, হাইটা যাবা, লোকে তোমারে টাকা দিব।
 -আমার মত ছেলেকে কেউ ভিক্ষা দেবে না।
 -এইজন্য তো বললাম ফিট হইতে হবে। এইটা একটু কঠিন। তবে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য তুমি স্যাক্রিফাইস করতে পারবা না? পারবা।
 -সেটা কী?
 -বুঝতে তো পারছই, সুস্থ সবল যুবককে কেউ কখনো ভিক্ষা দেবে না। সেজন্য ছোট্ট একটা অপারেশন। দেখবা তুমি পুরো ফিট হবা এ চাকরির জন্য।
 -কীভাবে?
 -মনে কর তোমার এক পা নাই। তুমি ক্রাচে ভর দিয়ে হাটতেছ। কিংবা ধর তোমার দু'চোখ নাই।
 মহাজনের কথা শুনে বরকতের গায়ে কাঁটা দিল। কী বলে লোকটা! একি মানুষ, নাকি শয়তান?
 -ভয় পাইছো মনে হয়?
 বরকত নিরুত্তর। সে তাকিয়ে আছে প্লাটফর্মের বিপরিত দিকে। দশ-বারোজনের একটা মিছিল আসছে। তার মত বয়সের ছেলেগুলো। মহাজনের চোখ সেদিকে পড়তেই খেঁকিয়ে উঠল।
 -শালা নাস্তিক, বেশ্যার দল।
 
 বরকত মহাজনের রেগে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারে না। শুধু এটা ভাবে মহাজনের সাথে হয়ত তাদের কোনো বিষয়ে বিরোধ আছে। ধীরে ধীরে মিছিলটি চলে যায় স্টেশনের বাইরে। মহাজন রাগ মুছে বরকতের দিকে মনোযোগী হয়।
 
 -শোন ছোটভাই, বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। ভীতু মানুষেরা জগতে কিছু করতে পারে না। আমার আন্ডারে ঢাকা শহরে শত শত লোক চাকরি করে। মাস শেষে লাখ লাখ টাকা তাদের আমি বেতন দেই। ঈদে আমি বোনাস দেই। তারা সারাদিন কাজ করে রাতে জমা দিয়ে দেয়। যদি কোনো মাসে কেউ এক টাকা ইনকাম করতে নাও পারে তবু আমি তারে সে মাসে সমান বেতন দেই। আমি নীতিতে অটল।
 
 বরকত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মহাজনের দিকে।
 
 -শোন ছোট ভাই, মনে কর তুমি রাস্তা দিয়ে যাইতেছ। হঠাৎ একটা গাড়ি তোমারে ধাক্কা দিয়ে চইলা গেল। তুমি সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেলা। হতে পারে না? পারে। 
 -শুধু তুমি মনে কর, তোমার জীবনে একটা দূর্ঘটনা ঘটেছে। ব্যাস, হয়ে গেল।
 বরকতের নিরবতায় মহাজন আরও উৎসাহী হয়ে উঠে।
 -আগে হাসপাতালে অপারেশন করাতাম। বেশ কিছু ডাক্তার কন্ট্রাক্ট করা ছিল। কিন্তু এখন প্রশাসনিক চাপে তা আর করা যায় না। তবে ভিন্ন পদ্ধতি আছে। মনে কর ট্রেনে কাটা পড়ল তোমার একটা পা। আমরা সাথে সাথে এম্বুলেন্সে তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। খরচাপাতি সব আমার। দু'মাস পর তুমি চাকরিতে জয়েন করলা।
 
গোলাম মহাজনের কথায় বরকত পাথর হয়ে গেছে যেন। বরকতের দিকে চেয়ে উঠে পড়ে মহাজন।
-ছোটভাই, ভাইবা দেখ। আমি তোমার সাথে পরে কথা কমুনে।
বলে লম্বা পা ফেলে জনারণ্যে উধাও হয় লোকটা।

একটু পরে এক নম্বর প্লাটফর্মে ঢোকে কর্ণফুলি এক্সপ্রেস। বরকতের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নামতে থাকে। সিমেন্টের কালো বেঞ্চিতে বসে আছে যেন একটা পাথুরে ভাষ্কর্য!

ট্রেন থামতেই শোরগোল তীব্রতর হতে থাকে। এমন সময় দুই পা বিহীন এক ভিখিরিকে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে সামনে এগিয়ে যেতে দেখে বরকত। ততক্ষনাৎ ঐ জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে শিউরে ওঠে ও। না, কখনই সম্ভব না। সে উঠে দাড়ায়। মাথা থেকে ওসব ঝেড়ে ফেলে পা বাড়ায়। প্লাটফর্মের ঐপাড়ে পরিচিত চায়ের দোকান। প্রায়ই ওখানে মজুরি খাটত, সেদিকে আগাতে থাকে। কিন্তু কী আশ্চর্য! ডান পা টা ব্যথা করছে কেন!

কষ্ট করে পা টেনে টেনে সে চায়ের দোকানে পৌঁছায়। ক্যাশে বসে থাকা দোকান মালিককে সে জিজ্ঞেস করে- ভাইজান, লোক লাগবে নাকি?
- না। লাগব না।
ভগ্নমনে সে আবার ফিরে আসে সিমেন্টের বেঞ্চিতে। ইতোমধ্যে ক্ষিধেও মাথাচারা দিয়ে উঠেছে। কাজ পেলে খাওয়া জুটতো। আজ তার পকেটও গড়ের মাঠ। গভীর দুঃচিন্তায় সে গোলাম মহাজনের কথা ভাবে। রাজি হলে সারাজীবনের খাওয়া-পরা নিশ্চিত। তাদের গ্রামের রহিম বক্স খোঁড়া পা নিয়ে ঢাকায় এসেছিল। আজ গ্রামে সে অনেক জমির মালিক। সবাই বলে সে নাকি ঢাকায় ভিক্ষা করত। সেও কি গোলাম মহাজনের মত কারও অধীনে চাকরি করত?

প্রচন্ড ক্ষিধেয় কাতর বরকত বেঞ্চিতে শুয়ে পড়ে। আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে তার ঘুম এসে যায়। ঘুমের মধ্যে সে তার বাবাকে দেখতে পায়। তাঁর হাতে একটি রাইফেল। তিনি হাটছেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বরকতকে তিনি রাইফেলটা দিলেন। বললেন- শোন, ভয় পাবি না। জীবনটা যুদ্ধক্ষেত্র। বাঁচতে হলে লড়াই করতে হবে। এই দেখ,  যুদ্ধে আমি পা হারিয়েছি। তাতে কী হয়েছে? আমরা দেশ পেয়েছি। তোকেও যুদ্ধ করতে হবে। পা দিতে হবে আমার মত। পারবি না? বরকত লজ্জিত গলায় বলে- পারব।

ঘুম ভাঙ্গে বিকেলে। এখনও ডান পা ব্যথা করছে। শরীর প্রচন্ড দূর্বল। বরকত চারদিকে তাকায়। 
বিকেলের সূর্যের আলো পড়ছে স্টেশন দূরবর্তী কৃষ্ণচুড়ায়। ওখানে যেন আগুন জ্বলছে। বরকত সেদিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। হঠাৎ ওর ভেতরে বেঁচে থাকার আকাঙ্খা সমুদ্রের জোয়ারের মত উছলে ওঠে। জীবন অনেক বড় ব্যাপার।  এটাকে হেলাফেলা করা মোটেও উচিত না, বরকত ভাবে। 

দূর্বল ক্ষুধার্ত শরীর নিয়ে সে সন্ধ্যার পর বেরিয়ে পড়ে। পাকস্থলি জ্বলে যাচ্ছে ক্ষুধার আগুনে। টাকা ছাড়া এই শহরে একফোঁটা জলও মেলে না। কী করা যায়। কী করা যায়? 
এক নম্বর প্লাটফর্মে দাড়িয়ে আছে মেঘবালিকা এক্সপ্রেস। স্বল্প দূরত্বের জানালায় দৃষ্টিতে স্পষ্ট এক মহিলা আর তার চার বছর বয়সী কন্যার মুখ। পাশে রাখা ব্যাগ। বরকতের মাথায় ন্যায় অন্যায়ের ভেদাভেদ রেখা মুছে যায়। সে ছিনতাইয়ের সিদ্ধান্তে এগিয়ে যায়।

ব্যাগ নিয়ে বেশিদূর দৌড়াতে পারেনা দূর্বল শরীরে। চারদিকে ধর ধর রব। একটা ইটের টুকরোয় পা লেগে পড়ে যায় পড়ে যায় প্লাটফর্মের ধুলোয়। নাক মুখ ফেটে রক্তাক্ত। পাঁচ সাতজন লোক হামলে পড়ে তার উপর। এর মধ্যে রেলপুলিশের বাঁশি। আর সবকিছুকে অতিক্রম করে বরকতের সামনে ভেসে উঠে গোলাম মহাজনের মুখ। 

মহাজনের চিৎকারে ভীর পাতলা হয়ে যায়। "এটা আমি দেখতাছি" বলে পুলিশের হাত থেকে প্রায় ছিনতাই করে মহাজন তাকে নিয়ে যায় লাল ইটের ঘরে। টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলে -মোছো। ফুল স্পীডে ফ্যান ছেড়ে মুখোমুখি বসে বরকতকে জিজ্ঞাসা করে- ঘটনা কী ছোটভাই?
বরকত নিরুত্তর।
-ঠোঁট ভাল করে মোছো। আমি লোক পাঠাইছি স্যাভলন আনতে।
তখনি একটা ছেলে স্যাভলন, পাউরুটি কলা নিয়ে আসল। খাবার দেখে বরকতের ক্ষিধে জেগে উঠতে শুরু করে।
-স্যাভলনটা লাগিয়ে তারপর খাও।

নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করে বরকত। গোলাম মহাজনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার চোখ ভিজে ওঠে। সে ভাবে, সময়মত মহাজন না গেলে ও বোধহয় মারাই যেত। 
-শোন, আমি সবাইকে বইলা দিসি তুমি আমার ছোটভাই। সো, তোমারে কেউ কিছুই বলবে না। কোনো সমস্যা নাই। এবার যাও। ঠিক আছে?

পূর্বের বিষয়ে তিনি আর কোনো কথা বললেন না। কিন্তু বরকত ভাবল, মহাজন যদি বলে তবে সে এখনই রেললাইনের শুয়ে পা দিয়ে দেবে। 

সে ফিরে যায় তার বেঞ্চিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে ক্লান্তিতে তার দু'চোখে ঘুম নেমে আসে। ঘুৃম ভাঙ্গে এগারোটায়। প্লাটফর্মে তখনও অনেক লোক। 

সে পুরোন দিনের কথা ভাবে। বিশেষ করে তার মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। জন্মের পর থেকে সে মাকে কত না কষ্ট করতে দেখেছে। প্রতিবেশীর তাচ্ছিল্য, আত্মীয়ের অপমান, সুদখোরের অত্যাচার- কী না তাকে সহ্য করতে হয়েছে! সবার স্বপ্ন ছিল সে বড় হয়ে সব সমস্যার সমাধান করবে। কিন্তু তা আর হল কই? উপরন্তু সেই বোঝা হয়ে শুধু দুঃচিন্তার দুঃসময় উপহার দিয়েছে। ভাবতে ভাবতে তার হৃদয় আর্তনাদ করে ওঠে। টলমল অশ্রুতে স্টেশন, প্লাটফর্ম  ঝাঁপসা হয়ে আসে। সে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে বসে। তাকে গোলাম মহাজনকে খু্ঁজে বের করতে হবে এখনই। 

সেই লাল ঘরেই মহাজনকে পাওয়া গেল। মহাজন অবাক হয়ে প্রশ্ন করল- কী খবর ছোটভাই?
- আমি রাজি।
- কী বিষয়?
- সকালে যেটা বললেন।
- ও হ্যা।
- এখন কী করব বলেন।
মহাজন সচকিত হয়ে ওঠে যেন। 
-ও হ্যা,  আমার লোকজন, গাড়ি রেডি। তুমি এক কাজ কর...এখান থেকে রেললাইন ধরে হাটতে হাটতে, সোজা পশ্চিমে চলে যাবা। স্টেশনের শেষ মাথা থেকে দু'তিনশ গজ সামনে। স্লিপারের বাইরের দিকে শুবা, পা রাখবা লাইনের উপরে, ওকে? চুপচাপ, কোনো টেনশন করবা না। বাকিটা আমি ও আমার ছেলেরা কাভার দেব। ওকে? ঠিক আছে যাও। মিলন, মিলন গাড়ি বের কর, জলদি।

লাল ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে বরকত। শেষবারের মত প্লাটফর্মের দিকে তাকায়। তারপর পশ্চিমে হাটা শুরু করে। 

স্লিপারগুলি ফাঁক ফাঁক করে থাকে বলে শোয়া কষ্টকর। কিন্তু উপায় নাই। বরকত শুয়ে পড়ে আলতো করে একটা পা তুলে দেয় রেললাইনের উপর। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাথা তুলে তাকালে প্লাটফর্মের আলো চোখে পড়ে। বরকত জানে আর কিছুক্ষণের মধ্যে ছেড়ে দেবে সুবর্ণ  এক্সপ্রেস। 

কিন্তু মহাজন কোথায়? তার লোকজনই বা কোথায়? তারা কি সময়মত আসবে?  নাকি সে আহত হয়ে পড়ে থাকবে? নিহত ও তো হতে পারে! তাইতো, যদি মরে যাই? বরকত ভাবে, মরলে তো বেঁচেই গেলাম! না মরলে পঙ্গু হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি। কোনটা তার ভাগ্যে আছে সে জানে না। এখনও সময় আছে। চাইলেই সে ট্রেন আসার আগেই চলে যেতে পারে। না। এই মুহুর্তে সে আর কিছু ভাবতে চায় না। যা হবার হবে। 

সুবর্ণ এক্সপ্রেসের হুইসেল প্রতিধ্বনিত হল দূরবর্তী দেয়ালে। বরকত টের পায় রেললাইনের মৃদু কম্পন। ট্রেন আসছে। বরকতের মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে। ট্রেনের গতি বাড়ছে। আবার হুইসেল। এবার আরও জোরে প্রতিধ্বনিত হল। যেন ট্রেনকে ব্যাঙ্গ করল কেউ। সাথে সাথে ট্রেনের হেডলাইটের তীব্র আলো সমস্ত চরাচরকে আলোকিত করে ভীষন গতিতে ছুটে আসতে লাগল। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড!

বরকতের মনে প্রশ্ন জাগল- মহাজন কোথায়? সে কি তাকে বাঁচাতে আসবে? এসব কী হচ্ছে! সে কি স্বপ্ন দেখছে, নাকি বাস্তব? স্বপ্ন বাস্তবতার দোদুল্যমানতায় বরকতের কান্না পায়। তার মনে পড়ে যুদ্ধাহত বাবার ক্লান্ত মুখ, মায়ের মলিন চোখ, ভাই-বোনদের শীর্ণ অবয়ব- যেন জয়নুলের আঁকা ক্যানভাস। তার খুব কান্না পায়, তীব্র অভিমানে কান্না পায়!

ট্রেন আসছে। সে কি পা সরিয়ে ফেলবে? সে কি মারা যাবে? নাকি বাঁচবে ফুটপাতে ফুটপাতে ক্লান্ত ক্রাচে ভর করে অবিশ্বস্থ পৃথিবী দেখার জন্য? পরক্ষণেই সমস্ত অনিশ্চয়তাকে গ্রাস করে সুবর্ণ এক্সপ্রেসের তীব্র আলো বরকতের চোখ ধাঁধিয়ে ফেলল।


সূচিতে ফিরতে ক্লিক করুন

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।